মুর বলছেন, জ্ঞানের বিষয় এবং বিষয়ের জ্ঞান, এই দুয়ের মধ্যে প্রভেদ অস্বীকার করার উপরই ভাববাদের প্রকৃত ভিত, অথচ এই তফাতকে স্বীকার না করে উপায়ও নেই। চেতনার বিষয় এবং বিষয়ের চেতনা যদি বিভিন্ন না হতো, তাহলে বিভিন্ন জ্ঞানের মধ্যে পার্থক্য সম্ভবপর হতো না। ‘লাল-রঙ’ সম্বন্ধে জ্ঞান এবং “নীল রঙ” সম্বন্ধে জ্ঞান, দুয়ের মধ্যে পার্থক্য ঠিক কীসের? নিছক চেতনা হিসেবে উভয় জ্ঞানই অভিন্ন, ফলে ভেদ নিশ্চয়ই জ্ঞানের বিষয়ে।
ভাববাদী বলবেন, এই যুক্তি ছাড়া মুর-এর ভাববাদ খণ্ডনের বাকি সবটুকুই নিছক ঘোষণামাত্র, প্ৰমাণ নয়। এবং এই যুক্তি দিয়ে, শুধু এই যুক্তি দিয়ে, ভাববাদকে নিশ্চয়ই খণ্ডন করা যায় না। প্রথমত, চেতনার বিষয়কে বিষয়ের চেতনা থেকে স্বতন্ত্র করা হচ্ছে নেহাত অৰ্থপত্তি হিসাবে, এবং অর্থপত্তির মূল্য বড় জোর সম্ভাবনামূলক। অর্থাৎ, এই যুক্তি বড় জোর বস্তুর বা বিষয়ের স্বতন্ত্র অস্তিত্বের সম্ভাবনা প্ৰমাণ করছে, অস্তিত্ব নয়। তাছাড়া, আসল প্রশ্ন হলো, সম্ভাবনা হিসেবে যে-বিষয়কে প্ৰমাণ করা গেল, তার প্রকৃত স্বরূপ কী রকম? ভাববাদী নিশ্চয়ই এমন কথা বলবেন না যে, জ্ঞানের বিষয় বলে সত্যিই কিছু নেই; মূর যেন ভাববাদীর ঘাড়ে এই কথা অধ্যস্থ করে। তারপর এই কথাকে খণ্ডন করেছেন। ভাববাদী বলবেন, চেতনার বিষয় নিশ্চয়ই আছে, এবং সেই বিষয়ের দািকনই এক চেতনা অপর চেতনা থেকে ভিন্ন; কিন্তু এই বিষয় জড়বস্তু নয়, অন্তর্বস্তু মাত্র। এ বিষয় যে অন্তর্বস্তু, বহির্বস্তু নয়, তার প্রমাণ হিসেবে ভাববাদী বলবেন, নিছক বহির্বস্তুরূপে, চেতনার সঙ্গে সম্পূর্ণ সম্পর্কবিরহিত অবস্থায়, তাকে কখনও জানা যায়নি। অথচ নিছক অন্তর্বস্তুর বিভিন্নতার দরুন জ্ঞানের বিভিন্নতা যে সম্ভবপর, তার উদাহরণ হিসেবে প্ৰাচীন দার্শনিকদের গন্ধৰ্বনগর দর্শন থেকে শুরু করে আধুনিক মনস্তত্ত্ববিদের ব্যাধিত অপচ্ছায়ার উল্লেখ করা যায়। তাই মূর-এর যুক্তি ভাববাদকে সত্যিই খণ্ডন করতে পারে না।
