শুধু বিজ্ঞানের কথাই নয়। বিষয়বুদ্ধির দিক থেকেও তিনি রীতিমত ধুন্ধর ছিলেন। একবার কারা নাকি তাকে অকৰ্মণ্য বলে ঠাট্টা করেছিল, এতে তিনি বিলক্ষণ বিরক্ত হন এবং ঠিক করেন ব্যবসা-বুদ্ধি দেখিয়ে বণিকদেরও তাক লাগিয়ে দিতে হবে। এবং সে বছর জলপাই-তেলের ব্যবসা করে তিনি বিস্তর সম্পত্তি করে ফেললেন, দেখিয়ে দিলেন লক্ষ্মী-সরস্বতী উভয়কেই কেমন করে একসঙ্গে বশ করা যায়।
অবশ্য, প্ৰাচীন ইতিহাসে থ্যালিসের এত যে খ্যাতি, তা তাঁর বিষয়বুদ্ধির গুণেও নয়, জ্যামিতি-বিজ্ঞানে বুৎপত্তির দরুনও নয়। খ্যাতিটা হলো দার্শনিক প্ৰতিভার। তা-ও, দর্শন সম্বন্ধে তিনি এমন কিছু পুঁথিপত্র লিখে যাননি, অন্তত তাঁর লেখা কোনো পুঁথির কোনো খবর আমরা পাইনি। তার দার্শনিক প্ৰতিভার মাত্র একটি ভাঙা-চোরা টুকরো-মাত্র একটি কথা—সুদূর অতীত পেরিয়ে আমাদের কাছ পৰ্যন্ত পৌঁছেছে। তাছাড়া, আপাতদৃষ্টিতে, কথাটার মধ্যে দার্শনিক প্ৰতিভার এমন কিছু যুগান্তকারী স্বাক্ষর খুঁজে পাওয়া যায় না। কথাটা হলো : জল-ই পরম সত্তা, জল থেকেই সব কিছুর উৎপত্তি, জলের মধ্যে সব কিছু বিলীন হয়ে যায়। ভাবতে অবাক লাগে, শুধুমাত্র এইটুকু কথার জোরে খ্যালিস কেমনভাবে ইওরোপীয় দর্শনের আদিপুরুষ হিসেবে স্বীকৃত হন, বিশেষ কয়ে স্বীকৃতিটা যখন সৰ্ববাদিসম্মত। গ্ৰীক যুগে এ্যারিস্টটুল-এর যে গ্রন্থে গ্ৰীক-দৰ্শনের একটা ধারাবাহিক পরিচয় দেবার প্রথম চেষ্টা, সেই গ্ৰন্থ থেকে শুরু করে অতি-আধুনিক যুগে বার্টরাও রাসেল পাশ্চাত্ত্য দর্শনের যে ইতিহাস রচনা করেছেন, সেই ইতিহাস পর্যন্ত সর্বত্রই থ্যালিসের এই গৌরব।
অথচ, এমনিতে দেখলে কথাটার মধ্যে না আছে অভিনবত্ব, না যাথার্থ। অভিনবত্ব কোথায়? থ্যালিসের আগেও কবি হোমার এবং হেসইড, কল্পনা করেছিলেন জল থেকে পৃথিবী সৃষ্টি হবার কথা, এমন-কী মিশর ও ব্যাবিলোনএর প্রাচীন পুরাণেও এ-জাতীয় কল্পনার স্বাক্ষর। ব্যাবিলোনের পুরাণে বলা হয়েছে, এককালে সব কিছু ছিল জল, শুধু জল; স্রষ্টা–যাঁর নাম কিনা মার্দুক–সেই আদি প্লাবন থেকে সৃষ্টি করলেন পৃথিবী।
তাহলে? থ্যালিসের আত যে গৌরব তা ঠিক কিসের দরুন? উত্তরে বলা হয়, জল থেকে পৃথিবী সৃষ্টি হবার উপাখ্যানটা যদিও অতীতের পৌরাণিক কল্পনায় একাধিকবার উকি দিয়েছে, তবুও তা নেহাতই পৌরাণিক কল্পনা হিসেবে, ধর্মের অঙ্গ হিসেবে। আর তাই, সেগুলি দর্শনের মর্যাদা পাবার যোগ্য নয়। দর্শনের মর্যাদা প্ৰথম জুটল। থ্যালিসের, কেননা থ্যালিসই প্ৰথম পৌরাণিক চিন্তার কাঠামোটা পুরোপুরি বাদ দিয়ে, প্রকৃত বৈজ্ঞানিকের মেজাজ নিয়ে বিশ্বের রহস্য উদঘাটন করবার চেষ্টা করেছিলেন।
