গণিতের স্বরূপ উপলব্ধি করতে গেলে আপাতত এই রকমের একটা কথাই মনে হতে পারে, মনে হতে পারে-এ-বিজ্ঞানের আলোচ্য যে-বিষয় নিয়ে, তা বাস্তব জগতের জিনিস মোটেই নয়, বিশুদ্ধ চিন্তাজগতের জিনিস। আর তাই, দর্শন যদি গণিতশাস্ত্রের কাছ থেকে প্রেরণা পেতে চায় তাহলে দর্শনও বিশুদ্ধ চিন্ময়ের সন্ধান ছাড়া আর কী হতে পারে? আসলে কিন্তু এই মনেহওয়াটা একেবারে ভুল মনো-হওয়া। কেননা, কাণ্ট যেরকম দেখিয়েছিলেন, গণিত নিয়ে আলোচনা করতে গেলে মূর্ত জগতের অভিজ্ঞতার দ্বারস্থ না হয়ে উপায়ই নেই। কাণ্ট বলেছেন, ৫ আর ৭ যোগ দিলে যে ১২ হয়, এ-কথা শুধুমাত্র মাথা-ঘামিয়ে জানতে পারা সম্ভবই নয়। ৫-এর ধারণা আর ৭-এর ধারণা আর যোগ-চিহ্নের ধারণা-এ-সব নিয়ে আপনি যতই মাথা ঘামান না কেন, এই ধারণাগুলিকে যে-ভাবেই বিশ্লেষণ করুন না কেন, এর মধ্যে ১২-র ধারণা আবিষ্কার করা একেবারেই অসম্ভব। ১২-র ধারণা পেতে গেলে মূর্ত অভিজ্ঞতার দ্বারস্থ না হয়ে উপায় নেই; হয়তো পাঁচটা ঘুটি আর সাতটা ঘুটির যে মূর্ত অভিজ্ঞতা তার দ্বারস্থ হতে হবে। কিন্তু যেভাবেই হােক না। কেন, অভিজ্ঞতার নির্ভর একেবারে বাদ দিয়ে বিশুদ্ধ বুদ্ধির দৌলতে কখনোই জানা যায় না ৫+৭=১২। জ্যামিতির বেলাতেও তাই; জ্যামিতির গড়নগুলি নিয়ে আলোচনা করবার সময়ও মুর্ত অভিজ্ঞতার দ্বারস্থ না হয়ে কোনো উপায় নেই। তাই আঁকজোঁক করতে হয়, ছবি আঁকতে হয়।
এই হলো কাণ্টের সমালোচনা। অবশ্যই, কাণ্টের সমালোচনায় প্রধান বোকাটা হলো ইন্দ্ৰিয়-অভিজ্ঞতার দিকে; গণিত-বিজ্ঞান বিশুদ্ধ চেতনার বা শুধুমাত্ৰ বুদ্ধির উপর, মাথা ঘামানোর উপর নির্ভর করে না; তা একান্তভাবেই নির্ভর করতে বাধ্য ইন্দ্ৰিয়-অভিজ্ঞতার উপরও। কিন্তু এ সমালোচনার উপর নিভর করে আর এক-পা এগিয়ে গেলেই বুঝতে পারা যাবে, গণিতবিজ্ঞান কেন একান্তভাবেই মূর্ত আর বাস্তব পৃথিবীর মুখাপেক্ষী হতে বাধ্য। আসলে, ইন্দ্ৰিয়-অভিজ্ঞতা শূন্য থেকে স্বাক্ট হয় না; তার অনিবাৰ্য উৎস হলো বস্তু-জগৎ, মূর্ত পৃথিবী। তাই অভিজ্ঞতার উপর নির্ভর করা মানেই মূর্ত বস্তুজগতের উপর নির্ভর করা। তাছাড়া, গণিত-বিজ্ঞানের জন্ম-ইতিহাসের কথাটাও মনে রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে, বাস্তব পৃথিবীর সঙ্গে সংগ্রামের মধ্যেই এ-বিজ্ঞানের জন্ম। তাই মূর্ত্য-জগতের সঙ্গে, বস্তুজগতের সঙ্গে এ-বিজ্ঞানের ঘনিষ্ঠতা নানান দিক থেকে।
অথচ, আপাতদৃষ্টিতে তা মনে হয় না। খেয়াল থাকে না, গণিতবিজ্ঞান বাস্তব জগতের সঙ্গে কী ঘনিষ্ঠ সূত্রে আবদ্ধ। মনে হয়, বিশুদ্ধ চিন্ময় নিয়েই বুঝি তার আলোচনা। আর তাই, গণিতের কাছ থেকে প্রেরণা পেয়ে দর্শন রচনা করবার সময় দেখতে পাওয়া যায়, দার্শনিকেরা যুগে যুগে এক চরম ভ্ৰান্তির মধ্যে গিয়ে পড়েছেন। তঁরা মনে করছেন, গণিতবিজ্ঞানে যেহেতু বিশুদ্ধ চিন্ময় বিষয় নিয়ে আলোচনা এবং যেহেতু দর্শনকেও ঢালতে হবে। গণিতবিজ্ঞানের ছাচে, সেইহেতু দর্শনের বেলাতেও মূর্ত জগতটা সম্বন্ধে, বাস্তব দুনিয়া সম্বন্ধে হুশি থাকবার কথা নয়। এই জন্যেই কাণ্ট বলেছেন, গণিতবিজ্ঞান অনেক সময় দর্শনকে পথ ভুলিয়েছে, মায়া-মরীচিকা যেরকম পথ ভুলোয় পথিককে।
