মাথা খাটানো আর গতির খাটানো, পৃথিবীকে চেনা আর পৃথিবীকে বদল করা, কর্ম আর জ্ঞান – শ্রেণীবিভাগ দেখা দেবার পর থেকে যেন চিড় খেয়ে দুভাগে ভাগ হয়ে গেল। যতদিন দল বেঁধে সমানে সমান হয়ে বাচ, ততদিন মেহনতের উলটো পিঠেই চেতনা, কর্মের উলটো পিঠেই জ্ঞান, দুয়ের মধ্যে সম্পর্ক বড় নিবিড়। অবশ্যই একথায় কোনো সন্দেহ নেই যে, তখন পর্যন্ত মানুষের হাতিয়ার অনেক স্থূল, তাই মেহনতটাও নেহাতই অনুন্নত, পৃথিবীকে বদল করবার চেষ্টায় বাস্তব সাফল্য নেহাতই সংকীর্ণ। তাই তার উলটো পিঠে যে-চেতনা, সেই চেতনাও অনেকখানি স্থূল, অনেকখানিই ভ্ৰান্ত কল্পনা দিয়ে ভরা। তবু চেতনায় মেহনতে আত্মীয়তা, যে-আত্মীয়তা ঘুচল শ্রেণীসমাজ দেখা দেবার সময় থেকে।
যাকে আমরা দর্শনশাস্ত্ৰ বলি, কিংবা আরো নিখুঁতভাবে বললে, যাকে বলা উচিত অধিবিদ্যা বা metaphysics, তার জন্ম-ইতিহাসের আসল রহস্যটা বুঝতে গেলে মূলসূত্র অনুসন্ধান করতে হবে এইখান থেকেই, সমাজের এই শ্ৰেণীবিভাগ থেকেই। তার মানে এই নয় যে, সমাজে শ্রেণীবিভাগ দেখা দেবার সঙ্গে সঙ্গেই জন্ম হয়েছে অধিবিদ্যা বা দর্শনশাস্ত্রের। এইভাবে বুঝতে যাওয়াটা যন্ত্রকে বুঝতে যাওয়ার মতো হবে–অর্থাৎ ভুল হবে। তার মানে, হঠাৎ কোনো এক মুহুর্তে ভূমিকম্প হওয়ার মতো সমাজ-জীবনে শ্রেণীবিভাগ ফুটে ওঠেনি। আর কল টিপলেই যে-রকম জল পড়ে, সেইরকমভাবে শ্রেণীবিভাগ দেখা দেবার সঙ্গে সঙ্গে কিন্তু জন্ম হয়নি। অধিবিদ্যার আর ভাববাদের। তবু একথাতেও কোনো সন্দেহ নেই যে, যাকে আমরা দর্শনশাস্ত্র বা অধিবিদ্যা বলতে অভ্যস্ত, তার বীজ এই সামাজিক শ্রেণীবিভাগের মধ্যেই; সে বীজ ফলে-ফুলে শোভিত। হয়ে মহীরূহের রূপ নিতে ঐতিহাসিকভাবে অনেক দিন সময় নিয়েছিল নিশ্চয়ই! তবু, সামাজিক শ্রেণীবিভাগের কথাটা ভুলে গেলে দর্শনশাস্ত্রের আসল রহস্যটুকু বুঝতে পারা যাবে না। কেননা, এই অধিবিদ্যা বা দর্শনশাস্ত্রের আসল কথা হলো, বিশ্বের আসল রহস্যকে জানতে চাওয়া-শুধু জানা, শুধু নির্মল, নির্লিপ্ত জ্ঞান। অন্তত, দর্শনশাস্ত্রের যারা ডাকসাইটে পণ্ডিত, তেঁারা মোটের উপর এই কথাটাই মেনে নিয়েছেন। দুনিয়া নিয়ে মাথা ঘামানো, বিশুদ্ধ বুদ্ধি দিয়ে পরম সত্যের একটা বৰ্ণনা খোজা,-দুনিয়াকে বদল করবার কথা নয়।
মেহনত পড়ল চোখের আড়ালে, মেহনতের দাবিটা আর আসলে বড় দাবি হয়ে রইল না। সমাজের সদর মহলে শেষ পৰ্যন্ত চেতনার দাবিটাই চূড়ান্ত দাবি হয়ে দাঁড়াল। এ-চেতনা কিন্তু বিশুদ্ধ চেতনা, মেহনতের সঙ্গে তার সম্পর্ক নেই,- আর মেহনতের সঙ্গে সম্পর্ক নেই বলেই মাটির পৃথিবীর সঙ্গেও সম্পর্ক নেই! কেননা, একমাত্র কাজের মানুষই মাটির পৃথিবীর মুখোমুখি। মেহনতের সময় যখন যুঝতে হয় পৃথিবীর সঙ্গে, তখন না বুঝে উপায় নেই, এই পৃথিবীটা কী নিৰ্ঘাত এক বাস্তব। লাঙল দিয়ে মাটি চাষবার সময় এ-প্ৰশ্ন আর মাথায় আসে না যে, লাঙলটা বাস্তবিকই সত্যি, না মনের একটা ভুল মাত্র, যেমন মনের ভুল হলো অন্ধকার জায়গায়দাঁড়িতে-দেখা সাপ। মাথায় আসে না, খেতটা বাস্তব জিনিস কি-না, তাই নিয়ে মাথা ঘামাবার কথা। কাস্তে হাতে ফসল ফলাবার সময় এ-কথা না-মেনে উপায় নেই যে, কাস্তে আর ফসল দুই-ই হলো অবধারিত সত্য; কামারশালে হাতুড়ি পেটবার সময় টের পাওয়া যায়, হাতুড়ি আর লোহা দুই-ই কী রকম সত্যি জিনিস। কাজের মানুষ বাস্তব দুনিয়ার মুখোমুখি; তার যে চেতনা, সেই চেতনা এই বাস্তব দুনিয়ার প্রতিবিম্ব ছাড়া আর কিছুই নয়।
কিন্তু সমাজে শ্রেণীবিভাগ দেখা দেবার সময় থেকে মেহনতের দায় আর চেতনার দায়,-গতর খাটাবার দায় আর মাথা খাটাবার দায়- দুয়ের মধ্যে সম্পর্ক ভেঙে গেল। যাদের উপর গতরা খাটাবার দায়, তাদের উপর শুধুই গতির খাটাবারই দায়; বাদের উপর মাথা খাটাবার দায়, তাদের উপর শুধুই মাথা খাটাবারই দায়। শুধু তাই নয়। সামাজিক ভাবে মেহনত থেকে বাদ পড়ল মৰ্যাদা। মেহনতকারীর দল হলো নেহাতই অস্পৃশ্য; ওদের মুখ দেখলে পাপ, ওদের ছায়া মাড়ালে পাপ। তাই যারা মাথা খাটায়, তাদের চোখের আড়ালে পড়তে চাইল। এই পৃথিবীটা, যে পৃথিবীর সঙ্গে অস্পৃশ্য মেহনতকারীদের অমন নাড়ির সম্পর্ক। ওরা মশগুল হয়ে উঠল শুধু চেতনাকে নিয়ে–সে-চেতনা বুঝি বাস্তব দুনিয়ার চেতনা নয়–নিছক চেতনা, স্বাধিকারপ্ৰমত্ত স্বয়ত্ত্ব, সর্বশক্তিমান। ফলে এই বিশুদ্ধ চেতনাটাই হয়ে দাঁড়াল আসল সত্য, চরম সত্য। চেতনার দাবিই হলো চরম দাবি, যে জিনিস চেতনার দাবি চোকাতে পারবে না, সে-জিনিস সত্যি হতে পারে না।
