প্ৰাকৃতিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি মানুষ। বিপৰ্যয়-মুক্তির দুটো পথ তার সামনে। একটা পথ হলো বিপৰ্যয়কে জয় করবার পথ, প্রয়োগের পথ। এই পথে এগুতে গেলে তার চেতনা বস্তুবাদী না হয়ে পারে না। যদিও এ পর্যন্ত–অর্থাৎ সোভিয়েট দেশে সচেতন ঐশ্বর্যের ভিত্তিতে মানুষের মেহনতাকে প্ৰতিষ্ঠা করবার যে-আয়োজন তার আগে পর্যন্ত–প্ৰকৃতিকে জয় করবার যে-পথ, সেপথে নানান দ্বিধা, নানান দ্বন্দ্ব। তাই সোভিয়েট দেশে বস্তুবাদের প্রতিষ্ঠাই প্ৰথম সর্বাঙ্গীণ আর বলিষ্ঠ প্ৰতিষ্ঠা।
আর একটা পথ হলো এই বিপৰ্যায়-বোধকেই জয় করবার পথ। এই দ্বিতীয় পথটারই নাম ধর্ম, যার সংস্কৃত সংস্করণ অধিবিদ্যা আর ভাববাদ। বিপৰ্যয়বোধকে জয় করা। তার মানে, মানুষের যে-চেতনায় এই বিপর্যয়ের প্রতিচ্ছবি, সেই চেতনার উপরেই এমন প্ৰলেপ দেওয়া, এমনভাবে সেই চেতনাকে বদল করে নেওয়া, যাতে বিপৰ্যয় থাকলেও বিপৰ্যয়-সংক্রান্ত হুশিটুকু না থাকে। এই পথই হলো ধর্মের পথ। কেননা, ধর্ম চেয়েছে মানুষের ভাব-আবেগকে এমনভাবে বদল করতে, যাতে প্ৰকৃতি আর বিরুদ্ধ-শক্তি হিসেবে প্ৰতীত না হয়। মানুষের প্ৰথম ধর্ম-চেতনায় তাই দেখতে পাওয়া যায় প্ৰাকৃতিক শক্তির অধিষ্ঠাতাঅধিষ্ঠাত্রী দেবদেবীর কল্পনা : ইন্দ্ৰ, বরুণ, মাতিরিশ্বন, অগ্নি, আদিত্য, সোম, এই রকম সব দেশেই। এই সব প্ৰাচীন দেবদেবীর মধ্যে কিন্তু মানুষের প্ৰতিবিম্ব; তোয়াজ করলে এরা তুষ্ট হয়, তোয়াজ না করলেই সর্বনাশ। তবু সর্বনাশ-সম্ভাবনার বোধ থেকে অন্তত একরকমের মুক্তি তো জুটল; নৈবেদ্য সাজিয়ে উপাসনা করতে পারলে আর সর্বনাশের ভয় নেই। অবশ্যই এ-পথ সত্যিকারের বিপর্যয় থেকে মুক্তি পাবার বাস্তব পথ হতে পারে না। সে পথ একমাত্র বিজ্ঞানের পথ। ধর্মের পথ হলো নিজের মনকে বদল করবার পথ, নিজের চেতনাকে বদল করবার পথ, যাতে সর্বনাশ-বোধ থেকে আত্মরক্ষণ করা যায়। সমাজে শ্রেণী-বিভাগ দেখা দেবার আগে পর্যন্ত এইভাবে চেতনাকে, শুধু চেতনাকে বদল করবার সম্ভাবনা মানুষের সামনে দেখা দেয়নি। দেখা দিল শ্রেণীবিভাগ ফুটে ওঠবার পর থেকে, কেননা তখন থেকেই সমাজের সদর মহলে চেতনা, অন্দরমহলে মেহনত ৷ যে-হাত দিয়ে মেহনত সেই হাত পড়ল চোখের আড়ালে।
অবশ্যই ধর্মের ইতিহাস আছে। বহুর উপাসনা থেকে এক পরমব্রহ্মের ধ্যান পৰ্যন্ত। তবু, এই ইতিহাসের মধ্যে তৈলধারার মতো অবিচ্ছিন্ন যে কথা, সে কথা হলো চেতনাকে বদল করে বিপৰ্যায়-বোধের হাত থেকে নিষ্কৃতি খোঁজবার কথা। প্ৰকৃতিকে বদলে বিপৰ্যায়ের হাত থেকে নিষ্কৃতি খোঁজবার ঠিক উলটো। প্রয়োগের ঠিক উলটো। বিজ্ঞানের ঠিক উলটো।
