সহজ কথা সন্দেহ নেই। কিন্তু নতুন কথা কোথায় হলো ? প্রয়োগের প্ৰসঙ্গটা অবশ্যই নতুন, তবু এ তো সুস্থ প্রয়োগের ওপর নির্ভর করা নয়, প্রয়োগের দোহাই-পাড়া মাত্র। কেননা, প্রয়োগবাদীদের মতে এই তথাকথিত প্রয়োগের আসল তাৎপৰ্য শেষ পর্যন্ত ঠিক কী ? সুখানুভূতি-শেষ পর্যন্ত অনুভূতিই, মানস-অভিজ্ঞতাই ! যাথার্থ্য বা সত্যের একান্ত নির্ভর রুচিমাফিক অনুভূতি বা অভিজ্ঞতাই। মানুষের মধ্যে যেটা সবচেয়ে খামখেয়ালী, সবচেয়ে ব্যক্তিগত দিক-তারা ভালো-লাগা-না-লাগা–প্ৰয়োগবাদীর মতে তার উপরই পরমসত্তার চরম নির্ভর । সহজ কথা সন্দেহ নেই, কিন্তু এমন কিছু নতুন কথা নয়। গ্ৰীক যুগে সফিস্টদের মুখেও এই কথাই শুনতে পাওয়া গিয়েছিল, শোনা গিয়েছিল, সমস্ত সত্যের চরম কষ্টিপাথর হলো ব্যক্তিগত মানুষের ভালো-লাগা-না-লাগা ; কেবল তারা এমন আধুনিক ভাষায় প্রয়োগ শব্দের দোহাই দিতে জানতেন না । ভাববাদের পুরোনো কথাটুকুই, কেবল বাইরের দিকটাই নতুন। শুধু নবকলেবর।
ভাববাদীর ভাষা যেন গঁদের সঙ্গে করাতগুঁড়ো মিশিয়ে একটু ঘন করা হয়েছে, বললেন সাম্প্রতিক বস্তুস্বাতন্ত্র্যবাদী । অন্তত সাত সাতটা সরল অনুপপত্তির ওপর ভাববাদের ভিত, বললেন নব্য-বস্তুস্বাতন্ত্র্যবাদীর দল। মনে হয়, মেজাজটা এবার রীতিমতো কড়া, আশা হয় এবার আর কোনো রকম আপসের কথাই উঠবে না। ঠিক হলো, ভাববাদকে খণ্ডন করতে হবে রীতিমতো দল পাকিয়ে, সভা ডেকে । সভা ডাকলেন নব্য বস্তুস্বাতন্ত্র্যবাদীরা ; সভা ডাকলেন বৈচারিক বস্তুস্বাতন্ত্র্যবাদীর দল-বড় বড় নামজাদাদের সভা । ঠিক হলো, এমন-কী ন্যায়শাস্ত্রকেও সমূলে সংস্কার করতে হবে-পুরোনো ন্যায়শাস্ত্রের আবর্জনায় ভাববাদের আগাছা জন্মেছিলো, তাই সংস্কৃত বৈজ্ঞানিক নব্যন্যায় চাই। প্ৰবর্তিত হলো “গাণিতিক” নব্যন্যায় ।
অনুষ্ঠানের এতটুকুও ত্রুটি নেই। আয়োজন দেখে মনে হয়, ভাববাদের পরমায়ু এবার সত্যিই শেষ হবে। ভাববাদ তবুও যেন মিশরের সেই পৌরাণিক পাখিই, নিজের ভস্মাবশেষের মধ্যেই তার নবজন্মের নিঃসন্দেহ সুচনা । সাম্প্রতিক বস্তুস্বাতন্ত্র্যবাদীদের এত তোড়জোড়, এত শোরগোল, শেষ পৰ্যন্ত তারও পরিসমাপ্তি ভাববাদেই ! জানি, একথা প্ৰমাণ করা পরিসরসাপেক্ষ, বিশেষত এই কারণে যে, সাম্প্রতিক বস্তুস্বাতন্ত্র্যবাদীরা