পিথাগোর-পন্থীরা বলতেন, সংখ্যাই পরম সত্তা। এমনিতে কথাটার তাৎপৰ্য বোঝা কঠিন। কিন্তু হেগেলীয়রা বলেন, “সংখ্যা” বলে ব্যাপারটা যে আসলে কী, তা মনে রাখলে এই কথার একটা মানে খুঁজে পাওয়া যাবে। কেননা, “সংখ্যা” হলো বস্তুর অমূর্ত আর গাণিতিক রূপমাত্ৰ : ইন্দ্ৰিয় দিয়ে তাকে জানা যায় না, বুদ্ধি দিয়ে বুঝতে হয়। ইন্দ্ৰিয় দিয়ে যেটুকু জানা যায় সেটুকু বস্তুর নেহাত স্থূল, নেহাত জড়রূপ। যেমন ধরা যাক, পাঁচটা বলদের কথা। রক্তমাংসে গড়া বলদের শরীরগুলোকে আমরা চোখে দেখতে পাই, হাত দিয়ে স্পর্শ করতে পারি,-অর্থাৎ জানতে পারি। ইন্দ্ৰিয়র সাহায্যে। কিন্তু রক্তমাংসে গড় শরীরগুলো তো নেহাতই স্থূল, নেহাতই জড়জিনিস। এছাড়াও কিন্তু পাঁচটা বলদের ব্যাপারে। আর একটা দিক রয়েছে,-সেইটাই হলো। গাণিতিক দিক, যার নাম ওই “সংখ্যা”। ওই “পাচ” বলে ব্যাপারটা। পাঁচটা বলদ আমরা চোখে দেখতে পাই, কিন্তু “পাঁচ” বলে–নিছক “পাঁচ” বলে–কোনো কিছুকে আমরা ইন্দ্ৰিয় দিয়ে জানতে পারি না। সংখ্যা তাই বস্তুর অমূর্ত গাণিতিক রূপ; একে বুদ্ধি দিয়ে বোঝবার চেষ্টা করা যায়-এই রূপটা নিয়ে হিসেব করা যায়—ইন্দ্রিয় দিয়ে একে ধরাছোঁয়া সম্ভব নয়। পিথাগোর-পন্থীরা যখন এই “সংখ্যা”কে পরম সত্য বলে ঘোষণা করেন, তখন বুঝতে হবে তঁরা বস্তুর মূর্ত ও বাহরূপটাকে ছেড়ে তার অমূর্ত ও বুদ্ধিগ্রন্থ রূপটাকেই একমাত্র সত্য মনে করতে চেয়েছেন, অর্থাৎ চেয়েছেন চিন্ময়ের দিকে–চেতনকারণের দিকে–একধাপ এগিয়ে যেতে।
এই হলো হেগেল-পন্থীদের ব্যাখ্যা। কিন্তু তলিয়ে দেখলে বুঝতে পারা যায়, এ-ব্যাখ্যা আসলে কোনো ব্যাখ্যাই নয়; ব্যাখ্যার বদলে একটি বিশিষ্ট দার্শনিক মতবাদের উল্লেখমাত্র। পরব্রহ্মের লীলাখেলা নিয়ে এক বিশিষ্ট দার্শনিক মতবাদ এবং সেই মতবাদকে প্রতিষ্ঠা করবার আশায় দর্শনের ইতিহাসকে বিশেষ একরকমভাবে মোচড় দেবার প্রচেষ্টা। অবশ্যই হেগেলের প্রতিভা ছিল অসামান্য, মানব ইতিহাসের প্রায় সমস্ত অভিব্যক্তিকেই লীলাময়ের অধ্যাত্মারস দিয়ে জীৰ্ণ করে নেবার দুর্লভ মেধা। কিন্তু এ-মেধা যতই অসামান্য হোক না কেন, হেগেল বা হেগেলা-পন্থীদের রচনা থেকে এই দার্শনিক হাওয়াবদলের কোন প্রকৃত ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া যায় না; পাওয়া যায়। তার বদলে নিজেদের বিশিষ্ট দার্শনিক মতবাদ প্ৰতিষ্ঠা করবার পরিচয়।
আইওনীয় বস্তুবাদের পর পিথাগোরীয় অধ্যাত্মবাদ–দর্শনের এই দিকবদলাটুকুর বাস্তব ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া সম্ভব একমাত্র সামাজিক মেহনতের পটভূমিটা মনে রাখলে।
গ্ৰীক সমাজ ছিল দাস-সমাজ। তার মানে মেহনতের দায়টা ক্রীতদাসের উপর। কিন্তু দাস-সমাজেরও একটা ইতিহাস আছে। সে-ইতিহাসকে দুটি মোটা পৰ্যায়ে ভাগ করা চলে। প্রথম পর্যায়ে ক্রীতদাসুরা প্রধানতই গৃহস্থালির কাজে নিযুক্ত, কিন্তু সামাজিকভাবে মেহনতের পুরো দায়টা তখনো শুধু ক্রীতদাসের ঘাড়ে দেওয়া হয়নি। সামাজিকভাবে মেহনতের দায় বলতে বোঝায় পশুপালন, কারুশিল্প আর বিশেষ করে সওদাগরির জন্যে প্রয়োজনীয় মেহনত; কেননা গ্রীস দেশ রুক্ষ অনুর্বর দেশ, তাই চাষবাসের বদলে এইঃগুলির উপরই অনেক বেশি নির্ভরতা। তার মানে, দাস-সমাজের