খ্ৰীষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীর আইয়োনিয়ায় তখন রাজনৈতিক শক্তি অনেকাংশেই এসেছে সওদাগর শ্রেণীর হাতে। এই সওদাগর শ্রেণী বিজ্ঞানের উন্নতি দিয়ে পৃথিবীকে আরো ভালো করে জয় করতে চায় এবং নিজেরাও অংশ গ্ৰহণ করে সামাজিক মেহনতে; দাসপ্রথা তখন এমন অবস্থায় পৌঁছয়নি যে, মেহনতজীবনকে ঘূণার চোখে দেখতে শেখার অভ্যাস। এই আইয়োনিয়ার সবচেয়ে কর্মমুখর শহর হলো মিলেটাস। সেই মিলেটাস শহরে সওদাগর শ্রেণীর একজন হলেন ইওরোপের প্রথম দার্শনিক, থ্যালিস। আর তাই তার কাছে ধর্মমোহটা প্রয়োজনীয় নয়, ধর্মমোহের চেয়ে অনেক বেশি প্রয়োজন বিজ্ঞানের। আর তাই বিশ্বের রহস্য বোঝবার আশায় তিনি ধর্মমোহের দ্বারস্থ হতে রাজি নন, তার বদলে দ্বারস্থ হতে চাইলেন বিজ্ঞানের কাছে। ফলে বিশ্বের রহস্যবর্ণনায় স্ৰষ্টা মাদুক-এর স্থান রইল না। থ্যালিস বললেন, এই বাস্তব দুনিয়ারই একটি পদার্থ–জল, শুধু জল, আধ্যাত্মিক কোন কিছু নয়–পরম সত্য।
কর্মজীবনের সঙ্গে, বিজ্ঞানের সঙ্গে থ্যালিসের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগই তাকে বস্তুবাদী করে তুলেছিল, কিংবা, যা একই কথা, তার মনকে অধ্যাত্মবাদ বা ভাববাদের মোহ থেকে সরিয়ে আনল। এর দরুনই তার আদি-দার্শনিকের গৌরব। অবশ্যই তখনকার দিনে বিজ্ঞানের যতটুকু উন্নতি, তার ভিত্তিতে বস্তুজগতের পরম সত্তাকে সঠিকভাবে শনাক্ত করবার সম্ভাবনা নেই, থ্যালিস তা পারেননি,–থ্যালিসের কাছে তা আশা করবার কথাও নয়। তবু, যেটা আসলে অনেক বড় কথা, এইভাবে শনাক্ত করবার চেষ্টা দেখা দিল থ্যালিসের মধ্যে, এবং এই চেষ্টাই তাঁর পরে কিছুদিন পর্যন্ত গ্ৰীক দৰ্শনকে সঞ্জীবিত করে রেখেছিল।
থ্যালিসের পর এ্যানেক্সিমেণ্ডার, তার পর এ্যানেক্সিমেনিস। ঐতিহাসিকেরা বলেন, এ্যানেক্সিমেণ্ডার খুব সম্ভব। থ্যালিসের সমসাময়িক ছিলেন, কিংবা তার শিষ্য ছিলেন। এ্যানেক্সিমেণ্ডারের সঙ্গে এ্যানেক্সিমেনিসের সম্পর্কটাও এই রকমেরই। এরা দুজনেও ওই একই শহরের বাসিন্দা, একই সামাজিক পরিবেশের মানুষ। এবং দার্শনিক হিসাবে এদের দুজনের চেষ্টাও একই। রকম : বস্তুজগতের মধ্যেই পরম সত্তার প্ৰকৃত রূপকে শনাক্ত করবার চেষ্টা। এ্যানেক্সিমেণ্ডার “জল’ নামের স্থূল বস্তুকেই পরম বস্তু বলে মেনে নিতে রাজি নন। বস্তুজগতের মধ্যে তিনি এমন এক সুক্ষ্ম বস্তুকে পরম সত্তা মনে করতে চান, যার থেকে ক্ষিতি অপ, তেজ আদি সব রকম স্থূলভূত বা স্থূল বস্তুর উৎপত্তি। এই জাতীয় সূক্ষ্মভুত বা সূক্ষ্ম বস্তুর তিনি নাম দিলেন ‘অনন্ত, অসীম, অবৰ্ণনীয় বস্তু, যার থেকেই কালে সব কিছুর জন্ম এবং যার মধ্যেই কালে সব কিছু বিলীন হয়ে যায়। অর্থাৎ, তাঁর মতে, এক আদিম অবর্ণনীয় সূক্ষ্মভুতই পরম সত্তা। কেবল মনে রাখতে হবে, এই পরম সত্তাটি আধ্যাত্মিক কিছু নয়, নেহাতই বাস্তব জিনিস, জড় জগতের পদার্থ।
