আরো একটা দেশের কথা তুলব। আমাদের দেশের কথা। আমাদের দেশের প্রাচীন বস্তুবাদী দর্শনটার কথা, যার নাম হলো কিনা চাৰ্য্যাক বা লোকায়ত দর্শন।
প্ৰথমে গ্ৰীক দর্শনের আদি যুগটার কথা; বস্তুবাদ ছেড়ে ভাববাদের দিকে ঝোকার ইতিহাসটা।
০৬. আইয়োনীয় দর্শন
আজকাল দার্শনিক বলতে, অন্তত চলিতভাবে, আমাদের মনে আসে একরকম আধপাগলা ধরনের মানুষের কথা, বিশ্বের চরম রহস্য-চিন্তায় এমনই সে মশগুল যে সাধারণ কর্মজীবনে খুঁটিনাটির ব্যাপারেও তার ঔদাসীন্য–তার চালচলন, এমন কী তার চেহারাতেও নাকি এই ঔদাসীন্যের ছাপ। হয়তো চুল আঁচড়ায় না, দাড়ি কামায় না, জামার বোতাম আঁটতে ভুলে যায়, কিংবা জামাটাই গায়-গলায় উলটো করে; বাজারে চালের দর কত জিজ্ঞেস করলে তার মুখে অসহায় শিশুর ভাব ফুটে ওঠে, পুঁথিপত্র নিয়ে সে যখন তন্ময় তখন ঘরে আগুন লাগল কি-না লাগল এ খেয়ালটুও তার থাকে না। এই বুঝি জাত দার্শনিকের নিখুঁত ছবি; একান্ত জ্ঞানবিভোর, আর তাই যেন একান্ত অকৰ্মণ্য! দার্শনিক বলতে এমনতর ছবি কেন আমাদের মনে উকি দেয়? তার কারণ, আধুনিক দুনিয়ায় জ্ঞানচর্চা আর মেহনত-জীবনের মধ্যে দেখা দিয়েছে বিশাল গভীর খাদ, কিংবা, যা একই কথা, তত্ত্বান্বেষণের সঙ্গে সামাজিক মেহনতের সম্পর্ক গেছে ঘুচে। আর তাই দার্শনিক বলতে আমরা বুঝি নিছক জ্ঞানবিভোর এক মানুষ, সহজ কর্মজীবনের দিক থেকে চেয়ে দেখলে যাকে কিন্তুতকিমাকার দেখায়। কাজের মানুষ তাই ঠাট্টা করে বলে; দর্শন হলো এক অন্ধের পক্ষে এক অন্ধকার ঘরে একটা কালো বেড়ালের সন্ধান, ঘরটায় অবশ্য কোনো বেড়ালেরই চিহ্ন নেই।
অথচ, দর্শনের এ হেন দুর্নাম এমন কিছু চিরকেলে দুর্নাম নয়। ইতিহাসবিচারে দেখতে পাওয়া যায়, কোনো কোনো যুগে সামাজিক মেহনতের সঙ্গে দর্শনের আর দার্শনিকের নিবিড় আত্মীয়তা ফুটে উঠেছে। দার্শনিক বলতে তখন কোন চিন্তাবিলাসীর ছবি মনে আসে না। তখন প্ৰকৃতবিজ্ঞানের যে ইজত। দার্শনিকেরও সেই ইজ্জত, প্ৰকৃত বিজ্ঞানের যে সামাজিক প্ৰতিষ্ঠা দর্শনেরও সেই সামাজিক প্ৰতিষ্ঠা; অর্থাৎ, তত্ত্বান্বেষণ আর কর্মজীবনের মধ্যে যখন যোগাযোগ, তখন দর্শন আর বিজ্ঞানের মধ্যে সীমারোখাটা অস্পষ্ট, কিংবা, যা প্ৰায় একই কথা, দর্শন তখন প্ৰকৃত অর্থে বিজ্ঞানে পরিণত।