প্রথম পৰ্যায়ে ঘরকান্নার কাজকর্মের জন্যে যে-মেহনত দরকার, বিশেষ করে সেই মেহনতের দায়টা ক্রীতদাসের ঘাড়ে চাপিয়ে দেবার ব্যবস্থা। কিন্তু পশুপালন, কারুশিল্প আর বিশেষ করে সওদাগরির জন্যে যে-মেহনতের দরকার, তার পুরো দায়টা ক্রীতদাসের উপর নয়, সেখানে স্বাধীন গ্রীকদের নিজেদের মেহনতও। তাই এই যুগটায় গ্ৰীকসভ্যতার সদর মহল সামাজিক মেহনতের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েনি। ফলে দর্শন আর দার্শনিকের সঙ্গে তখনো সামাজিক মেহনতের যোগাযোগ। গ্ৰীক সওদাগরদের তখন সবচেয়ে বড়ঘাট হলো মিলেটাস শহর; কর্মমুখর এই শহরেই জন্ম হলো গ্ৰীকদর্শনের, আর গ্রীক দর্শনে যিনি আদিদার্শনিক তিনি কর্মজীবনের সাফল্যেই প্ৰাচীন যুগে সপ্তজ্ঞানীর এক জ্ঞানী বলে স্বীকৃত। কিন্তু দাস-সমাজের দ্বিতীয় পৰ্যায়ে মোটেই তা নয়; তখন থেকে যতখানি মেহনতের উপর পুরো সমাজটার নির্ভর, তার সবটুকুর দায়ই ক্রীতদাসের উপর। ফলে মেহনত পড়ল চোখের আড়ালে-কিংবা যা একই কথা, সমাজের সদর মহলের সঙ্গে মেহনতের সম্পর্ক হলো শিথিল। আর দর্শন বলে ব্যাপারটা যে-হেতু সমাজের সদরমহলেরই কীর্তি, সেইহেতু দাস-সমাজের দ্বিতীয় পৰ্যায়ে দর্শনের সঙ্গে সামাজিক মেহনতের আর সম্পর্ক রইল না।
পিথাগোরপন্থীদের দর্শন যখন পূর্ণ বিকাশ লাভ করেছে, তখন দাস সমাজের এই দ্বিতীয় পৰ্যায়। মেহনতকারী বলতে শুধুই ক্রীতদাস, অর্থাৎ একধরনের ইতর জীব। তাই মেহনত বলে ব্যাপারটাই ইতরের ধর্ম। পিথাগোর-পন্থীদের দর্শনে এই মনোভাবের স্পষ্ট পরিচয়। ওঁরা বলেন, অলিম্পিক খেলার মাঠে যে-সব আগন্তুকদের জমায়েত, তাদের দিকে একবার চেয়ে দেখুন, দেখবেন। মোটের ওপর তিন ধরনের মানুষ; কেউ বা এসেছে খেলার মাঠে কেনা-বেচা করতে, কেউ বা এসেছে প্ৰতিযোগিতায় যোগ দিতে, আর কেউ বা নিছক দ্রষ্টা, এসেছে শুধু দেখতে-কিন্তু দেখা ছাড়া কোনোরকম গতির খাটানোর মধ্যে তারা নেই। এদের মধ্যে যারা এসেছে কেনা-বেচার উদ্দেশে তারাই হলো সবচেয়ে অধম, সবচেয়ে নীচু স্তরের মানুষ। তারপর তারা, যারা প্ৰতিযোগিতায় যোগ দিতে চায়। আর যারা দ্রষ্টা, নিছক দ্রষ্টা–শুধু দেখবে, কিন্তু কোনোরকম মেহনতোরই ধারকাছ ঘেঁষবে না।–তারাই হলো সবচেয়ে সেরা ধরনের মানুষ। পিথাগোয়-পন্থীরা বলেন, এই উপমাটা মাথায় রেখে সাধারণভাবে মানবসমাজকেও বোঝবার চেষ্টা করতে হবে। তার মানে, সাধারণ মানুষকেও তিনভাগে ভাগ করা দরকার; সবচেয়ে সেরা ধরনের মানুষ হলো তারাই, যারা শুধু দ্রষ্টা, যারা ভালোবাসে শুধু নির্মল নির্লিপ্ত জ্ঞান, লাভ-লোকসানের দিকে তাদের নজর নেই, তারা নয়। যশপ্ৰাৰ্থী, তারা তাই কোনোরকম মেহনতেরই ধার ধারে না। তারপর তারা যারা গতির খাটায় যশোর আশায়, অলিম্পিক জমায়েতে খেলোয়াড়দের মতো। আর সবচেয়ে নিচু স্তরের মানুষ-সব চেয়ে হীন-সবচেয়ে অধ্যম-হলো মেহনতকারী, অর্থাৎ যারা গতির খাটায় নগদ বিদায়ের মুখ চেয়ে, অলিম্পিক খেলার মাঠে পসারীদের মতো। এইখানে মনে রাখতে হবে, বেচা-কেনায় উৎসাহী ব্যবসাদার বলতে আমরা আজকাল যে-ধরনের মানে বুঝি, গ্ৰীক সমাজে ঠিক সেই ধরনের নয়। ও-সমাজের একটা প্ৰধান নির্ভর ছিল ব্যবসাদারি। আর সওদাগরি, তাই বেচা-কেনা বলে ব্যাপারটা সামাজিক মেহনতের মস্ত বড় দিকই।