কিন্তু এই জাতীয় বস্তুকে পরম সত্তা বলতে গেলে কথাটা যেন বড় বেশি। ধোঁয়াটে হয়ে যায়। বস্তুবাদীর পক্ষে মূর্ত বস্তুর দিকে আকৃষ্ট হবার তাগিদ। রয়েছে। অথচ মূর্ত বস্তু হিসাবে ‘জল’-এর মতো একটা কিছুকে সব কিছুর মূল সত্তা বলে মেনে নেওয়াও যেন স্থূল কথা। এ্যানেক্সিমেনিস। তাই যেন দুয়ের মধ্যে মিল ঘটাবার চেষ্টা করে বললেন : “বায়ু হলো পরম পদার্থ। হাওয়া জিনিসটা মূর্ত, তবু সূক্ষ্ম। তা-ই। আর হাওয়া যে বস্তুজগতেরই জিনিস, অধ্যাত্মজগতের কিছু নয়, এ কথা তো স্পষ্ট কথা।
মোটের উপর বস্তুজগতের ঠিক কোন জিনিসটিকে পরম সত্তা হিসাবে এরা শনাক্ত করবার চেষ্টা করেছিলেন, সেইটা বড় কথা নয়। বড় কথা হলো এদের বস্তুবাদ, বিজ্ঞানের আলোয় বিশ্বব্রহস্যের সমাধান করবার চেষ্টা, পৌরাণিক চিন্তাধারা আর ধর্মমোহকে পিছনে ফেলে এগিয়ে আসবার আয়োজন।
সকলেই মিলেটাস শহরের বাসিন্দা বলে এদের দর্শনকে অনেক সময় মিলেসীয় দর্শন বলা হয়। আবার আইয়োনিয়ার নাম থেকে এঁদের দর্শনের নামকরণ হয়েছে আইয়োনীয় দর্শন। এই আইয়োনীয় দর্শনই ইওরোপীয় দর্শনের আদি পর্যায়। মনে রাখতে হবে, এ দর্শন বস্তুবাদী, বিজ্ঞান আর সামাজিক মেহনতের সঙ্গে সম্পর্কের জোরেই তা সম্ভব হয়েছিল।
০৭. দর্শনের ইতিহাস বিচার
দর্শনের ইতিহাস বিচার করলে দেখতে পাওয়া যায়, সামাজিক মেহনতের সঙ্গে দর্শনের সম্পর্ক যখন ঘনিষ্ঠ তখন দর্শনে প্ৰগতির চিহ্ন : সুস্থ আর বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদের দিকে ঝোঁক। কিন্তু এ সম্পর্ক যখনই শিথিল হয়েছে, তখনই দর্শনে ফুটে উঠেছে প্রতিক্রিয়ার প্রতিটি লক্ষণ : অধ্যাত্মবাদ। আর রহস্যবাদ, বৈজ্ঞানিক মেজাজের বদলে ধামিক মেজাজ, বস্তুবাদের বদলে ভাববাদ। এমনটা না হয়ে উপায়ও নেই। কেননা, একমাত্র মেহনতের মধ্যে-প্ৰয়োগজীবনের মধ্যে-হৃদয়ঙ্গম হয় বহির্বস্তুর অবধারিত যাথার্থ। কামারশালে লোহা পেটবার সময় কামার বোঝে-হাড়ে হাড়ে বোঝে—লোহা জিনিসটা স্বপ্ন নয়, মায়া নয়, মতিভ্রুমও নয়। তার বদলে এক ধরনের সত্যি জিনিস, যার বাস্তবতা দুর্ধর্ষ। তাই সমাজের সদর মহল থেকে মেহনতের সবটুকু ইজ্জত যদি মুছে যায়, তাহলে সেই মহলের চেতনায় বহির্জগতের এই যাথার্থ কীসের নির্ভরে টিকে থাকবে? মানুষের যে-হাত দুনিয়ার সঙ্গে সংগ্রামে প্ৰবৃত্ত সেই হাত যখন চোখের আড়ালে পড়ল, তখন যে-দুনিয়ার সঙ্গে সংগ্রাম সেই-দুনিয়ার কথাটাও ঝাপসা হয়ে আসবে না কি? বাকি থাকবে শুধু চেতনা–শুধু নিৰ্মল, নিরাবলম্ব, বিশুদ্ধ চেতনা। কেননা, মাথার ঘাম পায়ে ফেলবার তাগিদযখন নেই, তখন শুধুই মাথা-ঘামানো, তারই নাম হলো চেতনা। আর তাই, তখন মানুষের মনে এ-অভিমান জাগাই খুব স্বাভাবিক যে তার এই চেতনা বুঝি সর্বশক্তিমান, সর্বশক্তির আধার। এই অভিমানটাই হলো চেতনকারণবাদ বা অধ্যাত্মবাদ বা ভাববাদের আসল ভিত্তি।