নব্যবস্তুস্বাতন্ত্র্যবাদীদের ভাববাদ খণ্ডনের বেলাতেও একই কথা। তঁদের যুক্তির জৌলুশ অনেক কম, কিন্তু মেজাজ অনেক বেশি চড়া। ভাববাদের মূলে অন্তত সাত-সাতটা অনুপপত্তি তারা আবিষ্কার করেছেন। তার মধ্যে তিনটি –অতিসারল্য, দার্শনিক দুরাশা এবং বেহিসেৰী ভাষা ব্যবহারের অপবাদকোন কোন বিশেষ ভাববাদীর বিরুদ্ধে নিয়োগযোগ্য হলেও ভাববাদ মাত্রের বিরুদ্ধেই এইগুলি যে প্ৰযোজ্য হবে, তার কোনো মানে নেই। জড়বাদী, অজ্ঞানবাদী, এমন-কী বস্তুস্বাতন্ত্র্যবাদী কোনো দার্শনিকের ব্যক্তিগত দুর্বলতা যদি থাকে, তাহলে এইসব অভিযোগ তাদের বিরুদ্ধেই প্ৰযোজ্য। অর্থাৎ এগুলি কোনো বিশেষ দার্শনিক মতবাদের অনুপপত্তি নয়, কোনো কোনো দার্শনিক বিশেষের ব্যক্তিগত দুর্বলতামাত্র। তাই এগুলিকে বাদ দিতে হবে। নিছক দার্শনিক মতবাদ হিসেবে ভাববাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ চারটি; এবং মজার কথা এই যে, সে চারটি অভিযোগের নামরূপে যতই পার্থক্য থাকুক না কেন, সবগুলির মূলেই বক্তব্য এক।
(১) এ পর্যন্ত মানুষ যা জেনেছে, তা সমস্তই জ্ঞানের উপর নির্ভরশীল বলে সমস্ত বস্তুই যে জ্ঞানের উপর নির্ভরশীল হতে বাধ্য, এমন কোনো কথা নেই; (২) জ্ঞানের সময় চেতনার সঙ্গে বিষয়ের সম্পর্ক আছে বলে সে সম্পর্ক যে ত্ৰৈকালিক হতে বাধ্য, এমন কোনো কথা নেই,-যে লোক আজ রিপাবলিকান রাজনীতি করছে, আগামীকাল সে যে ডিমোক্রাটুদের ডেরায় ভিড়বে না, এমন কথা কি কেউ জোর করে বলতে পারে? (৩) বিষয়ের প্ৰাথমিক পরিচয়ে চেতনা-নির্ভরতা থাকলে এই পরিচয় যে তার চিরন্তন পরিচয় হবে, এমন কোনো কথা নেই,–“আগল” “পাগল” “ছাগল” শব্দে “গ” অক্ষর দ্বিতীয় অক্ষর বলে “গ” যে সর্বদাই শব্দের দ্বিতীয় অক্ষর হবে একথা দাবি করা যায় কি? (৪) বিষয়ের পক্ষে জ্ঞাত হওয়া গৌণ লক্ষণ মাত্র, তাকে মুখ্য লক্ষণ মনে করলে চলবে না, – প্রেমিকের সত্তা প্রেমের উপর নির্ভর করে নিশ্চয়ই।
রাজনীতি থেকে শুরু করে হৃদয়ঘটিত ব্যাপার পর্যন্ত রকমারি দৃষ্টান্ত! একের পর এক অকাট্য যুক্তি। একের পিঠে শূন্য বসালেও দশ হয়, দশের পিঠে শূন্য বসালেও একশো হয়—একটি যুক্তির উপর আর একটি যুক্তি চাপিয়ে খণ্ডন করলে খণ্ডনের গুরুত্ব এইরকম হুড়হুড় করে বেড়ে যেতে পারে, অনুবতী যুক্তি যতই দুর্বল হোক না কেন। কিন্তু শূন্যের পিঠে যাই বসানো যাক, ফল শুধুই শূন্যই, গুরুত্ব এতটুকুও বাড়ে না। নব্যবস্তুস্বাতন্ত্র্যবাদীর প্রথম বা একটি যুক্তির মূল্যও যদি শূন্যর চেয়ে বেশি হতো, তাহলে সত্যিইভাবনা থাকত না, ভাববাদকে যুক্তি দিয়ে ভেঙেচুরে মিসমার করে দেওয়া যেত। কিন্তু ভাববাদের খণ্ডন হিসেবে কোনো একটি যুক্তিও শূন্যর চেয়ে বেশি সারবান নয়। তাই সাত-সাতটা যুক্তির পরেও ফল দাঁড়িয়েছে শুধু শূন্য দিয়ে শূন্যকে গুণ করার মতো।
