কিন্তু এই শ্রেণী-সংগ্রামের মধ্যে শূদ্রদল বা জনগণ বিপক্ষের জয় বা নিজেদের পরাজয় যে নেহাত অসহায়ভাবে মেনে নিয়েছিল, এমন কথা মনে করবার কোন কারণ নেই। বস্তুত এই সংগ্রামের কোনো স্পষ্ট শূদ্ৰ-সংস্করণ ইতিহাসে টিকে না থাকলেও খণ্ডবিক্ষিপ্ত কয়েকটি তথ্য থেকে এটুকু স্পষ্টই বোঝা যায় যে, শূদ্ৰ-শ্রেণীও মাথা চাড়া দিয়ে ওঠবার চেষ্টা মাঝে মাঝে করেছিল, করেছিল বিপ্লব-ঘোষণা। এই বিপ্লবকে পরিপূর্ণভাবে ধ্বংস করা ছাড়াও শাসকশ্রেণী এ বিপ্লবের সমস্ত চিহ্ন ইতিহাস থেকে মুছে ফেলতে চেয়েছে। তবু প্ৰাচীন ইতিহাসে এ বিপ্লবের অস্পষ্ট স্বাক্ষর; ছন্দ্যোগ্য উপনিষদে জনশ্রুতি নামে শূদ্র রাজার বিবরণ, শতপথ ব্ৰাহ্মণে শূদ্র মন্ত্রীদের কথা, মৈত্রেয়ানী সংহিতায় শূদ্র ধনী ব্যক্তির উল্লেখ। গৌতম, আপস্তম্ভ, মনু প্ৰভৃতি ধর্মশাস্ত্রকাররা যে-শূদ্র সম্বন্ধে কিছুদিনের মধ্যে কঠোরতম বিধিনিষেধের ব্যবস্থা করেছিলেন, সেই শূদ্ৰকে নিশ্চয়ই আদর আপ্যায়িত করে রাজা-উজির বানানো হয়নি। তারা যদি রাজা-উজির হয়ে থাকে, তা হলে তা নিছক নিজেদের জোরেই হতে পেরেছিল। তাই এগুলিকে শূদ্রবিপ্লবের খণ্ড বিক্ষিপ্ত স্বাক্ষর বলে গ্রহণ করা যেতে পারে। সংস্কৃতির স্তরে এই বিপ্লবের প্ৰতিচ্ছবিই চাৰ্যাক-দর্শনে। এবং চার্বাক-দৰ্শন তাই প্ৰাচীন ভারতীয় শ্রেণীসংগ্রামের একমাত্র শূদ্ৰ-সংস্করণ। আরও একটা কথা এই স্বত্রে বুঝতে পারা সম্ভব। আগেই বলেছি, সুখসর্বস্ব নীতিবাদ বস্তুবাদের একমাত্র অনুসিদ্ধান্ত হতে বাধ্য নয়; মার্কস-মতে এ নীতিবাদ শুধু তারই মনের কথা হতে পারে, সমাজে যে মুখসম্ভোগের অধিকার পেয়েছে। তাই যে সব শূদ্র রাজা বা শূত্র ধনী ব্যক্তির উল্লেখ ইতিহাসে পাওয়া যায়, তাদের মুখে সুখসর্বস্ব নীতিবাদ কল্পনা করা অসঙ্গত নয়, সমাজে সুখের অধিকারী তারা নিশ্চয়ই হয়েছিল, এবং যেহেতু মূলত তারা শূদ্ৰই, সেইহেতু শূদ্ৰ-শ্রেণীর সাধারণ দর্শনের সঙ্গে তাদের ভোগবিলাসী নীতিবাদ মিশে যাবার প্রচুর সম্ভাবনা।
