য়ুরোপীয় দর্শনে যাঁরা আদি-দার্শনিক বলে স্বীকৃত, ইতিহাসে ধাদের নামকরণ হয়েছে আইওনীয় দার্শনিক, তঁদের বেলায় সামাজিক মেহনতের সঙ্গে দর্শনের সম্পর্কটা ঘনিষ্ঠ। তাই তাদের মেজাজ চোদে আনাই বৈজ্ঞানিকের মেজাজ, তঁদের দর্শনে সুস্থ বস্তুবাদের স্পষ্ট স্বাক্ষর,-ষদিও অবশ্য উপসংহারের দিক থেকে তঁদের বক্তব্যটুকু আজকের বৈজ্ঞানিক উপসংহারের তুলনায় অনেক স্থূল, অনেক প্ৰাকৃত।
আইওনীয়দের পর পিথাগোরাস, কিংবা আরো নিখুঁতভাবে বললে বলা উচিত পিথাগোর-পন্থীদের দল। কেননা এই দলের যিনি গুরুদেবঅর্থাৎ খোদ পিথাগোরাস-তিনি নিজে কোনো দার্শনিক গ্ৰন্থরচনা করেননি, এবং গ্রীক ঐতিহ্য অনুসারে এ দর্শনের উক্তিগুলি পিথাগোর-পন্থীদের উক্তি বলেই উল্লিখিত হয়েছে। যেমন ধরা যায়। এ্যারিস্টটুল-এর কথা। তার গ্রন্থে পূর্বদার্শনিকদের বর্ণনা করবার সময় তিনি কোনো কথাকেই পিথাগোরাসের একার কথা বলে উল্লেখ করেননি, বারবার উল্লেখ করছেন পিথাগোরপন্থীদের কথা হিসেবে। তবু পিথাগোরাসের ব্যক্তিগত প্ৰতিভা নিশ্চয়ই অসামান্য ছিল, দর্শনের ঐতিহাসিকেরা প্ৰায় একবাক্যে স্বীকার করেন, প্রাচীন ইতিহাসে এমনতর প্রতিভার নমুনা অত্যন্ত বিরল। অথচ, পিথাগোরাসের জীবনচরিত বলতে মাত্র দু’চারটে টুকরো কথা টিকে রয়েছে। সামস দ্বীপে তার জন্ম, কিন্তু ওখানে পলিক্রিটিসের শাসন অসহ জ্ঞান করায় তিনি ৫৩৫ খ্ৰীষ্টপূর্বাব্দে দক্ষিণ ইতালিতে গিয়ে আশ্রয় গ্ৰহণ করেন। অনুমান, তখন তার বয়েস বছর চল্লিশ। দক্ষিণ ইতালিতে ক্রোটন নামের জায়গায় তিনি তাঁর মঠ স্থাপন করেন, এবং ক্রমশ গড়ে ওঠে এ-মঠের নানান শাখা। মনে রাখতে হবে, পিথাগোর-পন্থীদের মঠ শুধুমাত্ৰ সাধন ভজন বা দার্শনিক ধ্যানধারণার কেন্দ্র ছিল না, ছিল ওঁদের বিশিষ্ট রাজনীতির ঘাঁটিও। ফলে, তাদের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীও ছিল। এবং এই প্ৰতিদ্বন্দ্বীদের সঙ্গে সংঘর্ষের দরুনই বৃদ্ধ পিথাগোরাস শেষ পর্যন্ত প্ৰাণ নিয়ে মেটপন্টিয়ন্-এ পলায়ন করেন; সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীরা তাঁর ওই মঠ এবং মঠের বহু শাখা ধ্বংস করেছিল, এমন-কী খুন করেছিল তাঁর বহু শিষ্যকেও। পিথাগোরাসের জীবন সম্বন্ধে ঐতিহাসিক তথ্য মোটের ওপর এইটুকুই। আরো কিছুটা আন্দাজ করা সম্ভব তাঁর দার্শনিক মতবাদের বিশ্লেষণ থেকে।
