কিন্তু এই সব কারণগুলির স্বরূপ কী? ফ্রেজারের মতে প্ৰধানত দুরকম। প্রথমত, ইন্দ্ৰজাল এবং ধর্মের মূল ধারণাকে বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে, ইন্দ্রজালের ভিত্তি হলো ধারণার অনুষঙ্গ (association of ideas), এবং ধর্মের ভিত্তি হলো প্ৰকৃতির অধিষ্ঠাতা-অধিষ্ঠাত্রী চৈতন্য-এবং-ব্যক্তিত্ব-সম্পন্ন দেবদেবীর কথা। এ কথা তো স্পষ্টই যে, ব্যক্তিত্ব-সম্পন্ন শক্তির ধারণা নিছক ধারণার অনুষঙ্গের চেয়ে অনেক জটিল এবং অনেক উন্নত। দ্বিতীয়ত,–এবং এইটেই হলো ফ্রেজারের বৈজ্ঞানিক মহত্ত্ব যে, পদে পদে তিনি পরিদর্শনের উপর নির্ভর করতে চান–পৃথিবীর বুকে আজও যে সব জাতি সভ্যতার নিম্নতম স্তরে পড়ে আছে, তাদের মধ্যে ধর্ম দেখা দেয়নি, আছে শুধু ইন্দ্ৰজাল। ফ্রেজার বলছেন, অষ্ট্রেলিয়ার আদিম অধিবাসীদের কথা। আশ্চৰ্য দেশ এই অষ্ট্রেলিয়া,–এর আকার অপেক্ষাকৃত ছোট, এর মধ্যে জলের অভাব এবং মরুদেশের প্রাচুৰ্য, এবং অন্যান্য মহাদেশের সঙ্গে এর যোগাযোগ না থাকার দরুণ আজও এই দেশ যেন “অতীত জিনিসের জাদুঘর” হয়ে রয়েছে। অন্যান্য দেশে যে-সব গাছগাছড়া আর পশুপাখি আজ লুপ্ত হয়ে গিয়েছে, সেইসব গাছগাছড়া আর পশুপাখি আজও এখানে টিকে আছে, এবং সেই সঙ্গে টিকে আছে আদিম মানবসমাজের নিদর্শনও। আর সে সমাজে ধর্মের চিহ্ন নেই, আছে ইন্দ্ৰজালের। মোটামুটি বলা যায়, ফ্রেজার বলছেন, অষ্ট্রেলিয়ার সব আদিম অধিবাসীই ইন্দ্ৰজাল-বিদ বা মায়াবী, কিন্তু পুরোহিত একজনও নয়। সভ্যতার এই নিম্নতম নিদর্শনে যদি দেখা যায় শুধু ইন্দ্রজাল, অপেক্ষাকৃত উন্নততর স্তরে ইন্দ্ৰজালের সঙ্গে ধর্মের মেশা মিশি-প্ৰাচীন ভারত, মিশর প্রভৃতি থেকে শুরু করে আধুনিক য়ুরোপের অপেক্ষাকৃত পিছনে-পড়ে-থাকা সমাজ পৰ্যন্ত-এবং সভ্যতার উচ্চতর স্তরে যদি দেখা যায় শুধু ধর্ম, তাহলে বুঝতে হবে সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে মানুষ ইন্দ্ৰজালকে পেছনে ফেলে ক্রমশ এগিয়েছে ধর্মের দিকে।
ফ্রেজারের বৈজ্ঞানিক নিষ্ঠা অসামান্য, এবং এক্ষেত্রে তাঁর সিদ্ধান্তও–ধর্ম এবং ইন্দ্ৰজালে জাতের তফাত, এবং এই দুয়ের মধ্যে ইন্দ্ৰজাল প্ৰাচীনতরঅবশ্যই স্বীকাৰ্য। এবং ইন্দ্ৰজালের প্রাচীনতার পক্ষে উপরোক্ত যে দুটি প্রমাণ তিনি দিয়েছেন, তার মধ্যে দ্বিতীয় প্রমাণের গুরুত্ব নিশ্চয়ই মানতে হবে। কিন্তু তার দুর্বলতা ও দৃষ্টির সংকীর্ণতা ধরা পড়ে উপরোক্ত প্ৰথম প্ৰমাণের মধ্যে। ইন্দ্ৰজাল প্ৰকৃতির অন্তর্নিহিত অমোঘ আইনকানুনকে আবিষ্কার করে প্রকৃতিকে জয় করতে চায়, ইন্দ্ৰজাল আধুনিক বিজ্ঞানেরই আদি পুরুষ-তবুও ইন্দ্রজালের তুলনায় ফ্রেজার ধর্মকে মহত্তর ও উন্নততর মানব-সংস্কৃতি মনে করতে বাধ্য হয়েছেন ৷ এক এই উন্নত লক্ষণ থেকেই প্ৰমাণ, ফ্রেজার মনে করেছেন, যে, ধর্ম উন্নততর মানব-সমাজের সংস্কৃতি। এখানেই ফ্রেজারের বুর্জোয়া দৃষ্টি তাঁর বৈজ্ঞানিক চেতনাকে আচ্ছন্ন করেছে।
