আদিম প্ৰাগবিভক্ত সমাজের সংস্কৃতিতে প্রয়োগের তাগিদই বা অগ্ৰণী কেন? এর উত্তর জাদুঘরে গিয়ে সে-যুগের ভোঁতা হাতিয়ারগুলোর উপর চোখ বোলালেই বোঝা যায়। ওইরকম স্থূল হাতিয়ার হাতে সবাই মিলে পৃথিবীর সঙ্গে প্ৰাণপণ-সংগ্ৰাম করলে পরই কোনোমতে সবাইকার পক্ষে বাঁচতে পারা সম্ভব। তাই সংগ্রাম যতটুকু, ততটুকু প্ৰকৃতির সঙ্গেই। মানুষের সঙ্গে মানুষের সংগ্ৰাম নয়।
মানুষের উৎপাদন-শক্তি তখনো উদ্ধৃত্ত বলে কিছু সৃষ্টি করতে শেখেনি। বলেই একজনের শ্রমের উপর নির্ভর করে আর একজনের পক্ষে বাঁচা সম্ভব নয়। মেহনতের দায় প্ৰত্যেকের উপরই, মেহনত ছাড়া জীবনের অর্থ নেই। প্ৰকৃতিকে জয় করবার তাগিদটাই আদিম মানুষের কাছে আদি ও অকৃত্রিম তাগিদ; নাচ আর ইন্দ্ৰজালের মধ্যে এই তাগিদের প্রকাশ। শ্ৰীমতী হ্যারিসন দেখাচ্ছেন, আদিম মানুষের সমাজে মানুষের বয়েস বাড়ার আর এক নাম হলো নাচের সংখ্যা বাড়া, নাচে যোগ দিতে না পারাটা চরম লজ্জার লক্ষণ, বার্ধক্যের দরুন নাচে যোগ দিতে না পারলে মানুষ আপন কপালে করাঘাত করে; জীবনধারণের আর কোনো অর্থ খুঁজে পায় না।
প্ৰকৃত বিজ্ঞানের এই মূল ভিত্তিতে–প্ৰয়োগ-প্ৰাধান্য আর মুক্তির স্বরূপবোধে–সুদূর অতীতের অসভ্য মানুষ অচেতনভাবে আশ্রয় পেয়েছিল তার সমাজ-সংগঠনের দরুন। তারপর শ্রেণীবিভক্ত সমাজের ইতিহাসে মানুষ যখন ডাক শুনেছে শোষণের পালা শেষ করে দেবার, তখন আবার বিকশিত হয়েছে বিজ্ঞান। বিজ্ঞানের সঙ্গে বস্তুবাদের উপর ঝোঁকও। যেমনটা দেখতে পাওয়া যায় য়ুরোপে, মধ্যযুগ শেষ হয়ে নতুন যুগ শুরু হবার সময়। ইংলেণ্ডে বেকন-হবস, ফরাসী দেশের বস্তুবাদীর দল। কিন্তু ইতিহাসের অগ্রগতির মধ্যে দিয়ে দেখা গেল অতি মারাত্মক ধাঙ্গাবাজি লুকোনো ছিল সে-ডাকের পিছনে; এ-ডাক শোষণের পালা শেষ করবার আহবান নয়, একজাতীয় শোষণের বদলে আর একজাতীয় শোষণকে কায়েম করবার ডাক। আর, এই কথা সমাজের মধ্যে যতই প্রকট হতে লাগল, ততই ক্রমশ স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হলো বিজ্ঞানের সংকট। হাজার রকম কলাকৌশলের উন্নতি সত্ত্বেও, লক্ষ রকম চোখ-ধাধানো আবিষ্কারের কান-ফাটানো খবর রটিয়েও, আজ বিজ্ঞানের এই সংকট সম্বন্ধে খবরটুকুকে চাপা দেবার কোনো উপায় পাওয়া যাচ্ছে না। বিজ্ঞানের মধ্যে জায়গা জুড়ে বসতে চাইছে ভাববাদ। নিছক গবেষণারোয় সংকীর্ণ গণ্ডিটুকুর মধ্যে যতটুকু প্ৰয়োগ, তার উপর নির্ভর করেই বেঁচে থাকতে চাইল বিজ্ঞান, সামাজিক মেহনতের বিরাট পটভূমি আর বিজ্ঞানের পটভূমি হয়ে থাকতে পারল না।
সোভিয়েট বিপ্লবের মধ্যে শোনা গেল শোষণের পালা শেষ করবার ডাক। কিন্তু এ ডাক একজাতীয় শোষণ শেষ করে নতুন জাতের শোষণ পেশ করবার অভিসন্ধি নয়। সামাজিক মেহনতের হারানো পটভূমি ফিরে পাওয়া গেল বিজ্ঞানে, ঘোষিত হলো নিঃসংকোচ বস্তুবাদের জয়। তার ভিত্তিতে প্ৰয়োগ, সমষ্টির চেতনা আর মুক্তির স্বরূপ উপলব্ধি। আর তারই প্রেরণায় দিকে দিকে আজ মিলিত মহামানবের অগ্ৰগতি আগামী নিঃশ্ৰেণীক সমাজের দিকে-এই সমাজে বিজ্ঞান হবে সংকটমুক্ত, সমবেত মানবজীবনের উৎস থেকে প্রেরণা সঞ্চয় করে বিজ্ঞান আবার প্রতিষ্ঠিত হবে সুস্থ বস্তুবাদী ভিত্তির উপর।