দর্শন হিসেবে, পিথাগোর-পন্থীদের দর্শনে প্ৰতিক্রিয়ার প্রায় প্রতিটি লক্ষণ স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে; রহস্যবাদ। আর অধ্যাত্মবাদ, বস্তুবাদ ছেড়ে ভাববাদ, স্বাস্থ বিজ্ঞানের পথ ছেড়ে ধর্মমোহের পথ। তাই আইওনীয়দের তুলনায় এক আমূল পরিবর্তন। দর্শনের ইতিহাসকে বুঝতে হলে এই পরিবর্তনের একটা ব্যাখ্যা পাওয়া চাই। য়ুরোপীয় দর্শনের যে-সব সাবেকী ইতিহাস, সেই সব ইতিহাসে এই পরিবর্তনের প্রকৃত গুরুত্ব অনুভূত হয়েছে কি না, তা-ই সন্দেহের কথা। অথচ পরিবর্তনটা যে কতখানি গুরুত্বপূর্ণ তা শুধু একটা ব্যাপার থেকেই আন্দাজ করা যায়। এখান থেকে গ্ৰীক চিন্তাধারায় যে সংকট দেখা দিল, তার পরিণামে গ্ৰীক যুগের যিনি সবচেয়ে দিকপাল দার্শনিক বলে সাধারণত স্বীকৃত হন-অর্থাৎ প্লেটো-তার দর্শনে প্ৰতিক্রিয়ার সবচেয়ে চরম চিহ্ন। দ্বিতীয়ত, দর্শনের সাবেকী ইতিহাসগুলিতে এই পরিবর্তনের যেটুকু বা ব্যাখ্যা, তাও মোটেই সন্তোষজনক নয়। ব্যাখ্যাটা মোটের উপর দুরকমের। এক রকমের ব্যাখ্যা হলো, নিছক মজি-রুচির দিক থেকে ব্যাখ্যা; পিথাগোরাসের মজি ও রুচি অন্য রকমের ছিল, তাই তাঁর দর্শনটাও অন্য রকমের। অথচ, এটা তো কোনো ব্যাখ্যাই নয়, মূল সমস্যার বর্ণনামাত্র। কেননা আসল সমস্যা হলো; একটা বিশেষ যুগে চিন্তাশীলেরমর্জি-রূচিতে আমন আমূল পরিবর্তন দেখা দেয় কেমন করে? দার্শনিককে নিছক খেয়ালখুশির কারবারি মনে করলেও তার খেয়ালখুশির রকম-ফেরকে কোনো একটা নিয়ম দিয়ে বোঝাবার চেষ্টা করতে হবে তো, তা নইলে যে পাগলা ঘোড়ার পাগলামির সঙ্গে দার্শনিক যুগপরিবর্তনের কোনো তফাত থাকে না।
দর্শনের সাবেক ইতিহাসগুলিতে আর একরকম ব্যাখ্যা হলো হেগেলপখীদের ব্যাখ্যা। এই ব্যাখ্যা অনুসারে, সব কিছুই লীলাময়ের লীলা, পরব্রহ্মের আত্মবিকাশ। সে আত্মবিকাশের অবশ্য একটা নিয়ম আছে, ক্ৰম আছে। দর্শনের ইতিহাসে যে ক্ৰমবিকাশ, তা এই নিয়মেরই প্ৰতিবিম্বমাত্র। হেগেলপন্থীরা বলেন, প্ৰথম স্তরে লীলাময় নিজেকে বিকশিত করেন স্থূল ও মূর্ত বহির্বস্তু হিসেবে, তার পর ক্রমশ সূক্ষ্মর দিকে, চিন্মেয়ের দিকে অগ্ৰগতি। তাই, দার্শনিক চেতনার আদিতেও স্থূল ও মূর্ত বহির্বস্তুকে পরমসত্য বলে চেনবার প্রয়াস : আইওনীয় দার্শনিকেরা কেউ বা জলকে, কেউ বা পদার্থের প্ৰাকৃত প্ৰলয়কে, কেউ আবার বায়ুকে পরম সত্যের সম্মান দিতে চাইলেন। কিন্তু জলই হোক আর বায়ুই হোক, মনে রাখতে হবে সব কিছুই স্থূল বহির্বস্তু, জড়। দ্বিতীয় যুগটায়, হেগেল-পন্থীদের মতে, মানুষের দার্শনিক চেতনা আর এক ধাপ এগিয়ে এল। বস্তুজগৎকে, জড়কে একেবারে বর্জন করা যদিও সম্ভব হলো না, তবুও বস্তুজগতের স্থূল ও মূর্ত রূপটাকেই একমাত্র সত্য বলে মেনে নেওয়াও নয়। তার বদলে, বস্তুজগতের সূক্ষ্ম, অমূর্ত গঠনের দিকটাকেতার গাণিতিক লক্ষণকে-পরম সত্য বলে চেনবার প্রয়াস। জড়কে ছেড়ে আসা, যদিও কিনা জড়ের উপরে খানিকটা নোঙর থেকে গিয়েছে। হেগেলীয়দের এই ব্যাখ্যাটা প্ৰথমে স্পষ্টভাবে বোঝবার চেষ্টা করা হোক, তারপর দেখা যাক ব্যাখ্যা হিসেবে এটা কতখানি টিঁকসই।