আসলে, একদিক থেকে বাস্তবিকই তাই। শুধু বুদ্ধি দিয়ে ভাববাদকে খণ্ডন করা যায় না-যে-দর্শন বুদ্ধির দাবিকে, বিশুদ্ধ চেতনার দাবিকে চরম দাবি বলে দেখতে চায়, সে-দর্শন শেষ-পৰ্যন্ত ভাববাদেই পরিসমাপ্তি পেতে বাধ্য। তাই শুধু তর্ক-বলে ভাববাদকে অস্বীকার করতে গেলে শেষ-পর্যন্ত তর্কের খাতিরেই ভাববাদকে স্বীকার করতে হয়। একথা নৈয়ায়িকভাবে অনিবাৰ্য, এবং এর সামাজিক কারণটুকুও স্পষ্ট।
নৈয়ায়িকভাবে কেন যে অনিবাৰ্য, প্রথমে তা-ই আলোচনা করা যাক। সামাজিক ভিত্তির কথা প্ৰথমেই তোলা উচিত; তবুও পরে তোলাই ভালো। কেননা পণ্ডিতমহলের এতদিনকার একটানা প্রচারের ফলে দর্শনের সাধারণ ছাত্রের পক্ষে দার্শনিক বিচারে নিছক নৈয়ায়িক সিদ্ধান্তকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত বলে মেনে নেওয়া আজ প্ৰায় অভ্যাসে পরিণত। তাই শুরুতেই সামাজিক উৎসের কথা প্ৰতিবন্ধ হয়ে দাড়াতে পারে। আমাদের প্রাচীনেরা বলতেন। “শাখা চন্দ্র-স্যায়”-চাদ যদি গাছের আড়ালে থাকে, তাহলে প্ৰথম চেষ্টাতেই সে চাদ কাউকে দেখানো হয়তো কঠিন; তাই গাছের সেই শাখার দিকেই প্ৰথমে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে হয়। দার্শনিক আলোচনাতেও তাঁরা এইভাবে অগ্রসর হবার নির্দেশ দিয়েছেন। যে-কথা শুনতে শ্রোতার অভ্যাস আছে, সেই কথাতেই আলোচনার সূত্রপাত হওয়া উচিত, পরে যে-কথায় তিনি অনভ্যস্ত, সেই কথার দিকে ধীরে ধীরে অগ্রসর হওয়া ভালো। কেবল মনে রাখতে হবে, লোকায়তিক দৃষ্টিতে নিছক নৈয়ায়িক আলোচনা অর্থহীন ও অবাস্তর; মূর্ত সামাজিক পরিপ্রেক্ষা থেকে বিচ্ছিন্ন হলে, লৌকিক জীবনের দৈনন্দিন প্রয়োগ থেকে বিচুত হলে, দার্শনিক আলোচনা-তা সে যতই যুক্তিকণ্টকিত ও আপাতপাণ্ডিত্যপূর্ণ হোক না কেন-কাকদন্ত পরীক্ষার মতো বৃথা হতে বাধ্য। কেননা দর্শন শুধু শৌখিন মানুষের অবসর বিনোদন নয়, শ্রেণীসংগ্রামের অস্ত্ৰও। এতদিন পর্যন্ত পরোক্ষভাবে তাই হয়ে এসেছে, আজকে প্ৰত্যক্ষভাবে হবার দিন এসেছে। কিন্তু শুরুতেই এসব কথা প্ৰতিবন্ধ সৃষ্টি করবে। আপাতত শাখাকে চন্দ্ৰ মনে করেই অগ্রসর হওয়া যাক, আলোচনা করা যাক, তর্ক-বলে কেন যে ভাববাদকে খণ্ডন করা সম্ভব নয়, তার নৈয়ায়িক অনিবাৰ্যতা নিয়ে।
তর্ক বলে, শুধু বুদ্ধি দিয়ে, ভাববাদকে খণ্ডন করা অসম্ভব; এ প্রচেষ্টা স্ববিরোধী, অতএব আত্মঘাতী। বুদ্ধি দিয়ে খণ্ডন করতে গেলে মেনে নিতে হবে বুদ্ধির দাবি-তর্কের দাবি, চেতনার দাবি-চরম দাবি; মানতে হবে, এ দাবি মেটাতে পারে না বলেই আলোচ্য মতবাদ সমর্থনের অযোগ্য। তর্কমূলক খণ্ডনের আর কী মানে হওয়া সম্ভব? কিন্তু ওটুকুকে স্বীকার করা মানেই ভাববাদকে স্বীকার করা। কেননা, ভাববাদের মূল কথাও ওই একই; চেতনার দাবিই চরম দাবি; চেতনাই প্ৰাথমিক ও পরম সত্য। এ-কথাকে। নানানভাবে প্ৰকাশ করা হয়েছে। অভিজ্ঞতা বা