অবশ্যই একদিক থেকে এ সমস্ত কথাই নিছক অনুমান মাত্র, কেননা নিশ্চিত ও পৰ্যাপ্ত ঐতিহাসিক তথ্য আপাতত যেটকু সংগ্ৰহ করা সম্ভব, তা দিয়ে প্রত্যেকটি কথা প্ৰমাণ করা সম্ভব নয়। কিন্তু বৈদিক যুগের পরে ব্ৰাহ্মণরা যে একের পর এক ধর্মশাস্ত্র রচনা করে শূদ্রদের নির্মমভাবে দাবিয়ে রাখবার চেষ্টা করেছিল, সে কথাটকু নিশ্চয়ই ঐতিহাসিক সত্য। গৌতম, আপস্তম্ভ, মনু থেকে রঘুনন্দন পর্যন্ত এই প্ৰচেষ্টার ইতিহাস প্ৰসিদ্ধ ও দীর্ঘ। আপাতত তার উল্লেখ না করলেও চলবে। কেবল এই কঠোর থেকে কঠোরতার বিধানপরম্পরা সম্বন্ধে একটা প্রশ্ন না তুললেই নয়; শূদ্ৰ-বিপ্লবের পুনরুক্তি সম্বন্ধে ভয় না থাকলে শাসক শ্রেণী এমন বিচলিত মনোবৃত্তির পরিচয় দেবে কেন? চাৰ্যাক-দর্শনের উৎপত্তি সম্বন্ধে দেশে যে প্ৰবাদ প্ৰচলিত হয়েছে, তার মধ্যেও এই বিচলিত মনোভাবেরই পরিচয়। শূন্ত্রদের সমাজে দমন করেও, শূদ্রদর্শনের পুঁথি নিশ্চিহ্ন করেও পুরোহিত শ্রেণীর মনে শান্তি ছিল না। কেননা, জনগণ যেন মরেও মরতে চায় না, তাদের লোকায়ন্তিক দর্শন বারবার খণ্ডন করা হলেও এ সম্বন্ধে সম্পূর্ণ নিশ্চিত হওয়া কঠিন। দুরুচ্ছেদং হি চাৰ্যাকস্য চেষ্টতম। এই দশনকে সম্পূর্ণভাবে গ্ৰাস করবার আশাতে পুরোহিত-শ্রেণী তাই রটিয়ে দিল—সত্যি বলতে কী, ওই ভ্রান্ত দর্শন এককালে আমরাই রচনা করেছিলুম। আসলে দেবতাদের সঙ্গে তখন অসুরদের জোর লড়াই চলেছিল, অম্বরের এমন লড়াই লড়ছিল যে দেবতাদের অবস্থা প্ৰায় টলোমলে। তখন দেবতাদের গুরুদেব বৃহস্পতি এক ফন্দি আঁটলেন। এক ভ্ৰান্ত ও হেয় দর্শন রচনা করে অসুরদের মধ্যে গিয়ে সেই দৰ্শন প্রচার করে দিলেন -এই ভ্ৰান্ত দশনের মোহে পড়ে তারা ভোগ-বিলাসী হয়ে পড়ল, তার চরিত্র হারাল এবং শেষ পর্যন্ত দেবতাদের কাছে হার মানতে বাধ্য হলো।
খোদ দেবতাদের গুরুদেবের ফন্দিফিকির নিয়ে ন্যায়-অন্যায়ের প্রশ্ন তোলা সামান্য মানুষের পক্ষে নিশ্চয়ই শোভা পায় না। পুরোহিত শ্রেণী হয়তো তাই নিশ্চিন্ত ছিল, এ প্রশ্ন কোনোদিন উঠবে না। তা ছাড়া, লোকায়তে বিশ্বাস করলে লড়াইতে হার মানবার ভয় যে কেন, সে যুক্তিও সহজবুদ্ধির কাছে অস্পষ্ট। কিন্তু আসল কথা হলো, এই প্ৰবাদটির মধ্যে ব্ৰাহ্মণ-শ্রেণীর একটি আদশ পদ্ধতির পুনরুল্লেখ পাওয়া যায়। সংস্কৃতির স্তরে ব্রাহ্মণ শ্রেণী বিপক্ষকে শুধু খণ্ডন করেই ক্ষান্ত হয় না, কোনো মতে নিজের শ্রেণীর মধ্যে বিপক্ষকে শুষে নেবার চেষ্টা করে। তাই ভগবান বুদ্ধ দশ অবতারের এক অবতার হয়ে গেলেন। শুধু দর্শনের বেলাতে নয়, ব্রতের বেলাতেও একই পদ্ধতি। