ভাববাদ খণ্ডন করলেন কাণ্ট । কিন্তু তারপর ? তাঁর নিজের মতবাদ ? তা নিয়ে অবশ্য টীকাকারদের মধ্যে অজস্ৰ মতভেদ আছে ; এবং মতভেদ এতই বেশি যে, তাঁদের মধ্যেই একজন, একজন শ্ৰদ্ধেয় টীকাকার, শেষ পৰ্যন্ত বিরক্ত হয়ে বলেন যে, কাণ্ট তাঁর সমসাময়িক দর্শনের যে দুৰ্গতির বর্ণনা দিয়েছেন, কাণ্ট-দর্শনের উপর টীকার দুৰ্গতি তার চেয়ে কম নয় । সমসাময়িক দর্শনের দুৰ্গতি বর্ণনা করতে গিয়ে কাণ্ট বলেছিলেন-এ যেন এমন এক মল্লক্ষেত্র, যেখানে কিনা ভুয়ো মারপিটে হাত পাকাবার দেদার সুযোগ ।
কাণ্ট-এর টীকা নিয়ে যে এত শোরগোল, তার আসল কারণ অবশ্য কাণ্ট নিজেই এক অদ্ভুত দোটানায় পড়েছিলেন। একদিকে ভাববাদ খণ্ডন করা সত্ত্বেও ভাববাদের কাছেই করুণ আত্মনিবেদন, অপরদিকে বৈজ্ঞানিক বিবেকের দংশনে অন্তত খিড়কি দোর দিয়ে বস্তুবাদের মূল কথাকে সসংকোচে আমন্ত্রণ। এক বিশেষ যুগের, এক বিশেষ সমাজের জীব হিসাবে কাণ্ট যে কেন এমন দোটানায় পড়তে বাধ্য হয়েছিলেন, সে প্রশ্নের জবাব মার্কসীয় আলোচনায় পাওয়া যায় ; কিন্তু এ-কথায় কোনো সন্দেহের অবকাশ থাকতে পারে না যে, তার দর্শনের সচেতন দিকটুকু স্পষ্টই ভাববাদী : তার মতে এই মূর্ত ও দৃশ্য জগৎ বুদ্ধি-নির্মাণ ।
কাণ্ট-এর দর্শনের ঐতিহাসিক পরিণতির দিকে চেয়ে দেখলেও বোঝা যায়, ভাববাদের প্রতি তার দর্শনের ঝোঁক কী দুর্নিবার, কত নিঃসন্দেহ ! উত্তর কাণ্টীয় দার্শনিকেরা কাণ্ট-এর দর্শনকে প্ৰতিজ্ঞ হিসেবে ব্যবহার করে একটানা এগিয়ে চললেন সোজা ভাববাদের পথে । জ্যাকবি, ফিক্টে, হাৰ্বার্ট, সেলিঙ এবং শেষ পর্যন্ত হেগেল। হেগেলের সর্বগ্রাসী পরব্রহ্ম–সে যেন এক চিন্ময়, ভয়ঙ্কর আদিম দেবতা, তার ক্ষুধা কিছুতে মিটতে চায় না, সমগ্ৰ মানব-ইতিহাসকে গ্ৰাস করবার পরও না ।
শুধু ঐতিহাসিক পরিণতির কথাই বা কেন, কাণ্ট থেকে হেগেলীয় ভাববাদে পৌঁছবার পথ যে সোজা, তার নৈয়ায়িক তাৎপৰ্যটুকুও স্পষ্ট ও প্ৰত্যক্ষ । সাম্প্রতিক পরব্রহ্মবাদীরা তাই কাণ্ট থেকেই শুরু করেন এবং শেষ করেন হেগেলে । গ্রীন, কেয়ার্ড, এমন-কী এ যুগের অতবড় ভাববাদী ব্রাডলি পৰ্যন্ত এ কথার ব্যতিক্ৰম নন।
শেষ পর্যন্ত য়ুরোপীয় দর্শনের ইতিহাসে যেন এক অসম্ভব অবস্থার সৃষ্টি হলো । হেগেলের সর্বগ্রাসী ভাববাদ দার্শনিক মহলে যেন সহজবুদ্ধি হয়ে দাঁড়াল। তাকে প্রমাণ করবার দরকার বুঝি নেই, তাকে খণ্ডন করবার অস্ত্ৰ বুঝি পাওয়া অসম্ভব। অথচ উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিক থেকে শুরু করে দার্শনিকেরা অনুভব করতে লাগলেন যে, ভাববাদের আবহাওয়ায় আধুনিক বৈজ্ঞানিক চেতনার শ্বাসরোধ হবার উপক্রম হয়েছে। তাই আবার শোরগোল পড়ে গেলা-ভাববাদকে খণ্ডন করতে হবে, যেমন করেই হোক। দেখা গেল, একের পর এক দার্শনিকের দল মেতে উঠছে ভাববাদকে খণ্ডন করবার উৎসাহে, খোলা হচ্ছে একের পর এক আক্রমণকেন্দ্ৰ । অভিজ্ঞতা-বিচারবাদ ( Empirio Criticism), প্রয়োগবাদ ( Pragmatism ), নব্য-বস্তুস্বাতন্ত্র্যবাদ ( Neo-Realism )–এইসব খাঁটি আধুনিক মতবাদ। প্ৰত্যেকটিরই একান্ত উৎসাহ ভাববাদ খণ্ডন। অথচ তলিয়ে দেখলেই বোঝা যায়, এইসব অতি-আধুনিক দার্শনিকেরা ভাববাদের বিরুদ্ধে নানা রকম কটূক্তি করবার পরও শেষ পর্যন্ত যেন গোপনভাবে ভাববাদের কথাই আত্মসাৎ করতে চাইছেন ।