তবু, আগামী কালের বিজ্ঞান অতীতের ইন্দ্ৰজালের স্তরে নিশ্চয়ই ফিরে যাওয়া নয়। তার সহজ কারণ, আগামী কালের নিঃশ্রেণীক সমাজ অতীতের অবিভক্ত শ্রেণীহীন সমাজের পুনরুক্তিমাত্র নয়। সমবায়ের দিক থেকে, মিলেমিশে একসঙ্গে থাকার দিক থেকে, মিল থাকলেও এ দুইয়ের ঐশ্বর্যে একেবারে আকাশপাতাল তফাত। অতীতের অবিভক্ত সমাজের কাহিনী নিতান্তই দারিদ্র্যের কাহিনী; মানুষ তখন স্থূল হাতিয়ার হাতে প্ৰকৃতির সঙ্গে সংগ্রামে প্ৰবৃত্ত, তার বাস্তব সাফল্য নেহাতই সংকীর্ণ–তাই দৈন্যের আর অভাবের অন্ত নেই। ওই অক্তাবের প্রতিষেধক হিসেবে মানুষ খুঁজেছে ইচ্ছাপুরাণ-বাস্তব বিজয়ের ফাকিটুকু কল্পনার বিজয় দিয়ে ভরাট করবার চেষ্টা। বজের ডাক-কে আয়ত্ত করে বজের শক্তিকে আয়ত্ত করার কথা। ইন্দ্ৰজালের এইটেই হলো আসল দৈন্য–এই ইচ্ছাপূরণ। দীন সমাজের প্রতিচ্ছবিইন্দ্ৰজালের মধ্যেও অনেকখানি দৈন্য না থেকে উপায় কী? এই দৈন্তের দরুনই, এই ইচ্ছাপূরণের চাপেই, ইন্দ্ৰজালের বস্তুবাদী ভিত্তিটুকু নেহাত অস্পষ্ট এবং অচেতন। আগামী নিঃশ্ৰেণীক সমাজের বাণী হলো প্রাচুর্যের বাণী-তাই দৈন্তের চাপ নেই তার তত্ত্বজিজ্ঞাসায়, আগামী কালের বিজ্ঞানে। সে বিজ্ঞান সুস্থ আর সংস্কারমুক্ত। তার বস্তুবাদী ভিত্তি স্পষ্ট ও সচেতন।
ইন্দ্ৰজাল থেকে ধর্ম। কেমনভাবে, ঠিক কোন প্রভাবের ফলে মানুষের সংস্কৃতির ইতিহাসে এই পরিবর্তন এল? এই পরিবর্তনকে বোঝবার কোনো উপায় নেই। বুর্জোয়ার দৃষ্টি দিয়ে। কেননা বুর্জোয়ার দৃষ্টিকোণ অনিবাৰ্যভাবেই ব্যক্তিবিশেষের দৃষ্টিকোণ, অথচ সংস্কৃতির স্তরে এই পরিবর্তন সামাজিক পরিবর্তনের প্রতিচ্ছবিমাত্র; তাই সামাজিক পরিবর্তনটুকুই ঐখানে একমাত্র মূলসূত্র।
সাম্যাবস্থা-বিচ্যুতি। ইন্দ্ৰজালের মৃত্যু এবং ধর্মের জন্ম-এই দুয়ের মূলসূত্রই পাওয়া যাবে এই সাম্যাবস্থা-বিচ্যুতির মধ্যে। একের সঙ্গে দশের সম্বন্ধ আর অঙ্গাঙ্গী সম্বন্ধ নয়, একের আর দশের জীবন-সমস্যা নয় অদ্বৈত। একের অনুপ্রেরণা আর দশের অনুপ্রেরণা হলো বিভিন্ন, বিচ্ছিন্ন হলো একের সিদ্ধি আর দশের সিদ্ধি। আদিম সাম্যাবস্থাই ছিল অতীত ইন্দ্ৰজালের মূল উৎস। মানুষের সঙ্গে মানুষের সংগ্ৰাম নয়, মানুষের সঙ্গে সংগ্ৰাম শুধু প্ৰকৃতির। এক অখণ্ড সমগ্রতার মধ্যে মানুষের জীবন, তার সংস্কৃতিটুকুও এই জীবন থেকে বিচ্যুত নয়। তাই সংস্কৃতিটুকুও সংগ্রামেরই অঙ্গ। ইন্দ্ৰজাল তাই প্রয়োগপ্ৰধান। আবার, সমাজ-জীবনে অখণ্ড সমগ্রতা বলেই মুক্তির যে অচেতন আদর্শ ইন্দ্ৰজালের অন্তরালে, তা শৃঙ্খলাকে ভাঙবার আদর্শ নয়,-শৃঙ্খলাকে স্বীকার করার মধ্যেই মুক্তি। তাই সংস্কৃতি হিসেবে ইন্দ্ৰজালের যে-দুটো প্ৰধান বৈশিষ্ট্য, তার মূলে রয়েছে সামাজিক অখণ্ডতার চেতনা। এই আদিম সাম্যাবস্থা-বিচ্যুতির মধ্যেই ইন্দ্ৰজালের মৃত্যুরহস্য।