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর দেখিয়েছেন, কেমনভাবে দেশের ঘোষিত প্ৰচলিত বা মেয়েলি ব্ৰতগুলিকে শাস্ত্রীয় ব্রতের মধ্যে শুষে নেবার চেষ্টা করা হয়েছে। এই রকম অজস্র উদাহরণ সাহিত্যে শিল্পে দেবদেবীর কল্পনায়-সংস্কৃতির প্রায় সমন্ত ক্ষেত্রেই। অতুলচন্দ্ৰ গুপ্তর সেই ছোট্ট প্ৰবন্ধটির কথা মনে পড়ল : “গণেশ”। “সর্ববিঘ্নহর ও সর্বসিদ্ধিদাতা বলে যে দেবতাটি হিন্দুর পূজা-পার্বণে সর্বাগ্রে পূজা পান, তার ‘গণেশ” নামেই পরিচয় যে তিনি ‘গণ’ অর্থাৎ জনসংঘের দেবতা। এ থেকে যেন কেউ অনুমান না করেন যে, প্ৰাচীন হিন্দুসমাজের যারা মাথা, তার জনসংঘের উপর অশেষ ভক্তি ও প্রীতিমান ছিলেন। যেমন আর সব সমাজের মাথা, তেমনি তারাও সংঘবদ্ধ জন-শক্তিকে ভক্তি করতেন না, ভয় করতেন!…আদিতে গণেশ ছিলেন কর্মসিদ্ধির দেবতা নয়, কর্মবিঘ্নের দেবতা। যাজ্ঞবল্ক স্মৃতির মতে এঁর দৃষ্টি পড়লে রাজার ছেলে রাজ্য পায় না, কুমারীর বিয়ে হয় না…বণিক ব্যবসায়ে লাভ করতে পারে না…। এইজন্যই গণেশের অনেক প্রাচীন পাথরের মূতিতে দেখা যায় যে শিল্পী তাকে অতি ভয়ানক চেহারা দিয়ে গড়েছে; গণশক্তির উপর প্রাচীন হিন্দু সভ্যতার কর্তাদের মনোভাব কী ছিল, তা গণেশের নর-শরীরের উপর জানোয়ারের মাথার কল্পনাতেই প্ৰকাশ।” কিংবা দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর যে-রকম দেখাবার চেষ্টা করেছেন, আদিদেব মহাদেবের কল্পনাটা ব্ৰাহ্মণদের পক্ষে আদিবুদ্ধর কথা আত্মসাৎ করবার প্রচেষ্টা ছাড়া আর কিছুই নয়; ‘খৃষ্টান পাদ্ৰীরা যেমন দীক্ষিত ব্যক্তির মাথায় জল ছিটাইয়া দিয়া দলে টানিয়া লন সেইরূপ ব্ৰাহ্মণের আদিবুদ্ধের গলায় যজ্ঞোপবীতের ফাঁস নিক্ষেপ করিয়া তাঁহাকে আপনাদের দলে টানিয়া লইলেন।” তাই চতুর্মুখ ব্ৰহ্মার চারমুখ ভরা বেদ থাকলেও গলায় পৈতে নেই; কিন্তু গাঁজাখোর শিব ভূতপ্রেতের দলে নাচলেও তার গলায় পৈতে! হিন্দুসভ্যতার ইতিহাসে এমনতর দৃষ্টান্তর অভাব একটুও নেই।