শ্ৰেণী-সমাজের আওতায় জনগণের মধ্যে এই যে অসহায়-বোধ, একে যেন ইন্ধন জোগাল নতুন এক ধরনের দুৰ্যোগ, নতুন এক ধরনের অনিশ্চয়তা। আগে ছিল শুধু প্ৰাকৃতিক দুৰ্যোগ, শ্রেণী-সমাজে তার উপর জুটল সামাজিক দুৰ্যোগও। বৃষ্টি না হলে ফসল ফলবে না, মানুষের পেট ভরবে না; দল বেঁধে বৃষ্টির নাচ নেচে, কল্পনায় বৃষ্টি পেয়ে দল বেঁধে দ্বিগুণ উৎসাহে ফসলের সন্ধান করা-এই হচ্ছে ইন্দ্ৰজাল। কিন্তু বৃষ্টি পড়ল, ফসল ফলল, তবু মানুষের পেট ভরল না-এ হলো এক নতুন ধরনের অনিশ্চয়তা। অনাবৃষ্টির অনিশ্চয়তার উপর আর এক রকমের অনিশ্চয়তা যোগ করে দেওয়া। মানুষের মনের অসহায়বোধকে দ্বিগুণ করে তোলা। সমবেত জীবন থেকে কোনো প্রেরণারই সঞ্চয় নেই। ভিক্ষাপাত্রই বুঝি একমাত্র সম্বল, শাসকের কৃপা জাগাতে পারা ছাড়া কোনো পথই চোখে পড়ে না। মানুষের মন ধর্মের দিকে ঝুঁকবে বই-কী।
তারপর, সেই প্ৰথম সভ্য সমাজের পর থেকে আজ পর্যন্ত শ্রেণী:সমাজ। উৎপাদন-প্ৰণালীর হাজার উন্নতি সত্ত্বেও এই সামাজিক অনিশ্চয়তার হাত থেকে মানুষ মুক্তি পায়নি। তাই ধর্মের হাত থেকেও নয়। অসহায় মানুষ জীবনে বিধ্বস্ত হয়ে করুণা ভিক্ষা করেছে উচ্চতর শক্তির কাছে। সমবেত জীবন ফিরে না। আসা পৰ্যন্ত এই অসহায়তা থেকে মানুষের মুক্তি নেই। তাই, ধর্মের হাত থেকেও নয়। সমাজের গভীরে ধর্মের এই বীজ লুপ্ত থাকার দরুন। এতদিনকার খাপছাড়া সব রকম নাস্তিক্যবাদ বিফলে গিয়েছে। সমবেত জীবন ফিরে পাবার আগে পৰ্যন্ত ধর্মের হাত থেকে মানুষের প্রকৃত মুক্তি নেই; অর্থাৎ এক কথায় গণ-বিপ্লব। এই বিপ্লব সোভিয়েট দেশে সাম্য-জীবনের আগমনী শুনিয়েছে। তাই, ধর্মের হাত থেকেও নিষ্কৃতির পথ দেখিয়েছে মানুষকে। তবু অতীত ইন্দ্ৰজালের স্তরে ফিরে যাওয়া নয়। অনেক অনেক উন্নত উৎপাদন-প্ৰণালী এসেছে মানুষের কবলে। তাই প্ৰকৃতিকে আসল জয় করবার অভাবটা কল্পনায় জয় করা দিয়ে পূরণ করে নেবার চেষ্টা নয়-ইন্দ্ৰজাল নয়। বিজ্ঞান। সংস্কারমুক্ত সুস্থ বিজ্ঞান। ইন্দ্ৰজালের মূল ভঙ্গি যেন অনেক অনেক উঁচু স্তরে উন্নীত।
