মানুষের দলকে এই যে তিন ভাগে ভাগ করবার চেষ্টা, এর থেকেই বুঝতে পারা যায় পিথাগোর-পন্থীদের কাছে মেহনতের মূল্য কতখানি তুচ্ছ-কতটা হীন-হয়ে দাঁড়িয়েছে, আর তারই পাশে নিছক নির্লিপ্ত জ্ঞানচর্চার গৌরবটা কী অসামান্য গৌরবে পরিণত হয়েছে। দাস-সমাজের প্রথম পৰ্যায়ে এমনটা হয়নি, এমনটা হবার কথা ময়। কেননা, তখন পৰ্যন্ত সমাজের যারা মাথা, তারা শুধুই মাথা খাটান না, মাথার ঘাম পায়ে ফেলতেও জানেন। কারুশিল্পে, ব্যবসায়, বাণিজ্যে নানান দিকে। কিন্তু দাস-সমাজের দ্বিতীয় পৰ্যায়ে আর তা নয়; তখন থেকে মেহনতের চিহ্নই ইতর মানুষের চিহ্ন।
ফলে, পিথাগোর-পন্থীদের পক্ষে মেহনতজীবনের ছোয়াচ বঁচিয়ে নির্জনে নির্লিপ্ত জ্ঞানের চর্চাকেই পরম পুরুষাৰ্থ মনে করা স্বাভাবিকু। তাই মঠ প্ৰতিষ্ঠা, দার্শনিকদের মঠ। স্বতন্ত্র দার্শনিক গোষ্ঠী গড়বার চেষ্টা আইওনীয়দের মধ্যে ছিল না, পিথাগোরদেরই প্ৰথম। এ-চেষ্টাকে তাদের খাপছাড়া খামখেয়ালের পরিচয় মনে করলেও ভুল করা হবে। এটা আসলে মেহনতকারী জনতা সম্বন্ধে তাদের বিতৃষ্ণ মেজাজেরই পরিণামমাত্র। নিকৃষ্ট মানুষের প্রবেশ নেই এই মঠে, এখানে শুধু নিৰ্বাচিত কয়েকজন নির্মল জ্ঞানচর্চায় বিভোর হয়ে দিন কাটাবেন। অবশ্যই বিশ্বের চরম রহস্য নিয়ে তাঁরা কী কিনারা করলেন-না করলেন, তা সাধারণ মানুষকে বুঝিয়ে বলবার তাগিদ থাকবার কথা নয়; পিথাগোর-পন্থীদের মধ্যে তা ছিল ও না। বরং তাগিদটা উলটো ধরনেরই; জনগণের কাছ থেকে জ্ঞানের কথাটা গোপন করা, লুকিয়ে রাখা। তাই তাদের ভাষাটাও দুৰ্বোধ্য, সংকেতময়, রহস্যঘন। তারা ওইরকম অদ্ভুত দুৰ্বোধ্য ভাষায় নিজেদের চিন্তাধারাটুকু নিছক নিজেদের গোষ্ঠীর মধ্যে আবদ্ধ রাখতে চেয়েছিলেন বলেই আধুনিক ঐতিহাসিক অনেক চেষ্টা করেও পিথাগোরপন্থীদের বক্তব্যটার পুরো অর্থ উদ্ধার করতে পারেন না, এবং শেষপর্যন্ত যেন হাল ছেড়ে বললেন : “এখানে শুধু দার্শনিক চিত্তাকর্ষণ নয়, এমন-কী ঐতিহাসিক চিত্তাকর্ষণও যেন উপে যায়” (সোয়োগলার)। যেমন ধরুন, ওদের মধ্যে কেউ বা বলছেন “ন্যায়= ৪”, কেউ বা বলছেন “ন্যায় = ৯”;–কিন্তু ৪-ই হোক আর ৯-ই হোক, এ-সব কথার যে কী মানে, আজকের দিনে তা আমাদের পক্ষে উদ্ধার করা সম্ভবই নয়। পাটীগণিতের মুখোশ পরানো এই রহস্যবাদের অর্থ আমরা কীসের ভিত্তিতে আন্দাজ করতে পারি?
