এই হলো আদিম সভ্যতাগুলির আসল চেহারা। এ সভ্যতায় জ্যোতিষ বা জ্যামিতির জন্ম সম্ভব, কিন্তু বিজ্ঞানের আলোয় বিশ্বরহস্যকে বোঝবার অবসর নেই। জমির মাপজোখ করবার কাজে দরকার জ্যামিতি, শুবু আদায়ের কাজে দরকার পাটীগণিত, দিনক্ষণ আর সন-তারিখের খেয়াল রাখবার কাজে দরকার জ্যোতির্বিদ্যা; এইরকম আরো কিছু কিছু। কিন্তু—আর এইটেই খুব বড় কথা–এ সভ্যতায় এই জাতীয় জ্ঞানের যে-রকম চাহিদা, সেইরকমই চাহিদা হলো ধর্মমোহের গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ রাখা। কেননা, এ-সভ্যতাকে টিকিয়ে রাখার জন্যে একান্ত দরকার ওই ধর্মমোহ, অন্ধ সংস্কার, পৌরাণিক বিশ্বাস। এ-সমাজ এমন সমাজ নয়, যেখানে সুস্থ বুদ্ধি দিয়ে, বিজ্ঞানের অভিজ্ঞতা দিয়ে বিশ্বরহস্যের সমাধান-প্ৰচেষ্টাকে উৎসাহ, এমন-কী আমল, দেওয়া সম্ভব; তাতে কেন্দ্রীয় শাসকের অসীম দাপটট ক্ষুব্ধ হবার ভয়, ভয় জনজাগরণের। “খ্ৰীষ্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীর এক মার্জিত গ্ৰীক চিন্তাশীল মিশরের শাসক-স্বীকৃত ধর্মের দিকে চেয়ে দেখছেন আর আবিষ্কার করছেন। এর সামাজিক প্রয়োজনীয়তা। তিনি বলছেন, মিশরের আইনকর্তা এত সব নোংরা কুসংস্কার সৃষ্টি করেছিল, তার কারণ প্রথমত, তার ধারণায় উপরওয়ালার যে-কোন আদেশ জনগণ যাতে স্বীকার করে নেয়। সেজন্যে তাদের অভ্যস্ত করা দরকার, আর দ্বিতীয়ত তার মনে হয়েছিল, যাদের মনে ধর্মভাব অন্যান্ত সব ব্যাপারে মনকে আইনের অনুগত করেছে তাদের উপর সহজে নির্ভর করা সম্ভব।”
তাই আদিম সামন্ত সভ্যতায় নিছক কৃষিকাজের তাগিদে যে-রকম কয়েকটি বিদ্যার দরকার, সেইরকমই দরকার হলো সংস্কারের, ধর্মমোহের। তাই বিশ্বের রহস্যটা পুরাণের আলোতেই বোঝবার সুযোগ, বিজ্ঞানের সঙ্গে তার মুখ দেখাদেখি নেই।
কিন্তু গ্রীকদের বেলায় অন্য রকম।
প্রথমত, গ্ৰীস-এর প্রাকৃতিক অবস্থাটা অন্য রকম। অনুর্বর দেশ। মিশর বা মেসোপটেমিয়ার বড় নদীর কিনারায় যে-রকম সহজে চাষবাস করা সম্ভব, গ্রীসের জমিতে বা গ্ৰীক উশনিবেশগুলির জমিতে মোটেই তা নয়। আর তাই গ্রীকদের মধ্যে শুরু থেকেই চাষ-বাসের চেয়ে পশুপালনের দিকেই ঝোক অনেক বেশি। তারপর, সওদাগরির দিকে ঝোক। এশিয়াটিক সামন্ত সভ্যতায় সওদাগর যে ছিল না, তা নিশ্চয়ই নয়, কিন্তু সওদাগররা সভ্যতার সদর মহলে খুব বেশি প্রতিপত্তি পায়নি। তারা ছিল সামন্তদের আশ্ৰিত; নিজেদের যাতে আরো টাকাকড়ি জোটে, এই উদ্দেশ্যেই সামন্তরা সওদাগরদের কাজে লাগাত, একটু-আধটু প্রশ্ৰয়ও দিত। কিন্তু গ্ৰীক দেশে সওদাগরিটাই প্ৰধান হয়ে দাড়াল, আর তাই এখানে সওদাগর শ্রেণী বলে একটা আলাদা সামাজিক শ্ৰেণী গড়ে উঠতে লাগল। সওদাগরদের