ইন্দ্ৰজাল থেকে ধর্ম। শ্রেণীহীন সমাজ থেকে শ্রেণীসমাজ। এই পটভূমিকে মনে রাখতেই হবে। বুর্জোয়া বৈজ্ঞানিক-কলাকৌশলের দিক থেকে যত আশ্চৰ্য প্ৰতিভার অধিকারীই তিনি হোন না কেন-এই পটভূমির কথা মনে রাখেন না। তাই ইন্দ্ৰজাল ছেড়ে ধর্মে পৌঁছোনোর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে শেষ পৰ্যন্ত কয়েকটি কাল্পনিক কথার উপর তাকে নির্ভর করতে হয়।
স্যার জেমস্ ফ্রেজারের কথাই আবার উল্লেখ করছি। ধর্মের জন্মের মূলে মানুষের মনে যে এক অভূতপূর্ব অসহায় ভাব জেগেছিল, সে-কথা তিনি অনুভব করতে পারেন : “আমাদের সেই আদিম দার্শনিকট তার প্ৰাচীন বিশ্বাসের লিঙ্গর থেকে বিচ্ছিন্ন হবার পর, সংশয় এবং অনিশ্চয়তার দুৰ্যোগময় সমুদ্রে ভেসে বেড়াতে বেড়াতে তার নিজের উপর আর নিজের শক্তির উপর পুরোনো সুখের আস্থা নির্মমভাবে ঝাকুনি খাবার পর, নিশ্চয়ই করুণভাবে হতভম্ব ও বিচলিত হয়ে পড়েছিল; শেব পর্যন্ত সে শান্তি পেল ঝোড়ো সমুদ্রে পাড়ি শেষ করে এক শান্ত স্বৰ্গে পৌছে, বিশ্বাস আর কর্মের এক নতুন শৃঙ্খলা খুঁজে পেয়ে, যে শৃঙ্খলা অমন ঝঙ্কাটময় সংশয়ের একটা সমাধান তাকে দিতে পারুল, দিতে পারল প্ৰকৃতির উপর যে আধিপত্যকে সে ইচ্ছের বিরুদ্ধে ত্যাগ করেছে, তারই একটা বিনিময়, বিনিময়টা যতই ঠুনকো হোক না কেন।” কিন্তু প্রশ্ন ওঠে; সহস্ৰ বছর ইন্দ্ৰজাল অভ্যাসের পর হঠাৎ এক সময়ে স্তর ফ্রেজারের ‘আদিম দার্শনিকটর’ মনে এই অসহায় ভাবে জাগল কেন, হঠাৎ বা কেন সে “প্ৰকৃতির উপর আধিপত্য” “ইচ্ছার বিরুদ্ধে পরিত্যাগ” করল? অর্থাৎ, ইন্দ্ৰজাল ছেড়ে মানুষ কেন এল ধর্মের আওতায়? এ প্ৰশ্নকে ফ্রেজার অগ্রাহ করেননি। কিন্তু তার দৃষ্টি বুর্জোয়ার দৃষ্টি, সংস্কৃতির সমস্ত ইতিকথাই সে-দৃষ্টিতে ব্যক্তি-বিশেষের অবদান। তাই তিনি উক্ত প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে বলছেন, প্রাচীনকালের “ধূৰ্ততর বুদ্ধিমানেরা” হঠাৎ যেন আবিষ্কার করল ইন্দ্ৰজালের বন্ধ্যাত্বি; বৃষ্টির নাচ নাচলে সত্যিই বৃষ্টি হবার কথা নয়। আর তাই এত অশান্তি, শেষ পৰ্যন্ত ইন্দ্ৰজাল ছেড়ে ধর্মের দিকে অগ্ৰগতি? সংস্কৃতিকে শুধু ব্যক্তিবিশেষের সৃষ্টি বলে ধরে নিলে এই রকম অর্থহীন। “হঠাৎ” দিয়ে বিজ্ঞানের অনেক ফাঁক পূরণ করতে হয়!
