সমাজের এক-প্ৰান্তে একদল নিৰ্বোধ মানুষ। শুধু অন্নের উৎপাদনে নিজেদের শরীর-মন ক্ষয় করে ফেলুক। সমাজের আর-এক-প্ৰান্তে বিশুদ্ধ নিষ্কলুষ চিন্তায় মগ্ন আর একদল মানুষ সূক্ষ্মতম আধ্যাত্মিক সত্য আবিষ্কারই তাদের জীবনে পরম পুরুষাৰ্থ হয়ে থাকুক, আধ্যাত্মিক চেতনার চরমে পৌঁছে তারা হৃদয়ঙ্গম করুক, আনন্দই ব্ৰহ্ম। বিশুদ্ধ আনন্দই হলো বিশ্বরহস্যের চাবিকাঠি।
তাই মার্কস বলেছেন : আধ্যাত্মিক কাজ আর বাস্তব কাজ, এই দুয়ের মধ্যে বিভাগ দেখা দেবার আগে পৰ্যন্ত শ্রমবিভাগ প্ৰকৃত বিভাগে পরিণত হয়নি। সেই সময় থেকে মনে হতে পারে যে, চেতনাটা বাস্তব জগতের চেতনা ছাড়া বুঝি অন্য কিছু। চেতনা যখন থেকে সত্যিই এমন একটা কিছুকে বোঝাতে চায়, যা বাস্তব কিছু নয়, তখন থেকেই আমরা দেখতে পাই সর্ব-সম্পর্ক বিরহিত হয়ে এই চেতনা বিশুদ্ধ মতবাদ, ঈশ্বরতত্ত্ব, দর্শন, নীতিশাস্ত্ৰ প্ৰভৃতি নিয়ে একটা ধর্মমত-জাতীয় কিছুতে পরিণত হয়।
অবশ্য এ কথা ঠিক যে, ইন্দ্ৰজাল ছেড়ে মানুষের তত্ত্বজিজ্ঞাসা একেবারে এক ধাপে বিশুদ্ধ দার্শনিক ভাববাদে পৌঁছোয়নি; ইন্দ্ৰজালের পর ধর্ম, ধর্মেরই বিদগ্ধতম সংস্করণ ভাববাদ। যতদিন শ্রেণীবিভক্ত সমাজ, ততদিনই এই কথা,–ঘুরে ফিরে নানানভাবে নানান পথ দিয়ে যুগে যুগে ভাববাদেই তত্ত্বজিজ্ঞাসার পরিসমাপ্তি। তাই, শ্রেণীবিভক্ত সমাজের উচ্ছেদের মধ্যেই ভাববাদ খণ্ডনের মূলসূত্র। তাই মার্কস বলছেন : এতদিন ধরে দার্শনিকেরা নানানভাবে দুনিয়াকে শুধু ব্যাখ্যা করবারই চেষ্টা করেছেন, কিন্তু আসল কথা হলো একে বদল করা!
০৪. আদিম শ্রেণীহীন সমাজ
আদিম শ্রেণীহীন সমাজ ছেড়ে মানুষ এল শ্রেণীসমাজের আওতায়। কী করে, কোন প্ৰাখিব প্রভাবের ফলে অতীতের মানুষ ইতিহাসের এই পথটুকু অতিক্রম করল? হাতিয়ারের উন্নতি; এই উন্নতিই মানুষকে দেখাল। প্ৰকৃতির কাছে মুক দাসত্ব থেকে মুক্তি পাবার পথ, আবার এই উন্নতির কৃপাতেই একদল মানুষ ক্ৰমে ক্ৰমে বাকি সকলকে দাসত্ব-শৃঙ্খলে বাধতে পারল। সমাজের এই পরিবর্তন কীভাবে সংস্কৃতির স্তরে প্রতিফলিত হয়েছে, তার কথা মনে রাখতে হবে। আদিম শ্রেণীহীন সমাজ থেকে শ্রেণীসমাজ। আর তারই প্ৰতিচ্ছবি : ইন্দ্ৰজাল থেকে ধর্ম।
ইন্দ্ৰজাল থেকে ধর্ম। তার মানে কিন্তু এই নয় যে, ধর্ম ইন্দ্ৰজালের উন্নত আর সংস্কৃত সংস্করণমাত্র। বুর্জোয়া পণ্ডিত-মহলে এই ভ্ৰান্ত ধারণা ঘুরে ফিরে অনেকবার দেখা দিয়েছে। অনেকেই চেষ্টা করেছেন ইন্দ্ৰজালের মধ্যেই ধর্মের উৎস খুঁজতে, অনেকে চেয়েছেন ধর্মকে ইন্দ্ৰজালেরই সভ্য সংস্করণ বলে প্রচার করতে। যেন আদিম মানুষের অন্বেষণ-বৃত্তি প্রথমটায় অতি স্থূল আর প্রাকৃত তত্ত্ববোধে আশ্রয় পেয়েছিল, তারই নাম ইন্দ্ৰজাল; ক্ৰমে সেই তত্ত্ববোধ উন্নত আর সংস্কৃত হতে হতে ধর্মের রূপ নিল। অর্থাৎ এই বিচার অনুসারে ইন্দ্ৰজাল আর ধর্ম-র মধ্যে গুণগত তফাত–জাতের তফাত–যেন নেই। তফাত যেটুকু, সেটুকু নেহাতই স্কুলের সঙ্গে সুন্মের তফাত।
