আত্মার জন্যে চাই সংগীত, যেমন দেহের জন্যে ব্যায়াম-প্লেটোর গ্রন্থে (“রিপাবলিক”)। সক্রেটিস বলেছেন অত্যন্ত জোর গলায়! শুধু তাই নয়। প্লেটোর অপর গ্রন্থে (“ফিডো”) সক্রেটিস বলেছেন, “দর্শন হলো চূড়ান্ত সংগীত”। আধুনিক ঐতিহাসিকেরা সুনিশ্চিতভাবে বলতে চান, এ-উক্তি আসলে পিথাগোর-পন্থীদের উক্তিই। অর্থাৎ, প্লেটোর রচনায় পিথাগোরীয় চিন্তাধারার নানামুখী প্রভাবের মধ্যে এও একটা প্ৰভাব। এবং সংগীতের মূল্যাটা . পিথাগোর-পন্থীদের কাছে অমন বিরাট বলেই য়ুরোপীয় ইতিহাসে ওরাই প্ৰথম সংগীত-বিজ্ঞান রচনায়মান দেন। সংগীত সম্বন্ধের্তারা যে মতবাদ দাঁড় করিয়েছিলেন, তাঁর মূল্য নিশ্চয়ই কম নয়। কিন্তু সে-মূল্য যতখানির হোক না কেন, কর্মজীবনের হাতিয়ারের বদলে নিছক সংগীতের কাছ থেকে দার্শনিক চিন্তাধারার কাঠামো সংগ্ৰহ করবার চেষ্টাকে প্ৰতিক্রিয়ার চিহ্ন বলেই স্বীকার করতে হবে। কেননা, মনে রাখতে হবে, আদিম সাম্যজীবন শেষ হবার পর থেকেই সংগীতের সঙ্গে মুছে গিয়েছে সমবেত আবেগ-উদ্দীপনার সম্পর্ক। সংগীত-বিশেষ করে গ্ৰীক সমাজের সদর মহলে যে যন্ত্রসংগীতের সমাদর সেই সংগীত (কেননা গণ-সংগীতের কথাটা আলাদা, সমাজের নিচু স্তরটায় গণ-সংগীতের সঙ্গে আজো মেহনত-জীবনের সম্পর্ক)-পরিণত হয়েছে বিলাসী শ্রেণীর অবসর-বিনোদনে। তাই, সংগীতের কাছ থেকে দার্শনিক চিন্তাধারার কাঠামো জোগাড় করবার চেষ্টাটা মেহনত-জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হবার পরিচয়ই।
প্ৰবাদ আছে, পিথাগোরাস একবার এক কামারশালের পাশ দিয়ে -চলেছিলেন। কামারশালে হাতুড়ি পেটার শব্দ : নানান কামার নানান ওজনের হাতুড়ি পিটছে, তাই শব্দও নানান রকমের,–যেন যন্ত্রের নানান পর্দায় নানান স্বর।। থমকে দাড়ালেন পিথাগোরাস, ভাবলেন, কপালে যে এমন সুযোগ জুটে গেল তা করুণাময়ের অশেষ করুণা ছাড়া আর কী? কিন্তু সুযোগটা ঠিক কীসের? ওই নানান ওজনের হাতুড়িতে যে নানান পর্দার সুর, তাই নিয়ে পরীক্ষা করবার সুযোগ। বীণা বাজাবার সময় বিভিন্ন তারে যে বিভিন্ন পর্দার সুর, তাও কি তাহলে তারগুলোর ওজনের ওপর নির্ভর করে? এই নিয়ে গবেষণায় আত্মনিয়োগ করলেন পিথাগোরাস। প্ৰবাদটা সত্যি না মিথ্যে, তা নিয়ে আলোচনা তুলে লাভ নেই। কিন্তু এই প্রবাদটার মধ্যে পিথাগোর-পন্থীদের মেজাজটা খুঁজে পাওয়া যায়। কামারশালের পাশ দিয়ে চলেছেন দার্শনিক, কিন্তু নজরটা মেহনতের উপর নয়, কামারদের উপর নয়। এর মধ্যে যতটুকু শৌখিনতার দিক, বিলাসের দিক-শব্দের ওই ঠুং-ঠাং-টুকু –দার্শনিকের নজর শুধু তারই উপর। আইওনীয় দার্শনিকদের বেলায় মেহমন্তজীবন থেকে, মেহনতের হাতিরার থেকে-দার্শনিক চিন্তাধারার মূল কাঠামো সংগ্ৰহ করবার চেষ্টা। তাই সুস্থ বস্তুবাদের দিকে ঝোঁক; পিথাগোর-পন্থীদের মতো। রহস্যবাদ। আর অধ্যাত্মবাদের দিকে ঝোক নয়। কিন্তু বিজ্ঞান? গণিতশাস্ত্র?-এইখানে পূর্বপক্ষ একটা দারুণ আপত্তি তুলবেন। পিথাগোরপন্থীদের দার্শনিক প্ৰচেষ্টায় পিছনে গণিতশাস্ত্রের যে বিরাট প্রভাব, তাকে তো উড়িয়ে দেওয়া চলে না। পিথাগোরাস নিজে গণিতশাস্ত্রে একজন দিকপাল পণ্ডিত ছিলেন, জ্যামিতিতে তার অবদান আজও আমাদের পাঠ্যপুস্তকে পড়তে হয় (“পিথাগোরাসের থিয়োরেম”)। শুধু তাই নয়। “সংখ্যা”-কে পরম সত্য মনে করাটা থেকেই বুঝতে হবে, গণিতবিজ্ঞানের প্রেরণাই পিথাগোর পন্থীদের দার্শনিক প্রেরণার মূল উৎস। গণিতবিজ্ঞানকে তো বিজ্ঞানের মৰ্যাদা দিতেই হবে। তাই এই বৈজ্ঞানিক প্রেরণাকে উপেক্ষা না করে পিথাগোর-পন্থীদের দর্শনে শুধুমাত্র প্রতিক্রিয়ার চিহ্ন খোঁজা সম্ভব নয়।