দুৰ্বোধ্য সাংকেতিক ভাষায় নির্জনে চিন্তার জাল বোনা। কিন্তু মঠগুলো শুধুমাত্র দার্শনিক চিন্তার কেন্দ্র নয়। রাজনীতির ঘাটিও। পিথাগোরাসের একটা রাজনৈতিক মতবাদও ছিল, খুব সম্ভব সংগঠনও ছিল। মঠগুলো তারও কেন্দ্র। অবশ্য এই রাজনৈতিক মতবাদটা ঠিক কেমনতর, তার সুনিশ্চিত নির্দেশ পাবার উপায় নেই, আধুনিক পণ্ডিতেরা নানান রকম অনুমানের ভিত্তিতে পিথাগোর-পন্থীদের রাজনৈতিক মতবাদটা আন্দাজ করতে চান। এবং এ নিয়ে আধুনিক পণ্ডিতদের মধ্যে মতভেদ আছে। কেউ বা মনে করেন, এই মতবাদটা ছিল সন্ত্রান্ত-তন্ত্র; মুষ্টিমেয় সম্রান্তের শাসনই সবচেয়ে ভালো। আবার কেউবা দেখাতে চেয়েছেন, পিথাগোর-পন্থীদের রাজনীতিটা ছিল গণতন্ত্র, সন্ত্রান্ত জমিদার-শ্রেণীর বিরুদ্ধে তাদের রাজনৈতিক সংগ্ৰাম।
অবশ্যই উভয় পক্ষের সিদ্ধান্তই ক্ষীণ ও ভঙ্গুর প্রমাণকে আশ্রয় করতে চায়; ধারা বলতেন পিথাগোর-পন্থীরা সম্রাপ্ত-পন্থী। আর যারা বলেন পিথাগোর-পন্থীরা গণতন্ত্রে বিশ্বাসী, তাদের উভয়েরই সপক্ষে ঐতিহাসিক সাক্ষ্য অত্যন্ত দুর্বল। তবু, পিথাগোর-পন্থীদের রাজনীতিতে প্ৰগতির চিহ্ন খোঁজবার চেষ্টাটা মোটের উপর বিজ্ঞান-বিরুদ্ধ বলেই মনে হয়। যাদের চিন্তাধারায় এবং জীবনাদর্শে প্ৰতিক্রিয়ার প্রতিটি চিহ্ন এমন প্ৰকট, তাদের রাজনৈতিক মতবাদে প্রগতির পরিচয় থাকবার কথা নয়। তাছাড়া, যদিই বা টুকরোটাকরা কিছু কিছু সূত্র থেকে অনুমান করা যায় পিথাগোর-পন্থীদের রাজনীতিতে গণতন্ত্রের দিকে ঝোঁক, তবুও মনে রাখতে হবে, এ-গণতন্ত্র সমন্ত মানুষ সম্বন্ধে প্ৰযোজ্য হতেই পারে না। সমাজের ভিত্তিতে দাস-প্ৰথা, চুড়ায় সম্রান্ত তন্ত্র আর গণতন্ত্রের দ্বন্দ্ব। তাই গণতন্ত্রই হোক আর সামন্ততন্ত্রই হোক, শাসন-কাজে ইতর মানুষের, ক্রীতদাসের কোনো অধিকার নেই। তাই, সামাজিক মেহনতের সঙ্গে পিথাগোরপন্থীদের ঠিক কেমনতর সম্পর্ক ছিল-এ-প্রশ্নের আলোচনায় তাঁদের রাজনৈতিক মতবাদটা নিছক রাজনীতির পরিভাষায় সন্ত্রান্ততান্ত্রিক না। গণতান্ত্রিক, তার হদিশ খুব বেশি আলোকপাত করতে পারবে না। পুরো সমাজের গড়নটা তখন কী-রকম, তারই মীমাংসা এই মূল প্রশ্নের উত্তর নির্ণয় করবে। মনে রাখতে হবে, পুরো সমাজের জন্যে যতখানি মেহনত দরকার তার সবটুকুর দায়ই তখন শুধু ক্রীতদাসের ঘাড়ে, তাই সামাজিক মেহনতের চিহ্নটা ইতরের চিহ্ন, মেহনতকারীরা ইতর মানুষমাত্র। পিথাগোরীয় দর্শনে এই মনোভাবের স্পষ্টতম পরিচয়।
সামাজিক মেহনত থেকে পিথাগোর-পন্থীরা কী-ভাবে যে হিটে গিয়েছিলেন, তার আরো একটা জরুরি প্রমাণ এখানে উল্লেখ করা যায়। তঁদের আগে পৰ্যন্ত-অর্থাৎ আইওনীয় দার্শনিকদের বেলায়-দার্শনিক উপমা, এমন-কী দার্শনিক চিন্তাধারার মূল কাঠামোটুকুও সংগ্ৰহ করা হতো। দৈনন্দিন কর্মজীবনের দিকে দৃষ্টি আবদ্ধ রেখে। অধ্যাপক ফ্যারিংটন দেখিয়েছেন, কেমনভাবে কুমোরের চাকা বা কামারের হাপর বা ওইরকম আরো পাঁচ রকম জিনিস থেকে গ্ৰীক যুগের আদি দার্শনিকেরা সংগ্ৰহ করতেন। চিন্তাধারার কয়েকটি মূল কাঠামো, এবং তাদের বেলায় এই ধারণাগুলি দিয়েই বিশ্বের পুরো রূপটাকে চেনবার চেষ্টা। কিন্তু পিথাগোয়-পন্থীদের বেলায় একেবারেই তা নয়। কর্মজীবনে হাতিয়ারগুলির কাছ থেকে চিন্তার কাঠামো সংগ্ৰহ করা নয়, তার বদলে সংগীতের কাছ থেকে। সংগীতের দিকে পিথাগোর-পন্থীদের নানামুখী ঝোঁক। তারা মনে করতেন সংগীতের সাহায্যে আত্মাকে সংস্কৃত আর ক্লেদমুক্ত করা সম্ভব। তখনকার কালে কোরিবাস্তিক পুরোহিতেরা সংগীতের সাহায্যে-বাশি শুনিয়ে-মনোবিকারের চিকিৎসা করার চেষ্টা করতেন : এই চেষ্টা থেকেই হয়তো পিথাগোর-পন্থীদের মাথায় আসে। সংগীতের আত্মাকে পরিশোধিত করার কল্পনা। এবং একথায় কোনো সন্দেহই নেই যে, প্লেটোর “রিপাবলিক”-এর প্রথমাংশে আদর্শ শিক্ষাপদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করবার সময় সংগীতের উপর অতখানি বোক দেবার যে-চেষ্টা, তার মূলে রয়েছে পিথাগোর-পন্থীদের প্রেরণাই।