বুর্জেয়া দৃষ্টিকোণের সংকীর্ণতা। সেই সংকীর্ণতা সাম্য-জীবনের স্বরূপএবং তারই প্ৰতিচ্ছবি যে সংস্কৃতিতে, সেই সংস্কৃতির স্বরূপকেও-বোঝাবার পথে পরিপন্থী। তাই, ইন্দ্ৰজাল থেকে ধর্ম, সংস্কৃতির ইতিহাসে এই পথটুকুকে বুঝতে হলে সামাজিক পরিপ্রেক্ষাকে মনে রাখা একান্তভাবে দরকার, মনে রাখা দরকার মানুষের পক্ষে আদিম শ্রেণীহীন সমাজ থেকে শ্রেণীবিভক্ত সমাজে এসে পড়বার কথা।
আদিম অবিভক্ত সমাজের পটভূমি ছাড়া ইন্দ্ৰজালকে বোঝবার উপায় নেই। কেননা, যত অস্পষ্টভাবেই হোক, যত অচেতনভাবেই হোক, ইন্দ্ৰজালের মধ্যে আধুনিক বিজ্ঞানেরই পূর্বাভাস। প্রকৃত বিজ্ঞানের দুটো প্ৰধান দিক ৷ এক হলো প্রয়োগের উপর ঝোক – উৎসাহটা প্ৰকৃতিকে জয় করবার, প্ৰকৃতির সঙ্গে সংগ্ৰাম করবার। আর দ্বিতীয় দিক হলো প্ৰকৃতিকে জয় করবার জন্যে প্ৰকৃতির অমোঘ নিয়মকে আবিষ্কার করবার চেষ্টা। অর্থাৎ প্ৰকৃত বিজ্ঞানের মূলে এ চেতনা বর্তমান যে, প্ৰকৃতির নিয়মকে চিনতে শেখার মধ্যেই মানুষের প্রকৃত মুক্তি। এই প্রয়োগনির্ভরতা এবং মুক্তির স্বরূপস্বীকারকে বিজ্ঞানের দুটো প্রধান দিক বলে মানতেই হবে, কেননা এর থেকে বিচুত হলে বিজ্ঞানকে লক্ষ্যভ্ৰষ্ট হতে দেখা যায়। যেমনটা হয়েছে আজকের যুগে : সামাজিক অর্থে প্রয়োগভ্ৰষ্ট ও মুক্তি সম্বন্ধে ভ্ৰান্তবিশ্বাস-বিলাসী তথাকথিত বিশুদ্ধ বিজ্ঞানের যে সংকট গত কয়েক বছর থেকে অত্যন্ত প্ৰকট হয়ে পড়েছে, তাকে ধামাচাপা দেবার উপায়ও আজ যেন নিঃশেষ।
মানুষের সেই আদিম সমাজে, সভ্যতার ওই সুদূর ও নিম্নতর স্তরে, মানুষের সংস্কৃতি কেমন করে এই সুস্থ চেতনার ভিত্তি খুঁজে পেয়েছিল? সমস্যা সন্দেহ নেই। এবং বুর্জোয়ার চুলচেরা বিচারেও এ সমস্যা সমাধানের কোনো মূলসূত্র পাওয়া সম্ভব নয়। কেননা, বুর্জোয়ার দৃষ্টিভঙ্গিই সংকীর্ণ, যে সংকীর্ণতা এই সমস্যা সমাধানের পরিপন্থী। বুর্জোয়ার দৃষ্টি ব্যক্তির ও ব্যষ্টির দৃষ্টি। এই দৃষ্টিতে আদিম সমাজকে বুঝতে পারাই সম্ভব নয়, কেননা সে সমাজ শ্রেণীহীন সমাজ, যেখানে জীবন সমবায়ের জীবন। সে সমাজের অন্তনিহিত স্বজনী উৎসকে বুর্জোয়ার দৃষ্টি আবিষ্কার করবে। কেমন করে? আদিম শ্রেণীহীন সমাজ : একের সঙ্গে দশের সম্পর্ক সংখ্যাগণিতের সম্পর্ক নয়, অঙ্গর সঙ্গে অঙ্গীয় সম্পর্ক। তাই সমগ্র সমাজের কল্যাণ ছাড়া ব্যক্তিবিশেষের মাথায় কল্যাণ সম্বন্ধে আর কোনো কল্পনা আসা কঠিন। মুক্তির রূপ ব্যক্তি-বিশেষের কোনোরকম স্বার্থসিদ্ধি নয়। সমাজের শাসন তখন শ্রেণী-বিশেষের স্বার্থে অনুপ্ৰাণিত হয়নি, তাই মানুষের কাছে সমাজখৃঙ্খলা শৃঙ্খল-এর রূপ নেয়নি ৷ শৃঙ্খলাকে ভেঙে ফেলবার কথা তাই ওঠেই না। বরং এই শৃঙ্খলাকে স্বীকার করা, একে মেনে নেওয়া-তার মধ্যেই মানুষের মুক্তির একমাত্র সম্ভাবনা। একের স্বার্থ আর দশের স্বাৰ্থ পৃথক নয়, দশের সিদ্ধির সঙ্গে একের সিদ্ধির ঘনিষ্ঠ মেশামিশি। সমাজ-শৃঙ্খলা যখন শ্রেণীস্বার্থে রক্ষিত হয়ে শৃঙ্খলের রূপ নেয়, শুধু তখনই মানুষের পক্ষে এই শৃঙ্খলাকে ভাঙবার অন্ধ তাগিদ ওঠে। আদিম প্ৰাগবিভক্ত সমাজে এই তাগিদ ওঠবার কথা নয়। ওঠেওনি। তাই, তার সংস্কৃতির পিছনেও মুক্তি বলতে শৃঙ্খলাকে চিনতে শেখাই বুঝিয়েছে, যদিও অস্পষ্ট, যদিও অচেতনভাবেই।