আসলে, ব্যক্তিগত প্ৰতিভা বা জাতিগত বৈশিষ্ট্য দিয়ে ঐতিহাসিক সমস্যার কিনারা করা যায় না। কেননা, তাতে শেষ পর্যন্ত কোনো-না-কোনোভাবে রহস্যকেই মেনে নিতে হয়। গ্রীকদের জাতিগত বৈশিষ্ট্য নিশ্চয়ই ছিল, থালিসের নিশ্চয়ই ছিল অসামান্য প্ৰতিভা। কিন্তু প্রশ্ন হলো, গ্রীকদের এমনতর বৈশিষ্ট্য সম্ভব হলো কী করে? কী করে সম্ভব হলো থ্যালিসের এই প্ৰতিভা ঠিক এই পথে প্রবাহিত হওয়া? থ্যালিসের ব্যক্তিগত প্ৰতিভা তো প্রাচীন ধর্মমোহকে আরো মজবুত ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠা করতেও পারত। আমাদের দেশের জনৈক চিন্তাশীলের সঙ্গে তুলনা করলে এই সম্ভাবনার কথাটা আরো স্পষ্টভাবে বুঝতে পারা যাবে। আচাৰ্য শঙ্করের ব্যক্তিগত প্ৰতিভাও তো খুবই অসামান্য। তবু, অতখানি প্ৰতিভার গতি কী হলো? ব্রাহ্মণ্য সংস্কারের পায়ে আত্মনিবেদন : ধর্মমোহের পুরো কাঠামোকে নির্বিবাদে মেনে নিয়ে শ্রুতিস্মৃতির কথাগুলিকেই সবচেয়ে দুর্ধর্ষ যুক্তির ভিত্তিতে প্ৰতিষ্ঠা করার চেষ্টা! থ্যালিসের বেলায় মোটেই তা নয়। কেন নয়? এ-প্রশ্নের জবাব শুধু তার ব্যক্তিগত প্ৰতিভায় খুঁজে পাওয়া যায় না।
অবশ্যই, বিধাতার লীলাখেলা দিয়ে, তার খেয়ালখুশি বা আত্মবিকাশের একটা উপকথা সৃষ্টি করে পৃথিবীর সব সমস্যার একেবারে নিরাপদ আর নির্বিবাদ সমাধান নিশ্চয়ই করে দেওয়া যায়। ইতিহাস-বিচারে যেমনটা করে। থাকেন দার্শনিক হেগেলের ভক্তরা। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এই সমাধান আমাদের বৈজ্ঞানিক বিবেককে কিছুতেই তুষ্ট করতে পারে না। পাকা ফলটা মাটির দিকে কেন পড়ল-এই প্রশ্নের উত্তরে নিশ্চয়ই বলা চলত; করুণাময়ের ইচ্ছে, তাই। কিন্তু উত্তরটা নিউটনের বৈজ্ঞানিক বিবেককে তুষ্ট করতে পারেনি। কেননা, বিজ্ঞান হলো বাস্তবপরায়ণ। বাস্তব দিয়ে ব্যাখ্যা না হলে আমাদের বৈজ্ঞানিক বিবেক কখনোই খুশি হতে পারে না। ইতিহাসের বেলাতেও একই কথা। কোনো ঐতিহাসিক ঘটনার ব্যাখ্যা খুঁজতে হলে যতক্ষণ না বাস্তব বিষয় দিয়ে এই ব্যাখ্যা দেওয়া যায়, ততক্ষণ আমাদের বৈজ্ঞানিক চেতনা তুষ্ট হতে পারে না।
এই দাবির দরুনই সম্ভব হয়েছে ইতিহাসের বাস্তবপরায়ণ ব্যাখ্যা : ঐতিহাসিক ঘটনাবলিকে বাস্তব পৃথিবীর বিষয় দিয়ে বোঝবার আয়োজন। কেমন করে সম্ভব হলো থ্যালিসের দর্শন? কেমন করে সম্ভব হলো পৌরাণিক, কল্পনাকে পিছনে ফেলে বিজ্ঞানের আলোয় বিশ্ব রহস্যের সমাধান খোজা? মিশর বা ব্যাবিলোনের প্রাচীনতম সভ্যতায় যা সম্ভব হয়নি, কেমন করে তা সম্ভব হলো গ্ৰীক সভ্যতায়?