আসলে, জল থেকে সব কিছু সৃষ্টি হবার কথাটা, জলকে পরম সত্তা মনে করাটা বড় কথা নয়; এমন-কী ঠিক কথাও নয়। আধুনিক বিজ্ঞানের কৃপায় আমরা তো স্পষ্টভাবেই জেনেছি জলকে পরম সত্তা বলাটা ভুল, জলের মূলে রয়েছে দু’ রকমের গ্যাস, সেগুলির মূলে রয়েছে আরো মৌলিক সত্য। তবু অতীতের কল্পনায় সৃষ্টিরহস্যের সঙ্গে জলের যোগাযোগ; কেননা মানুষের যে-সব প্ৰাচীনতম সভ্যতা, সেগুলি গড়ে উঠেছিল। সেকালের বড় বড় নদীর কিনারায়; মিশরের নীল নদ, ভারতের গঙ্গা আর সিন্ধু, ইরাকের ইউফ্রেটিস আর টাইগ্রিস, চীনের ইয়াং-সি-কিয়াং আর হোয়াং হো। তখনকার মানুষের চোখের সামনে তাদের ছোট্ট পৃথিবীটুকু—নদীর কিনারার ওই জায়গাগুলো মাঝে মাঝে জলের প্লাবনে মুছে যায়, তারপর আবার উর্বর পলিপড়া জমি জেগে ওঠে জলের নীচ থেকে। তাই তাদের কল্পনা ঘুরে ফিরে বার বার জলকেই সৃষ্টি-প্রলয়ের জন্যে দায়ী করতে চেয়েছে। কিন্তু বিশেষ করে মনে রাখা দরকারপ্ৰাচীনদের কল্পনায় শুধু জল নয়, জলের সঙ্গেই সৃষ্টিপ্রলয়ের এক অধিদেবতাও। জল থেকে সৃষ্টি, সৃষ্টি করেছেন এক আদি বিধাতা-পুরুষ। ব্যাবিলোনবাসীরা তার নাম দিয়েছিল মার্দুক; অন্য দেশে অন্য কোনো নাম।
থ্যালিসের যেটা আসল গৌরব, সেটা হলো এই “মাদুককে সরাসরি বাদ দেবার” গৌরব। (ফ্যারিংটন)। বিধাতা-পুরুষের কথা বাদ দিয়ে তিনি শুধু পার্থিব জিনিসের সাহায্যে পরম সত্তাকে চেনাবার চেষ্টা করেছিলেন। থ্যালিস ইওরোপের আদি-দার্শনিক, কেননা তিনিই প্ৰথম পৌরাণিক কল্পনাকে পিছনে ফেলে বিজ্ঞানের আলোয় বিশ্বব্রহস্যের কিনারা করতে চেয়েছিলেন। তাঁর কথাটুকু আর যাই হোক, ধর্মবিশ্বাসের অঙ্গ নয়, নয় পৌরাণিক কল্পনার ক্রীতদাস।
মিশরের সভ্যতা, ব্যাবিলোনের সভ্যতা-গ্রীক সভ্যতার চেয়ে অনেক পুরানো। মিশরে আর ব্যাবিলোনে জ্যোতিষাদির জন্ম হয়েছিল, পণ্ডিতেরা চেষ্টা করেছিলেন বিশ্বের মূল রহস্যকে চেনবার বা বোঝবার; কিন্তু তবু মিশর বা ব্যাবিলোনে জন্ম হয়নি দর্শনের, জন্ম হলো গ্রীসে। গ্রীসেই প্ৰথম। কেননা, মিশর বা ব্যাবিলোনে বিশ্বরহস্যকে চেনবার চেষ্টাটা প্ৰকৃত বিজ্ঞানের আলোয় চেনবার চেষ্টা নয়, তার বদলে পৌরাণিক কুসংস্কারের পায়ে পায়ে ঘোরা, ধর্মবিশ্বাসের মোহ দিয়ে তত্ত্ব-জিজ্ঞাসাকে মেটাবার চেষ্টা। গ্রীসেই প্রথম তার হাত থেকে মুক্তি, স্বাধীন বুদ্ধি আর বিজ্ঞানের আলোয় পরম সত্যকে আবিষ্কার করার আয়োজন।
কিন্তু কেমন করে সম্ভব হলো এটা? এ কি শুধুই থ্যালিসের বাক্তিগত প্ৰতিভার ফল? কিংবা জাতি হিসাবে গ্ৰীক জাতি সত্যিই কি এমন কোনো আলোকসামান্য বৈশিষ্টের অধিকারী ছিল, যার কৃপায় এমনতর সৃষ্টিছাড়া কাণ্ড সম্ভব হলো ওদের মধ্যে?