উত্তরে বলব, গণিত-বিজ্ঞানকে তুচ্ছ করবার তাগিদটা নিশ্চয়ই ভ্ৰান্ত। কিন্তু সেইসঙ্গে এ-কথাও মনে রাখা একান্ত দরকার যে, যুগে যুগে গণিতবিজ্ঞান দর্শনশাস্ত্রের পক্ষে এক মরীচিকার সৃষ্টি করেছে। এ-কথা কাণ্ট প্রমাণ করেছেন অত্যন্ত স্পষ্টভাবে। কথাটাকে ভালো করে না বুঝলে পিথাগোর-পন্থীদের দর্শনকে ঠিকমতে যাচাই করা যাবে না।
আসলে, গণিত-বিজ্ঞানের স্বরূপ হৃদয়ঙ্গম করবার ব্যাপারে একটা মস্ত।বড় ফাকির সম্ভাবনা। কেননা, আপাত-দৃষ্টিতে মনে হতে পারে, এ-বিজ্ঞান যা নিয়ে আলোচনা করে তা বাস্তবজগতের বা মূর্তজগতের ধরাছোয়ার বাইরে, মনে হতে পারে অতীন্দ্ৰিয় বিশুদ্ধ চেতনা-গ্ৰাহ সংকেতময় সত্তাই গণিতশাস্ত্রের প্ৰকৃত আলোচ্য। যেমন ধরুন, পাটীগণিতের সংখ্যা বা জ্যামিতির গড়নগুলো। পাটীগণিত বলছে, ৫ + ৭ = ১২। কিন্তু ৫ বলে কিছু, ৭ বলে কিছু, কিংবা ১২ বলে কিছু মূর্ত জগতের কোথাও নেই; মূর্ত জগতে আছে এটা গোরু, ৫টা ভেড়া কিংবা ওই ধরনের নানান রকম জিনিস। গোরু আছে, ভেড়া আছে বাস্তব পৃথিবীতে; কিন্তু বিশুদ্ধ ৫ বা বিশুদ্ধ ৭ নেই কোথাও। অথচ পাটীগণিতের আলোচনাটা তো গোরু ভেড়া নিয়ে আলোচনা নয়; আসল আলোচনা হলো ওই বিশুদ্ধ সংখ্যাগুলি নিয়ে। এই সংখ্যাগুলির কথা আমরা বড় জোর ভাবতে পারি, এগুলি নিয়ে চিন্তা করতে পারি; কিন্তু বাস্তব জগতের কোথাও এগুলির সন্ধান ‘মেলে না। কিংবা ধরা যাক জ্যামিতিতে আলোচ্য বিষয়গুলি। বিন্দু কিংবা সরল রেখা কিংবা ত্রিভুজ। বিন্দুর শুধু অবস্থান আছে, কিন্তু দৈর্ঘ্য-প্ৰস্থ বলে কিছু নেই। এমনতর জিনিস নিয়ে মাথা ঘামানো যায়, কিন্তু এমনতর জিনিস বাস্তব দুনিয়ার কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। কিংবা ধরা যাক, সরল রেখা। তার শুধু দৈর্ঘ্য আছে, কিন্তু প্ৰন্থ বলে কিছু নেই। অথচ, বাস্তব পৃথিবীতে যত সূক্ষ্ম রেখাই আপনি আঁকুন না কেন, তার কিছু না কিছু প্ৰস্থ তো থাকতে বাধ্য। প্ৰস্থ বাদ দিয়ে শুধু দৈর্ঘ-সম্পন্ন জিনিসের কথা কল্পনা করা যায়, কিন্তু পৃথিবীর কোথাও তার চিহ্ন পাওয়া অসম্ভব। তাই জন্যেই তো জ্যামিতিতে বলে : “ধরা যাক ABC হলো একটা ত্রিভুজ”, কিংবা “ধরা যাক AB একটা সরল রেখা”। তার মানে, কাগজের ওপর আমরা যে সরল রেখাটা কিংবা যে ত্রিভুজটা আঁকছি, আসলে সেটা সরল রেখা নয় কিংবা ত্রিভুজ নয়। তাই, “ধরা যাক” বলে বলি। যেমন, একটা পেনসিল দেখিয়ে যদি বলা যায়, “ধরা যাক এটা একটা টেস্ট-টিউব”। তার মানে, পেনসিলটা টেস্ট-টিউব নয়, তবু আপাতত কাজ চালাবার আশায় ওটাকেই টেস্ট-টিউব বলে কল্পনা করবার চেষ্টা। তবু টেস্ট-টিউব বাস্তব দুনিয়ায় খুঁজে পাওয়া যায়, পাওয়া যায় না জ্যামিতির বিষয়গুলি, সেগুলি তাই একান্তভাবে বুদ্ধিগ্রাহ, বাস্তব দুনিয়ার কোনো কিছু নয়।