পিথাগোর-পন্থীদের দর্শনে জন্মান্তরবাদ; এ দেহটা অমর আত্মার একটা অস্থায়ী ডেরা-মাত্র। আত্মা দুদিন পরেই এ-ডেরা ছেড়ে যাবে, আশ্রয় নেবে অন্য দেহে, অন্য ডেরায়।
পিথাগোর-পন্থীদের দর্শনে পাপ-পুণ্য নিয়ে পুরোদমে আলোচনা। পাপের সম্ভাবনা থেকে মুক্তি পাবার আশায় এবং অর্জিত পাপ স্বালন করবার আশায় হরেকরকম বিধি-নিষেধের বর্ণনা।
পিথাগোর-পন্থীরা মনে করতেন, মানুদের দল ভেড়ার পালের মতো; এই পালের চরম মালিক হলেন ভগবান। তাই মানুষের উদ্দেশ্য হলো, জীবনকে পবিত্র করে তোলা, যাতে সেই মালিকের মনস্তুষ্টি হয়।
–এই সব কথাই শেষ পর্যন্ত পিথাগোরপন্থীদের দর্শনের মূল কথা। অথচ এগুলি সবই ধর্মমোহের সনাতন অঙ্গমাত্র।
তাই পিথাগোর-পন্থীদের সময় থেকেই ইওরোপীয় দর্শনের আঙিনায় ধর্মের নিশান উড়ল।
গ্ৰীক দর্শনের আদি যুগটার কথা কিন্তু অন্যরকম।
প্ৰাচীন ভারতীয় দর্শনের আদি যুগেও বস্তুবাদের কথা, আর সেই বস্তুবাদের তীব্র সংগ্ৰাম ধর্মের বিরুদ্ধে।
০৮. অকৰ্মণ্য পুরোহিতশ্রেণী
“না আছে বুদ্ধি, না খেটে খাবার মত গতর; এমনতর অকৰ্মণ্য যে পুরোহিতশ্রেণী, তাদেরই একটা হিল্লে হিসেবে রচিত হয়েছে অগ্নিহোত্র যজ্ঞের কথা, তিন তিনটে বেদ, এবং এইরকম আরও অনেক কিছু। আসলে স্বৰ্গ, অপবর্গ বা পারলৌকিক আত্মা বলে সত্যি কিছু নেই।”
ভাবতে অবাক লাগে : অন্তত আড়াই হাজার বছর আগে আমাদের দেশে এই রকম সাংঘাতিক কথা শুনতে পাওয়া গিয়েছিল। শাসক শ্রেণীর বিরুদ্ধে আক্ৰোশটা স্পষ্ট। তবু শুধু আক্ৰোশ নয়, সহজ বুদ্ধির নির্মল খণ্ডনপদ্ধতিও। চাৰ্বাকপন্থী যেমম বলেন। কর্মজীবনের কষ্টিপাথরে শাসক-শ্রেণীর দাবিগুলোকে ঘষে দেখো, দেখবে কী অসম্ভব রকমের মেকি।
“জ্যোতিষ্টম যজ্ঞে নিহত পশু যদি সোজা স্বৰ্গেই যায়, তাহলে যজমান কেন নিজের ব্যাপকে হাড়িকাঠে ফেলে না? শ্ৰাদ্ধাপিণ্ড যদি পরলোকগীত মানুষের পেট ভরাতে পারে, তাহলে কেউ বিদেশ যাবার সময় তার সঙ্গে চিড়েমুড়ি বেঁধে দেবার আর দরকার কী? (ঘরে বসে তার উদ্দেশে পিণ্ডি দিলেই তো চলা উচিত; হাজার হোক পরলোকের চেয়ে ইহলোকেরই দেশান্তর অনেক কাছে-পিঠের ব্যাপার)। কিংবা, স্বৰ্গে বসে পৃথিবীতে দেওয়া পিণ্ডে যদি কারুর সাধ মেটে, তাহলে ছাদে বসে মাটিতে দেওয়া পিণ্ডে তার পেট ভরে না কেন?’