জানেন, নিজেদেরওই গোপনভাববাদকে ঢাকবার জন্য জটিল তর্ক আর দুরূহ পরিভাষার ঠাসবুনোনি দিয়ে কী অপূর্ব আচ্ছাদন বুনতে হয়। সহজ কথাকে কঠিন করে প্রকাশ করবার দুর্লভ মেধা তাদের। সুখের বিষয়, মরিস কর্নফোর্থ তার গ্ৰন্থ “বিজ্ঞানের বিরুদ্ধে ভাববাদ”- এ এই আচ্ছাদনকে ছিন্নভিন্ন করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন, অত দুরূহ জটিলতার পেছনে মোদ্দা কথাটুকু বার্কলিরই কথা । সাম্প্রতিক বস্তুস্বাতন্ত্র্যবাদীদের তথাকথিত গাণিতিক নব্যন্যায়ের স্বরূপও তিনি উদঘাটন করেছেন । আসলে সাম্প্রতিক বস্তুস্বাতন্ত্র্যবাদীরা এই নব্যন্যায়-এর চারপাশে এমন দুৰ্বোধ্যতার আর জটিলতার আবহাওয়া সৃষ্টি করেছেন যে, সাধারণ পাঠক একে দূর থেকে সন্ত্রম করেন, কাছ-ঘোষবার সাহস বড় কারুর হয় না। কর্নফোর্থ এর গ্ৰন্থ পড়ার পর বুঝতে পারা যায়, এ যেন এক অতি আধুনিক দিল্লির লাডু-শুধু যে না-খেলেই পস্তাতে হয় তাই নয়, খেতে গেলেও পস্তাতে হয়, কেননা খেতে গেলে শুধুই দাঁত ভাঙে, কিন্তু ভাববাদের চর্বিতচর্বণ ছাড়া নতুন কোনো আস্বাদ জোটে না।
কর্নফোর্থ এর গ্রন্থ ছাড়াও এখানে শুধু একটা উদাহরণ দেওয়া যাক । সাম্প্রতিক বস্তুস্বাতন্ত্র্যবাদের গুরুদেব হলেন ইংরেজ দার্শনিক মূরি। “ভাববাদ খণ্ডন” নামে তাঁর ছোট প্ৰবন্ধ হালের য়ুরোপীয় দর্শনের ইতিহাসে নাকি যুগান্তর এনেছে। উত্তর-বস্তুস্বাতন্ত্র্যবাদীরা সকলেই তার কাছে প্ৰত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ঋণী। ভাববাদের বিরুদ্ধে গালিগালাজ করবার সময় মুর-এর কণ্ঠ সতেজ, যুক্তি যেন দুর্ধর্ষ। জ্ঞানের বিষয় জ্ঞাতার মনের ওপর নির্ভর করে, এ কথা বলা, মূর-এর মতে, নেহাতই নির্বোধের লক্ষণ। কিন্তু এ সমস্তই তো নেতিবাচক কথা। প্রশ্ন ওঠে, জ্ঞানের বিষয় তাহলে ঠিক কী রকম ? উত্তরে মূর ইন্দ্ৰিয়োপাত্ত (Sense-datum) নামের এক জাতীয় সত্তার আমদানি করলেন । এই ইন্দ্ৰিয়োপাত্ত হল দর্শনের জগতে অভিনব-তম আজব-চিড়িয়া, অভিজ্ঞতাবিচারবাদীর element-এর সাক্ষাৎ বংশধর । লেনিন দেখিয়েছিলেন, element জিনিসটা বার্কলির percipii ছাড়া আর কিছুই নয়। মুর-এর ইন্দ্ৰিয়োপাত্তর বেলাতেও হুবহু একই কথা । এই ইন্দ্ৰিয়োপাত্তর স্বরূপ নিৰ্ণয় করা নিয়ে যতই তিনি মাথা ঘামিয়েছেন, ততই