অভিজ্ঞতা-বিচারবাদের প্রধান নায়ক হলেন ম্যাক । বিজ্ঞানের দোহাই দিয়ে, নানান রকম দুরূহ পরিভাষার জাদু দেখিয়ে, সাড়ম্বরে তিনি দর্শন শুরু করলেন । এতদিন ধরে চিৎ ও অচিতের মধ্যে যে দুর্লঙ্ঘ্য প্ৰাচীর গড়ে উঠেছে, তাকে ভূমিসাৎ করতে পারলেই নাকি দর্শনের আসল মুক্তি। প্ৰথম কাজ তাই মনোবিজ্ঞান আর পদার্থবিজ্ঞানের মিলন ঘটিয়ে এক বৰ্ণসঙ্করের জন্ম দেওয়া, সেই বৰ্ণসঙ্করেরই নাম হবে দৰ্শন–এবং এই দর্শন অনুসারে জড়পদার্থও পরমসত্তা নয়, মানস-পদার্থও পরমসত্তা নয়, এক তৃতীয় অপক্ষপাতী সত্তা পরমসত্তা। ম্যাক তার নাম দিয়েছেন element, অর্থাৎ মৌলিক সত্তা । অথচ, দর্শনের ক্ষেত্রে এই অভিনব নামধারী আগন্তুকটি, এই তথাকথিত তৃতীয় অপক্ষপাতী সত্তা, আসলে ভাববাদীর পুরাতন মানস-অভিজ্ঞতা ছাড়া আর কিছুই নয়। ম্যাক-প্ৰমুখের এই সাড়ম্বর অতি-আধুনিক দর্শন আসলে বার্কলির মতবাদের ওপর নতুন রঙ চাপিয়ে তাকে অভিনব দর্শন বলে চালিয়ে দেবার চেষ্টাই। লেনিন তাঁর প্রধান দার্শনিক গ্রন্থে “বস্তুবাদ ও অভিজ্ঞতা-বিচারবাদ”-এ এই বিষয়ে সুদীর্ঘ আলোচনা করেছেন । এবং এই সিদ্ধান্ত এমন নিঃসংশয়ে প্রমাণ করেছেন যে, তারপর আর তাই নিয়ে সংশয়ের অবকাশ থাকে না ।
তারপর ধরা যাক প্রয়োগবাদীদের কথা । তাঁদের দর্শনের মূল উৎসাহ যে হেগেলীয় ভাববাদের হাত থেকে নিষ্কৃতি খোঁজা, এ কথা তাঁরাই জোর গলায় জাহির করছেন। ভাববাদের হাত থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে প্রকৃত বৈজ্ঞানিক দর্শন গড়ে তুলতে হলে প্ৰথম দরকার দর্শনের মূল ভিত্তিটারই বদল করা। দর্শনকে আর শুদ্ধবুদ্ধির গজদন্তমিনারে কুমারী ব্ৰতচারিণী করে রাখলে চলবে না, তাকে নামিয়ে আনতে হবে ধুলোর পৃথিবীতে, যেখানে কাজের মানুষের কাঁধ ঘোষাঘোষি, যেখানে প্রয়োগের নগদ মূল্য চুকিয়ে তবেই কিছু কেনা-বেচা । তাই কোন বিশেষ দার্শনিক মতবাদ বা ধারণা, নিছক নিজের জোরে যথার্থও নয়, অযথার্থও নয়,–যাথার্থ্য-দাবির একটি আবেদনমাত্র। ব্যবহারিক জীবনে তার প্রয়োগবৃত্তির ওপর যাথার্থ্য নির্ভর করে ; উক্ত ধারণা বা মতবাদ যদি জীবনে সুখানুভূতির সন্ধান দেয়, তবেই তাকে যথাৰ্থ বলে মানা যাবে, যদি না দেয়, তাহলে বলতে হবে তা ভ্ৰান্ত। হাজার বাকবিতণ্ডায় যে-তর্কের মীমাংসা নেই, প্ৰয়োগের জাদুস্পর্শে নিমেষে তার মীমাংসা হয়ে যায়। এই সহজ কথাটুকু এর আগে দার্শনিকেরা ধরতে পারেননি, তার কারণ এতদিনকার একটানা বুদ্ধিবাদের মোহে তাদের দৃষ্টি আচ্ছন্ন ছিল।