তবু প্রশ্ন ওঠে, সহস্ৰ বছর ধরে এমন-কী একজনও বেরুল না, যে ধরতে পারল ইন্দ্ৰজালের বন্ধ্যাত্বি? অতি বছর ধরে, অমন একটানাভাবে ইন্দ্ৰজাল টিকল কেমন করে? এ প্রশ্ন ফ্রেজার নিজেই তুলেছেন আর জবাবে বলেছেন : অনেক সময় ইন্দ্ৰজাল অনুষ্ঠানের পর বাস্তবিকই হয়তে হঠাৎ বাঞ্ছিত ফল ফলত। বৃষ্টি তো এমনিতেই মাঝে মাঝে হয়; হঠাৎ হয়তো ইন্দ্ৰজাল অনুষ্ঠানের পর–কিন্তু ইন্দ্ৰজাল অনুষ্ঠানের দরুন নয়, প্ৰাকৃতিক নিয়মেরই দারুন–আকাশ থেকে বৃষ্টি ঝরল। আর তাই মানুষের মনে বদ্ধমূল হলো ইন্দ্ৰজালে বিশ্বাস।
সমাজের পটভূমি তুচ্ছ করে শুধু খাপছাড়া আপতনের উপর নির্ভর করতে যাওয়া। অথচ, স্পষ্টই দেখা যায়, শুধু এই ক্ষীণ আর আপতিক অনুষঙ্গের সূত্র দিয়ে সহস্ৰ বছর ধরে মানুষের পক্ষে ইন্দ্ৰজালে বিশ্বাসের সঙ্গে বাধা থাকবার প্ৰসঙ্গ প্ৰায় হাস্যকর। হাজার বছর ধরে মাত্র কয়েকটি আচমকা ঘটনায় মোহিত হয়ে এবং লক্ষ লক্ষ বিরুদ্ধ দৃষ্টান্তকে অগ্ৰাহ করে মানুষের মনে টিকে রইল ইন্দ্ৰজালে বিশ্বাস! অথচ, সামাজিক পটভূমিটুকু মনে রাখলে এখানে কোনোরকম রহস্য থাকে না। হাজার বছর ধরে মানুষের মন ইন্দ্ৰজালে আস্থাবান ছিল, কেননা হাজার বছর ধরে ইন্দ্ৰজাল সত্যিই প্ৰকৃতিকে জয় করবার পথে তাকে সাহায্য করেছে। শ্রেণীবিভক্ত সমাজের মানুষ, শ্রেণীসমাজের দৃষ্টিকোণ থেকে ইন্দ্ৰজালের এই বাস্তব অর্থক্রিয়াকারিত্ব বুঝবে কেমন করে? ইন্দ্ৰজালকে আজ শুধু বন্ধ্যা ভ্ৰাস্তির ভূপ বলে মনে হয়, কেননা ইন্দ্ৰজালকে আমরা আমাদের সমাজের পরিপ্রেক্ষায় দেখতে চাই। আজকের দিনে কেউ যদি শিকার-নৃত্য করে, তাহলে তার শিকার সমাধা হবার বাস্তব সম্ভাবনা বাড়বে না। কিন্তু আদিম মানুষের বেলায় তো তা নয়। কেননা, তার জীবন সমবায়ের জীবন-একের সঙ্গে দশের সম্পর্ক অঙ্গাঙ্গী। ইন্দ্ৰজালের অনুষ্ঠান কোন মানুষের একার অনুষ্ঠান নয়, সমগ্ৰ সমাজের অনুষ্ঠান। তাই এই অনুষ্ঠান থেকে ষে প্রেরণা উদ্দীপ্ত, তা সমগ্ৰ গোষ্ঠীর মধ্যে সঞ্চারিত। বৃষ্টির নাচ। নাচতে নাচতে সমগ্ৰ গোষ্ঠীর সামনে দুলে উঠল বৃষ্টির ছবি-চোখের সামনে সেই ছবির প্রেরণা। ফসল জুটছে, ফসল জুটবেই, জুটবেই, জুটবেই-এই প্রেরণায় সঞ্জীবিত হয়ে পুরো দল যখন ফসলের সন্ধানে বেরুল, তখন তার বাস্তব সাফল্য অনেক বেশি সম্ভবপর।