এ প্রশ্নের জবাব খুঁজে পাওয়া যাবে সমাজের গড়নের দিক থেকে।
মিশর প্রভৃতি প্ৰাচীনতর সভ্যতাগুলি গড়ে উঠেছিল। সেকালের বড় বড় নদীর কিনারায় কিনারায়। পলিপড়া উর্বর জমিতে খাদ্যের জোগান অনেক বেশি, তাই আদিম যাযাবর মানুষের দল এই সব জায়গাগুলিতেই ক্রমশ খিতিয়ে বসতে থাকে, গড়ে তোলে মানুষের প্রথম সভ্যতা। কিন্তু খাদ্যের জোগান বেশি হলেও জল সরবরাহের ব্যাপারে দারুণ সমস্যা : প্ৰকৃতিতে জলের যে সরবরাহ, শুধু তার উপর নির্ভর করা চলে না। বর্ষার সময় বৃষ্টির জল আর বন্যার জলে নদীর কিনারাগুলি একেবারে জলাভূমিতে পরিণত হয়ে যাবার ভয়, আবার বৃষ্টি বন্ধ হলে বা বন্যার জল সরে গেলে দারুণ জলকষ্টের ভয়। অথচ, জলই এই সভ্যতাগুলির প্রাণবস্তু, কেননা সভ্যতাগুলি প্ৰধানত চাষবাসের উপর নির্ভরশীল। তাই, মস্ত বড় সমস্যা হলো কৃত্রিম উপায়ে জলসেচের ব্যবস্থা করা, প্ৰকৃতিতে জলের যে খেয়ালী সরবরাহ তার উপর মানুষের দখল স্থাপন করবার সমস্যা। নদীতে বাধ বেঁধে বন্যার জল আটক রাখা, আবার খালি কেটে দরকার মতো এদিক-ওদিক জল সরবরাহ করা।
কৃত্রিম জলসেচ ব্যবস্থার দরুনই এই সভ্যতাগুলিতে ক্রমশ কেন্দ্রীয় সরকার গড়ে উঠতে লাগল। বিভিন্ন কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন পরিকল্পনা অনুসারে একই নদীতে নানান রকম বাঁধ বেঁধে নানান ধরনের জলসেচ ব্যবস্থা করতে গেলে তো চলে না, তাই দরকার পড়ল কেন্দ্রীয় পরিকল্পনার, আর এই কেন্দ্রীয় পরিকল্পনার দায় গ্ৰহণ করার জন্যে কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ। তার মানেই হলো কেন্দ্রীয় শাসক-তারই কবলে বিরাট বিরাট এলাকা। পুরো এলাকার সমস্ত মানুষের উপর যথেচ্ছাচার চালাবার ঢালাও সুযোগ। কোনো এলাকার মানুষ যদি কেন্দ্রীয় শাসকের মজিটা মানতে রাজি না হয়, তাহলে সেই এলাকার জল সরবরাহ বন্ধ করে তাদের অনায়াসেই জব্দ করে দেওয়া যাবে। কেন্দ্রীয় শাসকদের শক্তি তাই প্ৰায় অসীম। এই শক্তির কথাটা মনে না রাখলে বুঝতে পারা যায় না, সেই সুদূর অতীতের মানুষ কেমন করে গড়ে তুলতে পারল রুক্ষ মরুভূমির বুকে পিরামিডের মতো অবিশ্বাস্য বিশাল পাথরের গাঁথনি, বা পাহাড়ের চুড়োয় পাথর দিয়ে গাথা বিরাট মন্দির। তখনকার দিনে যান্ত্রিক কলাকৌশলের উন্নতি প্ৰায় নগণ্য, তাই এ-জাতীয় বিরাট কীতির মূল রহস্যটুকু খুঁজে পাওয়া সম্ভব শুধুমাত্র লক্ষ লক্ষ মানুষের রক্তজলকরা মেহনতের মধ্যে। কিন্তু অত লক্ষ মানুষকে অমন মূক পশুর মতো মেহনত করতে বাধ্য করা গেল কী করে? তার কারণ, বিরাট বিরাট এলাকার উপর, অসংখ্য মানুষের জীবনের উপর কেন্দ্রীয় শাসকের অসীম-অগাধ প্ৰতিপত্তি : সমস্ত এলাকার জল সরবরাহটি যার মজির উপর নির্ভর করছে, সে নিশ্চয়ই পুরো এলাকার মানুষকে মুখ বুজে মেহনত করবার জন্যে ঝোঁটিয়ে আনতে পারে। পুরো এলাকার প্রধান নির্ভর চাষবাস, চাষবাসের প্রধান নির্ভর জল সরবরাহ।