এ-কথায় কোনো সন্দেহ নেই যে, পিথাগোর-পন্থীদের বেলায় এইরকম একটা মন্তব্য অত্যন্ত স্পষ্টভাবে প্ৰযোজ্য। গণিতবিজ্ঞানের কাছ থেকে তাঁরা প্রেরণা পেয়েছেন, কিন্তু প্রেরণাটা বৈজ্ঞানিক প্রেরণা নয়। তাই। এই তথাকথিত প্রেরণা তাদের বিজ্ঞানের পথ থেকে সরিয়ে বিজানবিরোধী অধ্যাত্মবাদের পথে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে। এ-কথার আরো স্পষ্ট প্রমাণ হলো বিজ্ঞানের আদর্শ নিয়ে তঁদের মতবাদ। প্ৰকৃতির সঙ্গে, বাস্তব দুনিয়ার সঙ্গে সংগ্রামের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হলো বিজ্ঞান; কিন্তু পিথাগোর-পন্থীদের চেতনা থেকে সে-কথা মুছে গিয়েছিল। তাদের কাছে বিজ্ঞানের একমাত্র আদর্শ হলো আত্মাকে শুদ্ধ করবার আদর্শ। সংগীতের মতো গণিতবিজ্ঞানও চিত্তশুদ্ধির উপায় মাত্র। এমন-কী, তলিয়ে দেখতে গেলে চিকিৎসা-বিজ্ঞানের উন্ধেশ্বটাও তাই। কেননা, পিথাগোর-পন্থীদের কাছে যদিও আপাতত মনে হয় চিকিৎসা বিজ্ঞান দেহকে নীরোগ করবার উপায়, তবুও দেহকে নীরোগ করবার সবচেয়ে বড় তাগিদ হলো আত্মার জন্যে উপযুক্ত আর পরিচ্ছন্ন বাসস্থান নির্ণয় করা।
সমস্ত কিছু উদ্দেশ্যর কেন্দ্ৰ তাই আত্মা।
আত্মা নিয়ে এমনতর মাথা ঘামানো আইয়োনীয় দার্শনিকদের বেলায় মোটেই নয়। বহির্জগতের সঙ্গে মানুষের যে সংগ্রাম, অর্থাৎ মেহনত, সেই সংগ্রামে অংশীদার ছিলেন আইওনীয় দার্শনিকেরা। ফলে, তাদের সমস্যাটা বহির্জগৎকে নিয়েই। বস্তুজগতের প্রকৃত রূপ বুঝতে চেয়েছিলেন তারা। কিন্তু পিথাগোর-পন্থীদের সমস্ত উদ্দেশ্যটাই অন্তমুখী। তার কারণ, মেহনতের সঙ্গে সম্পর্ক গেছে ঘুচে, তাই সমস্যাটা বাইরের জগৎ নিয়ে নয়, মনের জগৎ নিয়ে। অর্থাৎ আত্মা নিয়ে। তার মানেই কিন্তু বিজ্ঞান ছেড়ে ধর্মের আশ্রয়ে এসে পড়ার চেষ্টা। কেননা, ধর্মের যেটা সবচেয়ে মূল কথা, সে-কথা হলো বাইরের জগৎকে বদলাবার বদলে মানস জগৎকে বদল করবার কথা।
ধর্মমোহকে পিছনে ফেলে এগিয়ে আসতে পেরেছিল বলেই আইওনীয় দর্শনের অতখানি গৌরব। সেই ধর্মমোহের কাছে ফিরে যেতে চাইল পিথাগোরাসের দর্শন। আধুনিক ঐতিহাসিকেরা তর্ক করেন, ঠিক কোন দেশের ধর্মবিশ্বাস পিথাগোর-পন্থীদের দর্শনে প্রভাব বিস্তার করছিল তাই নিয়ে। কেউ বলেন, ধর্মবিশ্বাসটার আমদানি হলো মিশর থেকে, কেউ বলেন। ভারতবর্ষ থেকে, আবার কেউ বা বলেন তা নয়, এ-ধর্ম-বিশ্বাস গ্ৰীক জমিতেই জন্মেছে, হোমার-এর চেয়ে প্রাচীন কবি আফিউস এ-ধর্মের আদিম প্ৰতিষ্ঠাতা, তাই এর নাম অফিক-ধর্মবিশ্বাস। অবশ্যই, ঠিক কোথা থেকে যে এই ধর্মবিশ্বাসের আমদানি হলো সেটা মোটেই বড় প্রশ্ন নয়। বড় কথা হলো, দর্শনের আঙিনায় এল ধর্মবিশ্বাস; বড় কথা হলো এই প্ৰতিক্রিয়ার কথাটাই।