এই প্ৰতিপত্তির মূলেও আসল কারণ কিন্তু দেশের প্রাকৃতিক অবস্থা : ওখানে পাহাড়ী জমিতে নানান রকম ধাতু, তাই দিয়ে নানান রকম জিনিস তৈরি করে রপ্তানি করবার সুযোগ। তাছাড়া, শ্বেতপাথর, কাঠ, জলপাই তেল, বাসন গড়বার জন্যে একরকম ভালো মাটি ইত্যাদি অনেক কিছুর জোগান। গ্রীসের মাটি অনুর্বর বলে যে-রকম চাষবাসের উন্নতি কম, সেইরকমই এই সব জিনিসের প্রচুর জোগান বলেই এখানে ব্যবসা-বাণিজ্য গড়ে ওঠবার ঢালাও সুযোগ,–আর তারই দরুন বণিক শ্রেণীর সামাজিক প্ৰতিপত্তি।
বণিক শ্রেণীর কথাটা ভালো করে বুঝতে হবে। গ্ৰীক সভ্যতায়, অন্তত গ্ৰীক সভ্যতার প্রথম দিকে, বণিক শ্রেণী বলতে নেহাতই পরিশ্রমজীবী মুনাফাখোর কোনো শ্রেণীকে নিশ্চয়ই বোঝাত না। এই শ্রেণী সামাজিক মেহনন্তের ক্ষেত্রে অংশ গ্ৰহণ করেছে অত্যন্ত স্পষ্টভাবেই। প্ৰকৃতিকে বেশি। করে, ভালো করে জয় করবার উপরই তাদের সম্পদ নির্ভর করেছে, আর প্ৰকৃতিকে জয় করবার যে কৌশল তারই নাম যে-হেতু বিজ্ঞান, সেইহেতু বিজ্ঞানের অগ্রগতির সঙ্গে এই বণিক শ্রেণীর স্বাৰ্থ অত্যন্ত স্পষ্টভাবে জড়িত। তাছাড়া, মনে রাখতে হবে, গ্ৰীক সভ্যতার গোড়ার দিকে (“গ্রীক আদিযুগের শেষের দিকে”) অভিজাত শ্রেণীর সঙ্গে সাধারণ জনগণের যে-সংগ্ৰাম, সেই সংগ্রামে সওদাগর শ্রেণী জনগণের তরফে অধিনায়কত্ব করেছে। তাই তখন পৰ্যন্ত, সওদাগর শ্রেণী বলতে সামাজিক অর্থে নানান দিক থেকে এক প্ৰগতিশীল শ্রেণীকেই বোঝায়। অবশ্যই, গ্ৰীক সভ্যতার ভিত্তিতে দাস প্ৰথা : পয়সা দিয়ে মানুষ কিনে তাদের অমানুষিক পরিশ্রম করানো আর তাদের মেহনত দিয়ে তৈরি জিনিস মালিকদের ভঁড়ারে গেলবার ব্যবস্থা। দাসসমাজ,-পরিশ্রমজীবী সমাজই। কিন্তু, মনে রাখতে হবে, দাস-সমাজেরও একটা ইতিহাস আছে। গ্ৰীক সভ্যতার শুরু থেকেই দাস-সমাজের পরোপজীবী মূর্তি প্রকট হয়ে পড়েনি। দাস-প্রথার ইতিহাসকে মোটের উপর দুটো যুগে ভাগ করা যায়; প্রথম যুগটায় ক্রীতদাসদের শুধু গৃহস্থালির কাজে, অর্থাৎ চাকরিবাকির হিসাবে, নিয়োগ করা; অর্থাৎ সামাজিক মেহনন্তের যেটা প্ৰধান দায়িত্ব, সেটা তখন পর্যন্ত শুধু ক্রীতদাসদের কাধে চাপিয়ে দেবার ব্যবস্থা নয়। দ্বিতীয় যুগটায় দেখা দিয়েছে এই ব্যবস্থা, গ্রীকরা তখন নেহাতই পরশ্রমজীবী হয়ে দাঁড়িয়েছে।
গ্ৰীক দর্শনের ইতিহাস আলোচনায় দেখতে পাওয়া যায়, দাস-সমাজের প্ৰথম স্তরটা ছেড়ে যতই তারা দ্বিতীয় স্তরটার দিকে এগিয়েছে, ততই ওদের দর্শনে ফুটে উঠেছে শৌখিন চিন্তা-বিভোরতার লক্ষণ। কিন্তু থ্যালিস যে সময়টার দার্শনিক, যে সামাজিক পরিস্থিতির সঙ্গে এবং যে সামাজিক শ্রেণীর সঙ্গে তার যোগাযোগ, তা দাস,সমাজের প্রথম দিককার কথা।