যে-যুগে ইওরোপীয় দর্শনের জন্ম সেই যুগ সম্বন্ধে এই কথাই। আর ইওরোপীয় দর্শনের ইতিহাসে সকলেই র্যাকে আদি দার্শনিক বা প্ৰথম দার্শনিক বলে স্বীকার করেন, তিনি মোটেই নিছক তন্ময় চিন্তাবিলাসী ছিলেন না। বরং তাঁর বৈজ্ঞানিক প্ৰতিভা, কর্মজীবনে কৃতিত্ব বা ব্যবহারিক সাফল্য তখনকার যুগের তুলনায় অসামান্য বলেই স্বীকৃত।
ইওরোপীয় সংস্কৃতির অন্যান্য নানান দিকের মতো ইওরোপীয় দর্শনেরও জন্মভূমি হলো গ্রীস। গ্রীকদের মধ্যে যিনি প্ৰথম দার্শনিক তার নানা থ্যালিস। যীশুখ্ৰীষ্ট জন্মাবার ৬৪০ বছর আগে তাঁর জন্ম এবং নব্বই বছর বয়সে, অর্থাৎ, যীশুখ্ৰীষ্ট জন্মাবার ৫৫০ বছর আগে, তার মৃত্যু।
অবশ্য, শুধু গ্ৰীক বললেই কথাটা স্পষ্ট হয় না। ইওরোপের মানচিত্রটা একবার মনে করুন : গ্রীসের পুর্বদিকে যে সমূদ্র তার ওপারে ছোট ছোট স্বীপ, তারপর তুর্কি। তুর্কির পশ্চিমে অনেকখানি উপকূল অংশকে ছোট এশিয়া বা এশিয়া মাইনর বলা হয়। প্ৰাচীনকালে গ্রীকদের প্রধান চারটি জাতির মধ্যে আয়োনীয় নামের জাতি এই এশিয়া মাইনর-এ এসে উপনিবেশ স্থাপন করেছিল। সে উপনিবেশের যে-বারোটি শহরের কথা ইতিহাসে প্ৰসিদ্ধ, তারই ভিতর একটি শহরের নাম মিলেটাস, আর যে অঞ্চলে এই মিলেটাস শহর সেই অঞ্চলেরই নাম আয়োনিয়া। ব্যবসা-বাণিজ্যের দিক থেকে আয়োনীয়দের তখন খুব নাম-ডাক। এমন-কী, তখনকার দিনেই ওরা আমাদের দেশ পর্যন্ত সওদাগরি করতে আসত; খুব সম্ভব ওদের নাম থেকেই আমাদের দেশে “যবন” শব্দ প্ৰথম চালু হয়।
আয়োনীয়দের এমন যে সরগরম ব্যবসা-বাণিজ্য, তার একটি প্ৰধান ঘাটি ছিল ওই মিলেটাস শহর। আর এই কর্মমুখর শহরেই জন্ম হলো ইওরোপীয় দর্শনের, থ্যালিস ছিলেন এই শহরের বাসিন্দা। সওদাগরি শহরটার আবহাওয়া আর তখনকার দিনের যে সমাজব্যবস্থা তার ছায়া কেমনভাবে তাঁর দর্শনে প্ৰতিফলিত হয়েছে সে-কথা একটু পরে তোলা যাবে। তার আগে দেখা যাক থ্যালিসের জীবনী, দেখা যাক তখনকার প্রয়োগ প্ৰধান বিজ্ঞানের সঙ্গে আর কর্মজীবনের সঙ্গে তার কী-রকম গভীর যোগাযোগ।