এই যেন চাৰ্বাকপন্থীর খাঁটি দার্শনিক পদ্ধতি। কূট তর্কের দিকে ঝোঁক কম, মৌলিক চাৰ্বাক্যবাদে একান্তই তা ছিল কিনা ভেবে দেখবার কথা। কাজের ক্ষেত্রে, আটপৌরে দৈনন্দিন জীবনে যাচিয়ে দেখলেই বোঝা যাবে কোন দর্শনের কতখানি দৌড়। অবশ্য এমন খোলাখুলি এই পদ্ধতির কথা তাঁরা বলতেন কি না জানা নেই; খুব সম্ভব বলতেন না,–দর্শনের পদ্ধতি নিয়ে তখনকার দিনে আজকালকার মতো এত তর্কাতকি নিশ্চয়ই ছিল না। তা ছাড়া চার্বীক-দৰ্শনের কোনো সম্পূর্ণ পুঁথি আমাদের কাছ পর্যন্ত তো এসে পৌঁছয়নি, যদিও যে-সব খণ্ড বিক্ষিপ্ত শ্লোক আজো টিকে রয়েছে তার থেকে অনুমান করা অসঙ্গত নয় যে, কোনো-না-কোনো সময়ে এ দর্শনের উপর সম্পূর্ণ গ্ৰন্থ নিশ্চয়ই রচিত হয়েছিল। সে পুঁথি বিলুপ্ত হয়েছে। এ ঘটনাকে শুধুই শতাব্দীর শোভাযাত্রার ফল বলে বর্ণনা করা চলবে না, কেননা শতাব্দীর শোভাযাত্রা সত্ত্বেও তো প্ৰাচীনতর অন্যান্ত গ্ৰন্থ বিলুপ্ত হয়নি। বরং অনুমান করা স্বাভাবিক যে, বিজয়ী ব্ৰাহ্মণ্য শ্রেণী দেশের বুক থেকে এই সাংঘাতিক নাস্তিক্যবাদের সমস্ত কীর্তিকলাপ ধুয়েমুছে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চেয়েছিল। এই প্ৰচেষ্টার বহুমুখী স্বাক্ষর আছে। তবু এই দর্শনের যে সমস্ত টুকরো বিক্ষিপ্ত চিহ্ন আজও বর্তমান, তা থেকে এ কথা নিঃসংশয়ে বলা যায় যে, চার্বাকদের ব্ৰাহ্মণ্যবিদ্বেষ নিছক বিদ্বেষ ছিল না, রীতিমত দার্শনিক ভিত্তির উপর তার প্রতিষ্ঠা ছিল এবং বিপক্ষের বহুমুখী প্ৰচেষ্টা সত্ত্বেও এ মতবাদকে সম্পূর্ণ বিলুপ্ত করে দেওয়া কোনোদিন সম্ভব হয়নি। একথার সপক্ষে বহু প্রমাণের মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য প্রমাণ হলো মাধবাচার্যের “সর্বদর্শনসংগ্ৰহ”। প্ৰায় ছশো বছর আগে লেখা এই পুঁথি, দেশের দার্শনিক আলোচনার আসর তখনো রীতিমতো সরগরম। সংস্কৃতে লেখা ভারতীয় দর্শনের ইতিহাসের মধ্যে এ গ্ৰন্থ অন্যতম। তাই একে প্ৰামাণিক বলে না মেনে উপায় নেই। অন্যান্য আস্তিক লেখকদের মতো মাধবাচাৰ্য ঈশ্বর-বন্দনা করে গ্ৰন্থ শুরু করতে চেয়েছেন। কিন্তু এভাবে শুরু করতে গিয়েই তাঁর হুঁশ হয়েছে চাৰ্যাকদের কথা : তারা ঈশ্বর, আত্মা, পরলোক সবাই উড়িয়ে দিতে চায়। তাই, চাৰ্যাকবাদ খণ্ডন করে না নিলে ঈশ্বরস্তুতির ভিত মজবুত হয় না। এই সূত্রে মাধবাচাৰ্য একটি পরিপূর্ণ দার্শনিক মতবাদের বর্ণনা করেছেন, এমন-কী কয়েকটি শ্লোক উদ্ধৃত করেছেন, যা নাকি খোদ চাৰ্যাকপন্থীদের রচনা বলেই সাধারণত স্বীকৃত। সাধারণত এই সংক্ষিপ্ত বর্ণনাটুকুকেই চাৰ্যাক দর্শনের প্ৰধান সম্বল বলা হয়। এ ছাড়া অবশ্যই চাৰ্যাক-দর্শনের খুচরো কথাবার্তা বিভিন্ন দার্শনিকদের গ্রন্থে বিক্ষিপ্তভাবে পাওয়া যায়, কিন্তু সমস্তটাই পূর্বপক্ষ হিসেবে। এ সব থেকে অন্তত একথা নিশ্চয়ই প্ৰমাণ হয় যে, এ দর্শন সম্বন্ধে কোনো কালে কোনো সম্পূর্ণ গ্ৰন্থ লেখা হোক আর নাই হোক এবং সে-সব পুঁথি দেশের বুক থেকে বিলুপ্ত করারার জন্যে বিপক্ষ দলের চেষ্টা থাকুক। আর নাই থাকুক,- মতবাদটা দেশের দার্শনিক সমাজে এককালে রীতিমত শোরগোল সৃষ্টি করেছিল। নইলে একে খণ্ডন করবার জন্যে সমস্ত দার্শনিক দিকপালের এত মাথাব্যথাই বা হবে কেন? মাধবাচাৰ্য তো সোজাসুজি মেনে নিয়েছেন : দুরুচ্ছেদং হি চাৰ্বাকস্য চেষ্টতম্, চাৰ্বাক মত উচ্ছেদ করা নেহাত চাট্টিখানি কথা নয়।