যদিও নৈয়ায়িকভাবে অসম্ভব নয়, তবুও একে মানবার কোনো তাগিদ। নেই-কথাটা একদিক থেকে ঠিক। অধিবিদ্যার বিশুদ্ধ বুদ্ধি দিয়ে ভাববাদকে খণ্ডন করা না গেলেও ভাববাদকে মানবার কোনো তাগিদ বাস্তবিকই নেই, কেননা প্রয়োগের ক্ষেত্রে ভাববাদের অন্তঃসারশূন্যতা একেবারে প্রকট হয়ে পড়ে। কিন্তু রাসেল তো আর সে-দিকে এগোননি। বরং তিনি আগে থাকতে উলটো সুর গেয়ে উলটোভাবে গোড়া বেঁধে রাখতে চেয়েছেন, আগে থাকতে তিনি বলে রেখেছেন-দার্শনিক হবার বাসনা থাকলে আজগুবিকে ভয় করলে চলবে না (দার্শনিক হবার বাসনা, না ভাববাদী হবার বাসনা?)। তাই আমাদের দেশের ন্যায়-সূত্রকার রাসেল-এর মুখে এমনতর কথা শুনলে নিশ্চয়ই উৎসাহিত হয়ে উঠতেন। কেননা, তিনি যে অনুপপত্তির নাম দিয়েছেন ‘বিরুদ্ধ, তার দৃষ্টান্ত অপেক্ষাকৃত বিরল, এবং রাসেল-এর এই উক্তি সেই অনুপপত্তির প্রকৃষ্ট উদাহরণ। সিদ্ধান্তমত্যুপেত্য তৎবিরোধী বিরুদ্ধ : রাসেল-এর অজস্র অস্থিরমতিত্ব সত্ত্বেও সমস্ত দর্শন ধরে তিনি শুদ্ধ ন্যায়শাস্ত্রের দাবিকে, প্রয়োগ-জীবনের সঙ্গে লেশ সম্পর্কহীন বিশ্লেষণের দাবিকে চরম দাবি বলে ঘোষণা করেছেন; আর তা সত্ত্বেও কিনা হঠাৎ বলে বসেছেন, ভাববাদ খণ্ডন এ দাবিকে মেটাতে না পারলেও অস্বীকাৰ্য নয়!
তর্কবলে ভাববাদকে যে অপ্ৰমাণ করা যায় না, এ কথায় রাসেল-এর অবশ্য তেমন কোনো বিক্ষোভ নেই, হাজার হোক রাসেল হলেন ম্যাক-আভেনেরিয়সের দার্শনিক বংশধর, প্ৰচ্ছন্ন ভাববাদীই। কিন্তু ফরাসী দার্শনিক দিদারো-র পক্ষে অত সহজে এই কথা স্বীকার করা কঠিন। তিনি মনেপ্ৰাণে বস্তুবাদী, ভাববাদের কবল থেকে তাঁর মুক্তি-প্ৰয়াসের মধ্যে ফাকি নেই। তাই, তর্কবলে ভাববাদের অসম্ভাবনাকে অপ্ৰমাণ করা যাচ্ছে না দেখে তার যে আক্ষেপ ও অসহিষ্ণুতা, সেটা লক্ষ করবার মতো :
“যে-সব দার্শনিকেরা শুধু নিজেদের অস্তিত্ব এবং নিজেদের মনের মধ্যে ইন্দ্ৰিয়-পরম্পরার অস্তিত্ব সম্বন্ধে সচেতন হয়ে বাকি সমস্ত কিছুর অস্তিত্বকে অস্বীকার করেন, তঁদেরই নাম ভাববাদী! এ হলো এক রকমের দার্শনিক নবাবিয়ানা, আমার তো মনে হয় শুধুমাত্র অন্ধ মানুষ এরকম দর্শনের জন্ম দিতে পারে; তবুও মানুষের বুদ্ধির আর দর্শনের গলায় দড়ি, এ মতবাদ সবচেয়ে আজগুবি হলেও একে খণ্ডন করা সবচেয়ে দুরূহ।”
দিদারো-র এই উক্তি উদ্ধৃত করে লেনিন বলছেন, দিদারোই সাম্প্রতিক বস্তুবাদের খুব বেশি কাছ ঘোষতে পারেন, কারণ তিনি বুঝেছিলেন যে, শুধু তর্ক বা শুধু যুক্তি দিয়ে ভাববাদকে খণ্ডন করা যায় না, কেননা এখানে আসল কথা তর্কাতর্কির কথাই নয়।