অথচ, জাতের তফাতটাই দুয়ের মধ্যে আসল তফাত। ভুয়োদর্শনের সুস্থ প্রভাবের ফলে স্তর জেমস ফ্রেজারের বুর্জোয়া দৃষ্টিও এই বিষয়কে উপেক্ষা করতে পারেনি। তিনিও মানছেন যে, ইন্দ্ৰজালের সঙ্গে ধর্মের শুধু উদ্দেশ্য ভেদই নয়, উপায়-ভেদও বর্তমান। ইন্দ্ৰজালের উদ্দেশ্য হলো প্ৰকৃতিকে বশ করা; প্ৰকৃতিকে জয় কৱা; ধর্মের উদ্দেশ্য হলো দেবতাকে সন্তুষ্ট করে তার কাছে কৃপা ভিক্ষা করা। জয় করা আর ভিক্ষা চাওয়া–উদ্দেশ্যের দিক থেকে গুণগত প্ৰভেদ বই কী। তা ছাড়া, উপায়ের দিক থেকেও তফাতটা অত্যন্ত গভীর ও গুরুতর : প্ৰকৃতিকে বশ করতে গিয়ে ইন্দ্ৰজাল আবিষ্কার করতে চায় প্ৰাকৃতিক নিয়ম-কানুনকে–প্ৰকৃতির রাজ্যে কাৰ্য-কারণ সম্বন্ধকে। তাই, যত অস্পষ্ট আর যত অব্যক্ত ভাবেই হোক না কেন, ইন্দ্ৰজালের পেছনে নিশ্চয়ই এই বিশ্বাসই নিহিত যে, প্ৰকৃতির দাসত্ব থেকে মুক্তির একমাত্র পথ হলো প্ৰকৃতির অমোঘ নিয়মকে চিনতে পারা। ইন্দ্ৰজালের যা প্ৰাপ্য, তার চেয়ে বেশি। উজ্জ্বাস করবার প্রয়োজন নেই-প্রকৃতির দাসত্ব থেকে মুক্তির আসল পথ যে প্ৰকৃতির নিয়মকেই চিনতে শেখা, এই বোধ ইন্দ্ৰজালের পেছনে অব্যক্ত ও অচেতন। কল্পনার কুত্মটিকায় আবিল, তবু এই বোধের অস্তিত্বটুকুকে উড়িয়ে দেওয়া কোনো কাজের কথা নয়। অপর দিকে ধর্মের পেছনে উপায় হিসেবে কোন বোধের উপর নির্ভরতা? প্রার্থনা দিয়ে করুণার উদ্রেক, স্তবস্তুতির খোশামোদ দিয়ে মন গলানো, আহুতির ঘুষ দিয়ে হাত করা। মানুষের প্রথম ধর্ম চেতনা-সব দেশের বেলাতেই মোটামুটি একই রকম-প্ৰকৃতির অধিষ্ঠাতা আর অধিষ্ঠাত্রী দেবদেবীর সন্ধান করেছে ৷ প্ৰকৃতির রাজ্যে নিয়মের সন্ধান নয়, কেননা এইসব দেবদেবীর মধ্যে আর যাই থাক, নিয়মের শৃঙ্খলা বলে কিছু নেই। খেয়ালী বড়লোকদের মতো এই সব দেবদেবীর দল; অসীম তাদের শক্তি; তবু ভিক্ষে চাইলে তারা ভিক্ষে দিতেও পারে, খোেশামোদ শুনলে খুশি হয়, ঘুষ পেলে সিদ্ধি দেয়।
এবং ফ্রেজার ঠিকই বলেছেন যে, আসলে বিজ্ঞানের সঙ্গে ধর্মের যে বিরোধ, মােটামুটি সেই বিরোধই ইন্দ্ৰজালের সঙ্গে ধর্মের, কেননা अभि रेखांबांनी आधूनिक दिखांप्नब्ररे आनि-भूक्ष। ज्ञ् ऊारेनब्र,-नानांन দেশে নানানভাবে ইন্দ্ৰজাল আর ধর্মের মেশামেশি। সত্ত্বেও,-ফ্রেজার স্পষ্টই অনুভব করেছেন যে, ইন্দ্ৰজাল-কে ধর্মের চেয়ে প্রাচীন বলে স্বীকার করতেই হবে। “যদিও বহু যুগে বহু দেশে দেখতে পাওয়া যায়, ইন্দ্ৰজাল আর ধর্ম মিশে রয়েছে, তবুও কয়েকটি কারণের দরুন মনে করা উচিত যে, এই মেশামিশি আদিম নয়।”