অবশ্যই, থ্যালিসের কোনো পূর্ণাঙ্গ জীবনচরিত তখনকার দিনে কেউই লিখে যাননি। তবুও নানান প্রাচীন পুঁথিপত্র থেকে তাঁর জীবনী সম্বন্ধে কতকগুলো টুকরো কথা উদ্ধার করা যায়। আজকের ঐতিহাসিক মোটামুটি এরই ভিত্তিতে থ্যালিসের একটা জীবনচরিত গড়ে তোলবার চেষ্টা করেন। এই জীবনচিত্রের একটা প্ৰধান কথা হলো, তখনকার দিনে বিজ্ঞানের যতটুকু উন্নতি হয়েছিল তার সঙ্গে থ্যালিসের ঘনিষ্ঠ পরিচয়। অবশ্যই, থ্যালিসের আগে বিজ্ঞানের সত্যিই জন্ম হয়েছিল কি-না, তা তর্কের বিষয়; কেননা তাঁর আগে পর্যন্ত জ্যোতির্বিদ্যা ইত্যাদি ধর্ম ও পৌরাণিক বিশ্বাসের দখল থেকে মুক্তি পায়নি। তবু জ্যামিতিতে অগ্ৰণী ছিল মিশর, জ্যোতির্বিদ্যায় ব্যাবিলোনিয়া, নৌবিদ্যায় গ্রীকদের চেয়েও বেশি নাম-ডাক ছিল ফিনিসীয় বণিকদের। খুব সম্ভব, ব্যবসা-বাণিজ্য উপলক্ষেই থ্যালিস মিশর দেশে গিয়েছিলেন এবং সেখান থেকে তিনি শিখেছিলেন জ্যামিতি। কিন্তু মিশরবাসীরা এ-বিজ্ঞানের প্রয়োগ জানত শুধুই জমিজায়গা মাপ-জোখ করবার ব্যাপারে, বস্তুত এই কাজের দাবিই ওদের মধ্যে জ্যামিতি-বিজ্ঞানের জন্ম দিয়েছিল। থ্যালিস কিন্তু জ্যামিতির হিসেবা-নিকেশের উপর নির্ভর করে একটি উপায় বের করলেন, যে উপায়ের সাহায্যে সমুদ্রের বুকে জাহাজ কতখানি দূরে রয়েছে তা নির্ণয় করা সম্ভব। তাছাড়া, জ্যামিতিতে একটি কথা জানা হলো এক-জিনিস, কথাটাকে প্ৰমাণ করতে পারা আর এক-জিনিস। প্ৰমাণ করবার শর্তগুলি মিশরবাসীদের কাছে স্পষ্টভাবে ধরা পড়েনি, ধরা পড়ল থ্যালিসের কাছে। যেমন ধরা যাক, মিশরবাসীরাও জানত একটা বৃত্তের (circle) ব্যাস (diameter) বৃত্তটিকে সমান দু’ভাগে বিভক্ত করে; কিন্তু এ কথাকে নিভুলভাবে প্রমাণ করতে তারা জানত না। প্রমাণ করবার পথ দেখালেন থ্যালিস। তাঁর এইরকম একটা কোনো কীর্তির কথা মনে রেখে আধুনিক যুগের দিকপাল দার্শনিক ইমানুয়েল কাণ্ট থ্যালিসকেই ইতিহাসের প্ৰথম প্ৰকৃত গণিত-বিজ্ঞানীর সম্মান দিতে চেয়েছেন। কিন্তু তিনি প্ৰথম গণিত-বিজ্ঞানী হোন আর নাই হোন, এ-কথায় কোন সন্দেহ নেই যে, থ্যালিস মিশর থেকে জ্যামিতি শুধু শিখেই আসেননি, জ্যামিতিকে আরো উন্নত করার ব্যাপারে তার অবদান ছিল অনেকখানি। ব্যাবিলোনবাসীদের জ্যোতির্বিজ্ঞানের বেলাতেও একই কথা। ওরা গ্ৰহনক্ষত্রের একটা ছক তৈরি করেছিল; সেই ছকের উপর নির্ভর করে ৫৮৫ খ্ৰীষ্টপূর্বাব্দে থ্যালিসই প্ৰথম হিসেব করে বলে দেন করে গ্ৰহণ হবে সেই দিনটির কথা। নৌবিদ্যায় আকাশের তারার উপর নির্ভর করে দিক নির্ণয়ের যে-কৌশল ব্যাবিলোনবাসীরা আয়ত্ত করেছিল, গ্ৰীক নৌবিদ্যায়। সেই কৌশল আমদানি করলেন থ্যালিস।