তাঁকে বস্তুস্বাতন্ত্র্যবাদ ছেড়ে পেছু হটতে হয়েছে। বার্কলি-হিউমের ভাববাদের দিকে। মুর-এর দর্শনে এই যে বিপৰ্যয়, একে নিছক তাঁর ব্যক্তিগত খেয়ালখুশিও বলা চলে না ; সাম্প্রতিক বস্তুস্বাতন্ত্রাবাদীরা প্ৰায় প্ৰত্যেকেই এই দিক থেকেও গুরুদেব মূর-এর চরণচিহ্ন অনুধাবন করেন। জ্ঞানবিজ্ঞান (Epistemology) নিয়ে তাঁদের অন্য অজস্র বিতর্কের পেছনে তাই ভাববাদেরই বিচ্ছুরিত হাসি ।
প্ৰাচীন মিশরে দেবতা আসিরিসের জীবন-মরণ-কাহিনী নিয়ে প্ৰতিবছর মরমী নাট্যের অভিনয় হতো। দেবতার পীড়ন, দেবতার মৃত্যু, তারপর আবার দেবতার পুনরুজ্জীবনের পর দেবতা দেখা দিতেন হয় তাঁর নিজের মূর্তিতেই, আর না হয় তো পুত্র হোরাস-এর মূর্তিতে। কিন্তু মূর্তি যারই হোক, মূলে সেই দেবতাই, সেই অসিরিস। দর্শনের ইতিহাসেও যেন একই নাটকের অভিনয় । ভাববাদের পুনরুজ্জীবনও চিরকাল একই মূর্তিতে নয়, কিন্তু বিভিন্ন মূর্তির মধ্যে আপাত পার্থক্য যতই হোক না কেন, মূলে সেই পুরাতন ভাববাদই । তাই পূর্বপক্ষ এ কথা বলতে পারবেন না যে, একজাতীয় ভাববাদ খণ্ডন করে শঙ্করপ্রমুখ দার্শনিকেরা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র জাতের ভাববাদ প্রবর্তন করেন। আসলে বিভিন্ন ভাববাদের মধ্যে বৰ্ণভেদটুকু আপাতত যতই গুরুত্ব বলে মনে হোক না কেন, শেষ পর্যন্ত তা নেহাতই অগভীর। একথা মূর এবং পেরীর মতো দার্শনিকদের দৃষ্টিও এড়ায়নি, যদিও তারা যে যুক্তি দিয়ে কথাটা প্ৰমাণ করবার চেষ্টা করেন, সে যুক্তি শেষ পর্যন্ত বিচারসহ নয়। ভাববাদের সামাজিক উৎস নিয়ে আলোচনা করবার সময় এ বিষয়ে দীর্ঘতর মন্তব্যের অবকাশ পাব ।
০২. ভাববাদকে খণ্ডন করা যায়নি
অনেক নামকরা দার্শনিক, অনেক রকম যুক্তি-তর্ক দিয়ে ভাববাদকে অপ্ৰমাণ করতে চেয়েছেন। তবু ভাববাদকে খণ্ডন করা যায়নি। বরং একে খণ্ডন করবার জন্য বুদ্ধির জৌলুশে দীপ্ত যে-সব দার্শনিক প্রায় মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন, শেষপৰ্যন্ত র্তারা ভাববাদের স্নিগ্ধচ্ছায়াতেই ক্লান্ত দার্শনিক চেতনা এলিয়ে দিলেন। যেন ভাববাদই একমাত্র আর অনিবাৰ্য দার্শনিক মতবাদ, যেন মানুষের বুদ্ধি এই চূড়ান্ত অসম্ভবের পায়ে যুগ যুগ ধরে মাথা কুটেছে, তবু মুক্তি পায়নি। তার দাসত্ব থেকে।