নিছক তর্কবলে ভাববাদকে যে খণ্ডন করা যায় না, এ কথা প্ৰমাণ করবার জন্যে শুধু দুচারজন দার্শনিকের স্বীকৃতির উপর নির্ভর করবার দরকার নেই। সাম্প্রতিক দর্শনে বুদ্ধিমূলক ভাববাদ খণ্ডনের চরম দৃষ্টান্তকে বিশ্লেষণ করা যাক; দেখা যাবে, বিপক্ষের অনেক বাকময় শরের শয্যায় শুয়েও ভাববাদ কী-রকম অক্ষত দেহে কী অক্ষুন্ন আয়াস উপভোগ করতে পারে। স্থানাভাবের দরুন এখানে মাত্র একটি দৃষ্টান্ত তুলব।–সাম্প্রতিক বস্তুস্বাতন্ত্র্যবাদের ভাববাদ খণ্ডন। সাম্প্রতিক দর্শনে সেইটিই প্ৰধান দৃষ্টান্ত। মনে রাখতে হবে, আমাদের দেশের প্ৰাচীনেরা বলেছেন, ‘প্রধান-মল্প-নিবৰ্হিণ ন্যায়’। মল্পক্ষেত্রে বিপক্ষ হিসেবে প্ৰধান মল্লকে যদি পরাভূত করা যায়, তাহলে ছোটখাট মল্পের সঙ্গে আর আলাদাভাবে লড়বার দরকার পড়ে না। দার্শনিক দ্বন্দ্বের বেলাতেও সেই রকম।
সাম্প্রতিক দর্শনে বস্তুম্বাতন্ত্র্যবাদীর ভাববাদ খণ্ডন নিয়েই শোরগোল সবচেয়ে বেশি। এবং বস্তুস্বাতন্ত্র্যবাদের মধ্যে প্ৰধান হলেন শ্ৰীযুক্ত মূর–ভাববাদের বিরুদ্ধে তিনি যে সুর শুরু করেছেন, বাকি সব বস্তুস্বাতন্ত্র্যবাদী মোটামুটি তারই ধুয়ো ধরেন,–যদিও নানান ভাবে, নানান ভঙ্গিমায়। তাই মুর-এর যুক্তিটাই প্ৰথমে ধরা যাক। মূর বলেন, ভাববাদ–তা সে যে-জাতেরই হোক না কেন, –প্রেরণা পেয়েছে বার্কলির সেই সরল উক্তি থেকে–সত্তার সার-পরিচয় তার অভিজ্ঞতায়। কিংবা, যা একই কথা, অভিজ্ঞতা-নিরপেক্ষ কোনো বস্তুর সত্তা অভাবনীয়।
মূর বলেন, অতি সরল এক অনুপপত্তির উপর এই মতবাদের প্রতিষ্ঠা। যে-কোনো অভিজ্ঞতাকে বিশ্লেষণ করলে দুটি স্বতন্ত্র উপাদান পাওয়া যাবে। – এক হলো চেতনা, যার সঙ্গে সমস্ত ইন্দ্ৰিয়বেদনার সম্পর্ক; আর এক হলো চেতনার বিষয়, যার দরুন। এক অভিজ্ঞতা অন্য অভিজ্ঞতা থেকে ভিন্ন। ‘লালরঙ” সম্বন্ধে জ্ঞান এবং “নীল-রঙ” সম্বন্ধে জ্ঞান,-এ দুয়ের মধ্যে প্ৰভেদ স্পষ্ট, এবং এ প্ৰভেদের কারণ বিষয়ের বিভিন্নতা ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না। আবার জ্ঞান হিসেবে দুটির মধ্যে সাদৃশ্য, সে সাদৃশ্যের কারণ উভয়ের মধ্যে চেতনার বিদ্যমানতা। তাই, চেতনার বিষয় এবং বিষয়ের চেতনা, এ দুয়ের মধ্যে তফাত করতেই হবে; অথচ সেই প্ৰভেদকে অস্বীকার করার উপরই ভাববাদের আসল ভিত্তি। চেতনার বিষয় ও বিষয়ের চেতনা-এ দুয়ের মধ্যে যে সম্পর্ক, তারই নাম “জ্ঞান” বা “সচেতন হওয়া”। এ সম্পর্ক আদি ও অপূর্ব, এর জুড়ি আর কোথাও মিলবে না। তাই, নীল রঙ সম্বন্ধে যখন জ্ঞান হচ্ছে, তখন এ কথা বলা চলবে না যে, আমাদের চেতনায় নীল-রঙ-এর প্রতিবিম্ব পড়ছে, কেননা এখানে আসলে জ্ঞান হচ্ছে নীল-রঙ-এর জ্ঞান সম্বন্ধেই।