এই তো শঙ্করের ভাববাদ খণ্ডন। কিন্তু তারপর ? তাঁর নিজের মতবাদ ? ব্ৰহ্ম সত্য, এবং ব্ৰহ্ম মানে বিশুদ্ধ চৈতন্য । এর চেয়ে চরম ভাববাদ-চেতনকারণবাদ-পৃথিবীর ইতিহাসে আর কখনো দেখা দেয়নি । যে বহির্বস্তুর অবিসংবাদিত সত্তা নিয়ে এত তর্ক, তার হলো কী ? সমগ্র জগৎ–যে জগতে ভাববাদীর মুখের মতো চাবুক নেই বলে শঙ্করের এত অনুশোচনা–রজ্জুতে সৰ্প-প্ৰতিভাসের মতো মিথ্যে হয়ে গেল। ( মিথ্যা হিসাবে রজ্জু-সৰ্প আরও এক কাঠি সরেস, কিন্তু তাই বলে ব্যবহারিক পৃথিবী তার চেয়ে এক চুলও বেশি নয়। অদ্বৈত মতে মিথ্যার তারতম্যকে সত্যের তারতম্য বলে ভুল করলে চলবে না ) । সহজবুদ্ধির সঙ্গে সামান্যতম। আপসটুকুও নেই : ভাববাদ-খণ্ডন পরিণতি পেল চুড়ান্ত ভাববাদে।
দর্শনের এই আজব গোলক-ধাঁধায় ঘোরা–ভাববাদের হাত থেকে মুক্তি, পেতে গিয়ে ভাববাদের জালেই জড়িয়ে পড়া–একে শুধু দিশি দার্শনিকের খামখেয়াল বলে উড়িয়ে দেওয়াও চলে না । প্ৰাচীন গ্রীসে মহৎ দার্শনিকের মধ্যেও একই ঘটনার পুনরুক্তি। সক্রেটিসের কথা ধরা যাক। তাঁর দর্শন, এমন-কী তাঁর জীবনকেও বোঝবার একমাত্র সূত্র হলো সফিস্টদের ভাববাদকে খণ্ডন করবার উৎসাহ । সফিস্টরা তর্কে ধুরন্ধর ; তারা প্ৰমাণ করতে চায় যে, ব্যক্তিগত মানুষের মনের ওপরেই পরমসত্তার একান্ত নির্ভর । মানুষের ভালোলাগা-না-লাগাই সত্যবিচারের অভ্রান্ত কষ্টিপাথর। ভাববাদের এই মূল দাবিকে নিছক জ্ঞানের গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ রেখে সফিস্টদের সন্তোষ নেই, নৈতিক এবং রাজনৈতিক জীবনেও তারা এর জের টানতে চায়–সুনীতি আর দুর্নীতির মধ্যে আসলে কোনো তফাত নেই, আপনার যা রোচে, সেটাই আপনার কাছে সুনীতি ; প্ৰেয় আর শ্ৰেয়, একেবারে নিছক এক । রাষ্ট্ৰীয় আইন-কানুনের বেলাতেও ওই এক কথা-এ-সব আইন-কানুন মানতে যদি মন্দ না লাগে, তাহলে মন্দ কী ? কিন্তু মানতে যে হবেই, এমন কোনো কথা নেই।
সক্রেটিস দেখলেন, ভাববাদের এই দাবি সমাজজীবনের পক্ষে একেবারে দুর্বিষহ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই ভাববাদকে খণ্ডন করবার জন্যে তিনি প্ৰায় মরিয়া হয়ে উঠলেন । তার খণ্ডন-পদ্ধতি আপাত বিনয়ের পরাকাষ্ঠা, কিন্তু তার পেছনে যে তীব্র বিদ্রুপ আর তীক্ষ্ণ বিদ্বেষ লুকানো, সে-কথা তার ভক্তদের লেখা ভালো করে পড়ে দেখলেই বুঝতে পারা যায়। হাটবাজার থেকে শুরু করে বড়লোকের খানাপিনার আসর পর্যন্ত সর্বত্রই তার দুর্ধর্ষ দ্বন্দ্ব-আহবান,–অমনটাই ছিল তখনকার দিনের ব্যাপার ।
কিন্তু তারপর ? তাঁর নিজের মতবাদ ? তিনি নিজে অবশ্য কোনো দার্শনিক গ্ৰন্থ রচনা করেননি । তাঁর দর্শনের যেটুকু পরিচয় পাওয়া যায়, তা শুধু তার ভক্তবৃন্দের–প্রধানত প্লেটাে ও জেনোফেন-এর–গ্ৰন্থাবলী থেকে। এবং টীকাকারদের মধ্যে এ নিয়ে অনেক তর্ক আছে যে, প্লেটো নিজের গ্রন্থে সক্রেটিসের মুখে যে দার্শনিক মতবাদ বসিয়েছেন, তা তাঁর গুরুদেবেরই মতবাদ, না নিজের মতবাদ ভক্তিভরে গুরুদেবের নামে প্ৰচারিত মাত্ৰ ! কিন্তু এ-কথা নিয়ে তর্ক যতই থাকুক না কেন, এবং গুরুশিষ্যের মধ্যে মতের প্রভেদ ঠিক কী এবং কতটুকু, এ-বিষয়ে টীকাকাররা নিঃসন্দেহ হতে পারুন আর নাই পারুন,- অন্তত এক বিষয়ে মতভেদের কোনো প্ৰশ্নই ওঠে না ! প্লেটোর দর্শনে সক্রেটিক বিশ্বালোচনের পূর্ণ বিকাশ। এবং গ্ৰীক যুগে প্লেটোর পৌরোহিত্যেই এই ভাববাদের সবচেয়ে জমকালো অভিষেক । ভাববাদ-খণ্ডন এইভাবে ভাববাদেই পরিণতি পেল ।
দর্শনের সেই পুরোনো গোলক-ধাঁধাই ! তবু নেহাত একে প্রাচীনদের সেকেলে ভ্ৰান্তিবিলাস ভেবে নিজেদের সান্ত্বনা দেওয়াও সম্ভব নয়। য়ুরোপের ইতিহাসে বিজ্ঞানের দিগ্বিজয় শুরু হবার পরও যে দিগ্বিজয়ী দার্শনিকের জন্ম হলো, এবং যার বৈজ্ঞানিক বুৎপত্তি অতি-বড় বিপক্ষও অস্বীকার করতে পারেন না, তিনিই বা এই অদ্ভুত আবর্তকে এড়াতে পারলে কই ? ইম্যানুয়েল কাণ্ট–কোএন্স্বের্গের সেই ঋষি ইম্যানুয়েল কাণ্ট,-যাঁর কথা বলতে গিয়ে কোলরিজের কবিকণ্ঠও আবেগে গদগদ হয়ে পড়ে। পাছে তাঁর দার্শনিক মতবাদকে টীকাকারেরা ভুল করে ভাববাদ বলেই চালিয়ে দেন, এই ভয়ে কান্ট তাঁর প্রধান গ্ৰন্থ “শুদ্ধবুদ্ধির বিচার”-এর দ্বিতীয় সংস্করণে একটি নূতন অংশ জুড়ে দিলেন, আর সেই অংশের নাম দিলেন “ভাববাদ-খণ্ডন” । তাঁর মতো পারিপাট্য-প্রিয় দার্শনিক ভাববাদকে খণ্ডন করার সময় এলোমেলোভাবে অগ্রসর হবেন, এমন কথা নিশ্চয়ই ভাবা যায় না ; কাণ্ট এলোমেলোভাবে এগোননি । প্ৰথমে তিনি প্ৰচলিত ভাববাদের শ্রেণীবিভাগ করে নিয়েছেন : একদিকে বার্কলির গোড়া ভাববাদ এবং অপরদিকে দেকার্ত-এর সংশয়াত্মক ভাববাদ । বার্কলি সম্বন্ধে তাঁর বক্তব্য সামান্যই-দেশ এবং কালের বাহ্যসত্তা অপ্ৰমাণ করে, এ দুটিকে মানব অনুভূতির মূল কাঠামো বলে প্ৰমাণ করে, কাণ্ট নাকি আগেই এই গোড়া ভাববাদের মূল উচ্ছেদ করেছেন ( কীভাবে যে তা সম্ভব হয়, তাই নিয়ে অবশ্য টীকাকারদের মধ্যে অনেক বিতর্ক আছে) । আপাতত কাণ্টের প্রধান উদ্দেশ্য হলো দেকার্ত-এর সংশয়াত্মক ভাববাদ খণ্ডন করা । দেকার্ত-মতে একমাত্র আত্মার সত্তাই অবিসংবাদিত সত্য, তাকে সংশয় করতে গেলেও স্বীকার করতে হয়। অপরপক্ষে, বহির্বস্তুর সত্তা ভগবানের দোহাই না দিয়ে মানবার জো নেই। এ কথা খণ্ডন করতে গিয়ে কাণ্ট দেখালেন যে, তথাকথিত অবিসংবাদিত আত্মাকে মানতে গেলে বহির্বস্তুর সন্তা না মেনে উপায় নেই। কেননা, আত্মা সম্বন্ধে আমাদের যেটুকু উপলব্ধি, তা নিছক চেতনা-প্রবাহের উপলব্ধি, এবং প্রবাহকে প্ৰবাহ হিসেবে বুঝতে গেলে স্থির ও নিত্যর সাহায্য নিতেই হবে । কিন্তু স্থির ও নিত্যর কোন হদিশ মানস-জগতে মেলে না । তাই বহির্জগতে তার সত্তা না মেনে উপায়ই নেই । আর এই কথা প্ৰমাণ করার পর কাণ্টে প্ৰায় উল্লাস করে বললেন : ভাববাদীর মরণ-মন্ত্র ভাববাদের বিরুদ্ধেই চেলে দেওয়া গেল, কেননা ভাববাদ অনুসারে একমাত্র অন্তর্বস্তুর যাথার্থই অধিসাংবাদিত, অথচ প্ৰমাণ করে দেওয়া গেল যে, অন্তর্বস্তুর অনুভূতি একান্তভাবে বহির্বস্তুর মুখাপেক্ষী!