চেতনা বা বুদ্ধি বা মন,- বা অমাজিত মানুষের কাছে খটকা লাগে, এই ভয়ে যার নাম দেওয়া হয়েছে ভগবান-যে-কোন শব্দ দিয়েই একে বর্ণনা করা যাক না কেন, তাকেই পরমসত্তা বলে মানতে হবে, তার দাবিই চরম দাবি, তার উপর নির্ভর করে। বলেই বাস্তব হলো বাস্তব, তার উপর যা নির্ভর করে না তার নাম অলীক। তাই মানা চলবে না চেতনা-নিরপেক্ষ কোনো জড়পদার্থকে, বলতে হবে বস্তুর ধারণা নেহাতই নামমাত্র সত্য (বার্কলির নামমাত্রবাদ)।
দর্শনের মূল প্রশ্ন হলো : বুদ্ধির কাছে যে দাবি প্রাথমিক ও মৌলিক, পরমসত্তা কি সেই দাবি মেটাতে বাধ্য? ভাববাদী বলবেন : নিশ্চয়ই; সেটুকুই তো আমাদের দর্শনের সচেতন ভিত্তি; এবং শুধু আমার দর্শনের কেন, যারা আমার কথা মানেনও না, তারাও এই ভিত্তিটুকুকে অচেতনভাবে স্বীকার করে নেন। তাই ভাববাদকে খণ্ডন করতে গিয়ে যদি কেউ ভাববাদের এই মূল কথাটুকুই মেনে নেন, যদি আশা করেন তর্কবলে ভাববাদকে খণ্ডন করা সম্ভব হবে, — অর্থাৎ, দেখানো যাবে, তর্কের দাধি মেটাতে পারে না বলেই ভাববাদ ভ্ৰান্ত-তাহলে ভাববাদীর পক্ষে এতটুকুও বিচলিত বোধ করবার কারণ নেই। ভাববাদী জানেন, যে-পূর্বপক্ষ বুদ্ধির দাবিকে চরম দাবি বলে মেনে নিয়েছে, সে-পূর্বপক্ষ সাপও নয়, সাপিনীও নয়, শুধু ফোঁস-ফোঁস; নেহাতই পোষা সাপ, যে-সাপ কখনো ছোবল দেবে না।
তর্কের উপর বিরূপ হয়েছেন অনেক দার্শনিক, বুদ্ধি সম্বন্ধে বিতৃষ্ণ হয়েছেন অনেকে। তাঁরা কেউবা ধরেছেন নিবুদ্ধির পথ, কেউবা অতিবুদ্ধির। এঁদের কথা আলোচনা করলে দেখা যাবে, শ্রেণীর দাবি আর যুগের দাবি মেটাতে গিয়ে বুদ্ধির যেটুকু আসল অবদান, সেটুকুকেই এরা কেমনভাবে অস্বীকার করেন, আর কেমনভাবে মেনে নেন, শুদ্ধবুদ্ধির যেটা আসল গ্লানি, তাকেই। আপাতত দেখা, যাক কোনো কোনো দার্শনিক কী রকম স্পষ্ট বা অস্পষ্টভাবে অনুভব করেছেন, শুধু তর্কবলে ভাববাদকে খণ্ডন করা যায় না। দৃষ্টান্ত হিসেবে ফরাসী দার্শনিক দিদারো এবং ইংরেজ দার্শনিক রাসেল-এর উল্লেখ করা যায় {
রাসেল বলছেন (মনে রাখতে হবে, রাসেল হলেন সাম্প্রতিক বস্তুস্বাতন্ত্র্যবাদের একজন প্রধান, আধুনিক দর্শনের ইতিহাসে একজন প্ৰধান বর্ণচোরা ভাববাদী) : “একদিক থেকে মানতেই হয় যে, আমরা নিছক নিজেদের সত্তা এবং নিজেদের অভিজ্ঞতা ছাড়া অন্য কোনো বস্তুর সত্তা প্ৰমাণ করতে পারি না। পৃথিবীতে শুধু আমরা এবং আমাদের চিন্তা, অনুভূতি ও ইন্দ্ৰিয়বেদনা ছাড়া আর যে কিছুই সত্য নয়, বাকি সবই যে আমাদের কল্পনামাত্ৰ, এই অর্থপত্তি থেকে কোনো নৈয়ায়িক অসম্ভাবনা হয়তো ঘনায় না। –সমস্ত জীবনটাই যে একটা স্বপ্ন, সে স্বপ্নে আমাদের সামনে যা কিছু ঘটছে তা আমাদেরই সৃষ্টি, এ কথা ভাবার মধ্যে কোনো নৈয়ায়িক অসম্ভাবনা নেই। কিন্তু ন্যায়শাস্ত্রের দিক থেকে যদিও এ কথা অসম্ভব নয়, তবুও একে সত্যি বলে মানবার কোনো রকম কারণ নেই।”