চাৰ্যাকদের কথায় ফেরা যাক। বিশুদ্ধ তর্ক অপ্ৰতিষ্ঠ। অতএব, এই জড় জগতের দুৰ্নিবার যাথার্থ্যকে তর্কবলে উড়িয়ে দেওয়া কোনো কাজের কথা নয়। অপরপক্ষে, স্বৰ্গ নরক বা পারলৌকিক আত্মার কথা হাজার তর্কবলেও প্ৰমাণ করা অসম্ভব। মানতে হবে এই পৃথিবীই একমাত্র সত্য, মাটি-জল-আগুন-বাতাস দিয়ে তৈরি এই পৃথিবী। চাৰ্বাকপন্থী পঞ্চভূতের পঞ্চম ভূতকে-আকাশ বা ব্যোমকে-সত্য বলে মানেন না, কেননা আকাশ ইন্দ্ৰিয়গ্ৰাহস্থ নয় এবং ইন্দ্ৰিয়বেদনা বা অভিজ্ঞতাই জ্ঞানের একমাত্র উৎস। এই পৃথিবীর চরম সুখই আসল স্বৰ্গসুখ, এই পৃথিবীর চরম যন্ত্রণাই আসল নিরকযন্ত্রণা। মোক্ষ জিনিসটে দেহচ্ছেদেরই নামান্তর। বলাই বাহুল্য, চাৰ্বাকপন্থী দেহের অতীত আত্মা বলে কোনো জিনিস মানেন না। ওরফে তাদের নাম তাই দেহাত্মবাদী। তারা বলেন, দৈনন্দিন জীবনে মানুষ প্ৰতি পদেই দেহাত্মবাদে স্বতঃপ্ৰবৃত্ত আস্থা দেখিয়ে থাকে। মানুষ বলে; “আমি স্থূল”, “আমি কৃশ”, “আমি কৃষ্ণ”। অর্থাৎ, “আমি” জিনিসটা স্থূল, কৃশ, কৃষ্ণ প্রভৃতি দৈহিক লক্ষণ ছাড়া আর কিছুই নয়। “আমার দেহ”, এ শুধু কথার কথা, যেন “দেহ” আর “আমি” দুটো আলাদা জিনিস। এ-রকম কথার কথা, যেন “দেহ” আর “আমি” দুটো আলাদা জিনিস। এ-রকম কথা তো আমরা কতই বলে থাকি; যেমন ধরুন—“রাহুর মাথা”। আসলে মাথাই তো রাহুর সর্ব্বস্ব-মাথা বাদ দিলে রাহু বলে আর কী বাকি থাকবে? ঠিক সেই রকমই; “আমার দেহ”। দেহই আমি এবং আমিই দেহ।
প্রশ্ন ওঠে : তাহলে চেতনা বলে জিনিসটা আসলে কী? চাৰ্বাকপন্থী বলেন, চেতনা জিনিসটে কোনোরকম পারলৌকিক আত্মার বিকাশ মোটেই নয়। তাই বলে চেতনা জিনিসটাকে উড়িয়ে দেবার দরকারও নেই; জড়ের উপর তার আবির্ভাব, জড়ের দরুন তার আবির্ভাব, তবু আবির্ভাব হিসেবে অপূর্ব। তাই তার মধ্যে নতুন গুণের লক্ষণ, সে গুণ জড়মাত্রে খুঁজে পাওয়া যায় না। আশ্চৰ্য সরল উদাহরণ দিয়ে তঁরা ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিতে চান : কিশ্বাদিভ্যঃ সমেতেভ্যো দ্রব্যোভ্যো মদীশচক্তিবৎ! কিথ (সুরাবীজ) ইত্যাদি। কয়েকটি দ্রব্য একত্র মেশানোর ফলে যেরকম মদশক্তির আবির্ভাব হয়, ঠিক সেই রকমই। কিংবা, আর একটি এইরকম সরল উদাহরণ চাৰ্বাকপন্থীদের নামে প্ৰচলিত আছে : পান, চুন, খয়ের, সুপুরি -এগুলোর কোনোটার মধ্যেই টুকটুকে লাল রঙ নেই, অথচ এগুলি দিয়ে পান। সেজে মুখে দিলে পর ঠোঁটদুটি টুকটুকে লাল হয়ে যায়। লাল রঙ এল কোথা থেকে? এ রঙ পান-চুন-খয়ের-সুপুরি ছাড়া কিছুই নয়, অথচ পান-চুন-খয়েরসুপুরির উপর এক অপূর্ব আবিভােব বই কী। ঠিক তেমনি, ক্ষিতি-আপ-তেজমরুত ছাড়া মানুষ আর কিছুই নয়, তবু এই চতুভূতের এক বিশেষ সমাবেশের ফলেই মানুষের মধ্যে চেতনা বলে ওই অপূর্ব গুণের আবির্ভাব।