এ-কথা অবশ্যই শাসকরাও বুঝেছিল যে, অন্নের উৎপাদন না হলে শেষ পৰ্যন্ত কিছুই টেকে না; কিন্তু তাই বলে অন্নের এই উৎপাদনকেই ধ্রুব আদর্শ বলে মনে করা নেহাতই স্থূল দৃষ্টির পরিচয়! উপনিষদের ভৃগুবরণ সংবাদ-এ এই মনোবৃত্তিরই স্বাক্ষর। বরুণের ছেলে ভূগু-র ইচ্ছে হলো সবচেয়ে চরম সত্যকে জানিবার, তাই বাবার কাছে গিয়ে ভূণ্ড বললেন : ব্ৰহ্ম কী, সে-বিষয়ে আমাকে উপদেশ দিন। বরুণ বললেন : ব্ৰহ্ম সম্বন্ধে একটা বৰ্ণনা শুনলেই ব্ৰহ্মকে তুমি যে জানতে পারবে, এমন আশা নেই; তুমি তপস্যা করো, তপস্যা করলেই ব্ৰহ্মকে জানতে পারবে। (‘তপস্যা’ -দৈনন্দিন প্রয়োগ থেকে অনেক দূরের কথা, বিশুদ্ধ চেতনায় আশ্রয় নেবার কথাই)। তবে একটা মূলসূত্র পেলে তপস্যা করবার সুবিধে হয়। বরুণ তাই মূলসূত্র হিসেবে ছেলেকে বলে দিলেন—‘যতো বা ইমানি ভূতানি জায়ন্তে’, ইত্যাদি। অর্থাৎ, যার থেকে এই সমস্ত জিনিস জন্মেছে, জন্মাবার পর যার উপর নির্ভর করেছে এবং শেষ পর্যন্ত যার মধ্যেই তা বিলীন হয়ে যাবে, তাই হলো ব্ৰহ্ম। এই মূলসূত্রকে অবলম্বন করে ভৃগু তপস্যায় বসলেন, আর তপস্যা করে এসে বললেন; বাবা বুঝেছি, অন্নই হল ব্ৰহ্ম। কেননা অন্ন থেকেই এই সমস্ত উৎপন্ন, ইত্যাদি। বরুণ বললেন : হলো না। কেননা, এ যে নেহাতই স্থূল দৃষ্টির কথা। ভৃগু আবার তপস্যা করতে গেলেন, আর তারপর ফিরে এসে বলেন : বুঝেছি বাবা, অন্ন নয় প্রাণ। বরুণ বললেন : হলো না, আবার তপস্যা করো। তৃতীয়বারের তপস্যায় ভূণ্ড বললেন : মনই হলো ব্ৰহ্ম। চতুর্থবারের তপস্যায় তার মনে হলো : বিজ্ঞানই ব্ৰহ্ম। কিন্তু বরুণ, বললেন; এখনো হয় নি, আরো তপস্যা করতে হবে। শেষবার চরম তপস্যা করে ভৃগু বুঝতে পারলেন, আসলে অন্ন নয়, প্ৰাণ নয়, মন নয়, বিজ্ঞান নয়, –আনন্দই হল ব্ৰহ্ম। আনন্দ থেকেই সব কিছুর জন্ম, ইত্যাদি। শ্রেণীবিভক্ত সমাজে শাসক-শ্রেণীর ভঙ্গি এই উপাখ্যানের ব্যঞ্জনা হয়ে রয়েছে। শুরুতে অন্ন, অন্ন না হলে সমাজের ভিতই যে গাথা হয় না। কিন্তু তাই বলে অন্নকে চরম সত্য হিসেবে স্বীকার করা নেহাতই ছোটলোকমির পরিচয়! স্থূলদুষ্টর অল্পবুদ্ধি মানুষ অন্নকে স্বীকার করুক, নুয়ে পড়ুক অন্ন উৎপাদনের দায়িত্ব কঁাধে নিয়ে। অবশ্যই, শুধু অন্ন উৎপাদনের দায়িত্বই, শুধু কর্মের দায়িত্বই; তাই বলে কর্মফলে অধিকার তো নয়। যারা উচ্চস্তরের মানুষ, কর্মফলের অধিকার তাদের বলেই কর্মজীবনের দায়িত্ব থেকে তারা মুক্ত। তাই তারা ওই ছোটলোকদের মতো অন্ন উৎপাদনের দায় নেবে কেন? তারা এগিয়ে চলুক ধাপে ধাপে অধ্যাত্ম সত্য আবিষ্কারের পথে। ক্রমশ সূক্ষ্ম থেকে সুক্ষ্মতর সত্যের আবিস্কার-শেষ ধাপে আনন্দ, শুধু বিশুদ্ধ চৈতন্যের আনন্দ, আনন্দই ব্ৰহ্ম।