ভাববাদী বলবেন, শুধুমাত্র কয়েকটি দৃষ্টান্তে জ্ঞানের উপর বিষয়কে নির্ভরশীল হতে দেখে আমি যদি বলতুম, জ্ঞানের উপর বিষয় একান্তভাবে নির্ভর করে, তাহলে আমার কথাকে খণ্ডন করবার জন্যে নব্যবস্তুস্বাতন্ত্র্যবাদীর পক্ষে অত বড় অনুপপত্তির ফর্দ দরকার পড়ত না। কিন্তু আসল কথা মোটেই তা নয়। আসল কথা হলো-এমন কোনো বিষয়ের সন্ধানও মানুষ এখন পায়নি, যার সত্তা চেতনানিরপেক্ষ। অতীতের সমস্ত মানুষ এবং বর্তমানের সমস্ত মানুষ দাড়কাককে কালো বলে চিনেছে বলেই দাঁড়কাকমাত্ৰকেই কি কালো বলে মানার তাগিদ নেই? অবশ্য, শুধু এ জাতীয় যুক্তি-স্বদেশী ন্যায়শাস্ত্রে যাকে বলে অন্বয় – সুনিশ্চিত নিগমন স্থাপন করতে পারে না, শুধু অবাধিত অভিজ্ঞতার উপর নির্ভর করে যে নিগমন পাওয়া যায়, তা সম্ভাবনামূলক মাত্র। কেননা, এখানে বিপরীত অভিজ্ঞতার কথা অন্তত কল্পনা তো করা যায়-বিপরীত অভিজ্ঞতা এতদিন পর্যন্ত অবাস্তব হলেও অসম্ভব। মোটেই নয়। কিন্তু ভাববাদী বলবেন, আমার দর্শনের ভিত্তি এত কঁাচা নয়, অভিজ্ঞতা-নিরপেক্ষ বিষয়কে এতদিন যে অভিজ্ঞতার মধ্যে পাওয়া যায়নি। শুধু তাই নয়, তাকে পাবার কথা ভাবাই যায় না, এমন-কী কল্পনাতেও নয়। কেননা, নিছক বিষয় বা বিষয়মাত্রকে পাবার কথা কল্পনা করতে গেলে অন্তত কল্পনার সঙ্গে তার সম্পর্ক স্বীকার করতে হবে; এবং কল্পনা যে-হেতু মানসক্রিয়ার প্রকারমাত্র, সেইহেতু উক্ত বিষয়কে মানসক্রিয়ার সঙ্গে সংযুক্ত, অতএব মানসক্রিয়ার উপর নির্ভরশীল, মনে না করে উপায় নেই। তাই মানস-নিরপেক্ষ বিষয়ের কথা সোনার পাথরবাটির মতো। সোনার পাহাড় সম্বন্ধে অভিজ্ঞতা না হলেও তার অস্তিত্ব কল্পনায় স্ববিরোধ নেই, কিন্তু সোনার পাথরবার্টির শুধু অভিজ্ঞতা অসম্ভব নয়, তার অস্তিত্ব-কল্পনায় স্ববিরোধ। অভিজ্ঞতা-নিরপেক্ষ বিষয়ের কথাও ওইরকমই স্ববিরোধী–কেননা, বিষয় মানেই অভিজ্ঞতার বিষয়, তা সে বাস্তব অভিজ্ঞতাই হোক, আর কাল্পনিক বা সম্ভব অভিজ্ঞতাই হোক।