আধুনিক বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদী অবশ্য আলোচনা এখানেই শেষ করবেন না। তিনি দেখাতে চেষ্টা করবেন যে, যদিও জড় থেকেই চেতনার উৎপত্তি, জড়ের উপরই তার স্থিতি এবং শেষ পর্যন্ত জড়ের মধ্যেই তা বিলীন হয়ে যায়, তবুও জড়ের উপর তার যে প্রভাব, সে প্রভাবকেও অগ্ৰাহ করবার কোন উপায় নেই। কিন্তু তাই বলে সত্তার দিক থেকে চেতনার বা চিন্তার দাবিই চরম দাবি নয়; বস্তুসত্তা ন্যায়শাস্ত্রের মুখাপেক্ষী নয়, বরং ন্যায়শাস্ত্ৰই বস্তুসত্তার মুখাপেক্ষী। কিন্তু আধুনিক যুগের বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদ চাৰ্যাকপন্থীদের মধ্যে আশা করা মূঢ়তার পরিচয় হবে, তারা যে সমাজের দার্শনিক সেই সমাজের প্ৰতিচ্ছবিই তাঁদের দর্শনে।
এই কথা বিশেষ করে মনে রাখা দরকার চাৰ্যাকপন্থীদের সুখসর্বস্ব নীতিবাদ সম্বন্ধেও। চাৰ্বাকপন্থী বলেন, জড়াজগৎই যেহেতু একমাত্র সত্য সেইহেতু ইহজগতের ভোগমুখই মানুষের একমাত্র পুরুষাৰ্থ। দেহ একবার ভস্মীভূত হলে পুনরাগমনের আর সম্ভাবনাই নেই, অতএব যতদিন বাঁচা যায়, সুখে করে বাঁচার চেষ্টা করতে হবে সুনীতি সম্বন্ধে এই সুখসর্বস্ব মতবাদ। কিন্তু বস্তুবাদের একমাত্র অনুসিদ্ধান্ত নয়। বস্তুত, আধুনিক বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদ এমনতর কথা মোটেই বলে না। তবু চাৰ্বাকপন্থীর সমসাময়িক সমাজের ছবি মনে রাখলে এই সুখাবাদের ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া যাবে। মনে রাখতে হবে, এ মতবাদের প্ৰচলন হলো বৈদিক যুগের ঠিক পরেই, পুরোহিত শ্রেণী তখন অনেকাংশে দেশের শাসক-সম্প্রদায়, তাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহই চাৰ্বাক্যবাদের মূল প্রেরণা। ফলে, পুরোহিত যদি বলেন; ধার করে হোক আর যেমন করেই হোক, পিতৃশ্ৰাদ্ধের দিন পুরোহিত ভোজন করাতে ভুললে চলবে না, তার উত্তরে, চাৰ্বাকের পক্ষে বলে বসাই স্বাভাবিক : ধার করেই হোক আর যেমন করেই হোক, নিজের পেটটা আগে ঠাণ্ডা রাখাই বুদ্ধিমানের লক্ষণ! বিপক্ষদল তর্ক করতে পারেন : এ পৃথিবী শুধু দুঃখময়, তাই এখানে ভোগান্বেষণ করতে গেলে শেষ পর্যন্ত দুঃখের জালেই জড়িয়ে পড়তে হবে। চাৰ্বাকপন্থী তার উত্তরে বলেন : মাছ খেতে গেলে গলায় কাঁটা বেঁধবার ভয় নিশ্চয়ই আছে, কিন্তু তাই বলে কি মাছ খাবার চেষ্টাই করবে না?
এ কথা ঠিক যে, শুধু এইটুকু বললেই চাৰ্যাকদের মুখসর্বস্ব নীতিবাদের সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা দেওয়া হয় না। বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদের মতে মুখসর্বস্ব নীতিবাদ শুধু সেই শ্রেণীরই মুখপত্র হতে পারে, যে-শ্রেণী সমাজে মুখের অধিকার পেয়েছে। মার্কস-এর পত্রগুচ্ছ দ্রষ্টব্য। যদি তাই হয়, তাহলে চাৰ্বাকদর্শনের পেছনে সুখসম্ভোগের অধিকারী কোন শ্রেণীকে খুঁজে পাওয়া সম্ভব? চাৰ্যাকদর্শনকে জনগণের দর্শন বলেছি। তাহলে এই নীতিবাদ এল কোথা থেকে? এই নীতিবাদ বস্তুবাদমাত্রেরই অনুসিদ্ধান্তু তো নয়।