ধর্মের মার্জিত আর সংস্কৃত সংস্করণ হলো অধিবিদ্যা, যার মূল কথা চেতনকারণবাদ, ভাববাদ। তাই ধর্মের সঙ্গে অধিবিদ্যার মেশা মিশি। আমাদের দেশে এক চাৰ্যাক-দৰ্শন আর প্রাচীন সাংখ্য দর্শনের কথা বাদ দিলে এ-কথা একেবারে প্রকট ও স্পষ্ট। তাও সাংখ্য দর্শনের নিরীশ্বর প্রধান কারণবাদকে শুধরে নিয়ে তার মধ্যে ঈশ্বরের জন্যে, ধর্মের জন্যে জায়গা করে নেওয়া এবং পাছে বস্তুবাদের মোহো পড়ে চরিত্র বিগড়ে যায়। এই ভয়ে যোগদর্শনের সঙ্গে তাকে একসূত্রে বেঁধে দেওয়া; যে-কারণে শেষ পর্যন্ত সাংখ্য আর শুধু সাংখ্য -রইল না, দেখা দিল সাংখ্য নামের এক দর্শন, যার মধ্যে ধর্মে-অধিবিদ্যায় সুনিশ্চিত মেশামিশি। চাৰ্যাকদের কথা পরে আলাদা করে আলোচনা করব। আপাতত বাকি দার্শনিক মতবাদগুলির দিকে দেখা যাক। এমন কী বৌদ্ধ আর জৈন দৰ্শন-যেগুলির নাম হলো নাস্তিক দৰ্শন-সেগুলির মধ্যেও চোদে আনা প্রেরণা নিছক ধর্মের প্রেরণাই। বৌদ্ধ ধৰ্ম আর জৈন ধর্ম। ধর্মবিরোধী বলে এগুলির নাম নাস্তিক নয়, বেদ মানে না বলে নামটা নাস্তিক। বাকি থাকে আস্তিক দর্শনগুলির কথা। অপৌরুষেয় বৈদিক বিশ্বাসের মুকুট পরে সেগুলি স্পষ্টতমভাবেই ধর্মের সঙ্গে নিজেদের সৌহার্দ ঘোষণা করছে। ন্যায়-বৈশেষিকও মাথা খুঁড়েছে ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করবার আশায়, রামানুজ আর শঙ্কর তর্ক তুলছেন যো-জানের দরুন মুক্তি বা ব্ৰহ্মলাভ সেই জ্ঞান উপাসনাজন্য না বাক্য-জন্য। এইভাবে ধর্ম আর অধিবিদ্যার মেশামিশি সমস্ত ভারতীয় দর্শনের ইতিহাসকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে।
কিন্তু শুধু ভারতীয় দর্শনের কথাই নয়। য়ুরোপীয় দর্শনের ইতিহাসে নেহাত প্রয়োগপ্রণোদিত বস্তুবাদের গণ্ডিটুকুর বাইরে সর্বত্র এই কথা। পাইথাগোরাস, পারমানাইডিস, প্লেটো থেকে শুরু করে ব্রাডলির ব্রহ্মবিদ্যা পৰ্যন্ত। কেবল, খুব হালে ব্যাপারটার কিছুটা ভোল বদলেছে। সোজাসুজি ভগবানের কথায় সহজে আর মানুষের মন ভোলানো যায় না দেখে ধর্মবিশ্বাসের কথাটা খিড়কি দোর দিয়ে নিয়ে আসবার চেষ্টা : সামনে বহুরূপী, বিজ্ঞানৰ্ম্মান্য প্ৰবঞ্চনার তোরণ। তাই ধর্মের সঙ্গে অধিবিদ্যার বিরোধ নয়, বরং ঘনিষ্ঠতম আত্মীয়তাই। বিরোধ বস্তুবাদের সঙ্গে বিজ্ঞানের। দর্শনের ইতিহাসে কয়েকটি প্ৰাচীন পরিচ্ছেদের উপর একবার চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক। প্রাচীন গ্রীসে যখন কিনা দর্শনের প্রথম জন্ম, তখন তার সঙ্গে প্রয়োগজীবনের কতখানি সম্পর্ক। তাই সে দর্শন কী-রকম অভ্রান্তভাবেই বস্তুবাদী, আর ওই বস্তুবাদের একটা চেষ্টাই হলো ধর্মবিশ্বাসকে, পৌরাণিক বিশ্বাসকে ঠেলে সরিয়ে বিজ্ঞানের প্ৰতিষ্ঠা। কিন্তু ওই প্রয়োগজীবনের সঙ্গে দার্শনিক চেতনার সম্পর্ক যখনই যত ক্ষীণ হয়েছে, ততই সে চেতনা সরে গিয়েছে বস্তুবাদের দিক থেকে ভাববাদের দিকে। এই হলো একটা দেশের কথা।