কামারকে দেখেছি কামারশালে কাজ করতে। আগুনের মুখে হাপর নিয়ে সে দিনরাত বসে রয়েছে; ওইরকমভাবে একটানা বসে থাকতে থাকতে তার গায়ে পচা আর আঁশটে গন্ধ হয়ে গিয়েছে, … …। খোদাইকর সমস্ত দিন একটানাভাবে কঠিন পাথর কেটে চলেছে, তারপর দিনের শেষে হাত দুটো যখন তার নেহাতই চলতে আর চায় না, তখন হয়তো সারা দিনের মজুরি বাবদ দুমুঠে খাবার জুটল; কিন্তু পরের দিন সুৰ্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে যদি সে আবার কাজে না লাগে, তাহলে তার পিঠের দিকে হাত দুটো শক্ত করে বেঁধে … …। রাজমিস্ত্রির কথা বলব? পরনের কাপড় বলতে তার কোমরে শুধু একটা নেংটি, কাজ করতে করতে তার আঙুলগুলো ক্ষয়ে গিয়েছে, কিন্তু তার যদি খিদে অসহ্য হয়, তাহলে নিজের হাত কামড়ানো ছাড়া আর কোন উপায় নেই।… …হাঁটু দুটো বুকে দুমড়ে চেপে তাঁতি সমস্ত দিন ধরে তাঁত বুনছে, তাই সমস্ত দিন সে ঘরের মধ্যে বন্দি,–“সুর্যের আলো দেখবার জন্যে প্ৰাণটা যদি কখনও একান্ত ব্যাকুল হয়, তাহলে দোরের পাহারাদারকে নিজের রুটিটুকু ঘুষ না দিয়ে উপায় নেই। … … -মুচি যেন সারাটা দিন ধরে কাতরাচ্ছে, তার শরীর পচে গিয়ে পচা মাছের গন্ধ, আর যখন তার পেটের জ্বালা একেবারে অসহ্য হয়ে: ওঠে, তখন তার পক্ষে চামড়ায় দাত ফোটানো ছাড়া আর কোনো গতি নেই……
নীল নদের ধারে মানুষের যে সভ্যতা গড়ে উঠেছিল, এই তার অন্দর মহলের আসল চেহারা। কিন্তু শুধু মিশরই বা কেন? এর পাশাপাশি তুলনা করে দেখুন, আমাদের দেশে শ্রেণীসমাজে শূদ্র সম্বন্ধে মনোভাব “মানব” ধর্মে কীভাবে প্ৰকাশ পেয়েছে; তুলনা করলেই বোঝা যাবে, বিভিন্ন প্রাচীন সভ্যতার খোলসগুলোয় যতই তফাত থাক না কেন, সে-সব খোলস ছাড়ালে সবগুলিরই চেহারা মোটামুটি এক :
উচ্ছিষ্টমন্নং দাতব্যং জীর্ণানি বসনানি চ।
পুলকাশ্চৈব ধান্যানাং জীর্ণাশ্চৈব পরিচ্ছদা:।
–শূদ্রের জন্যে ছেঁড়া মাদুর, জীর্ণ বসন, উচ্ছিষ্ট অন্ন।
নোঙর ছবি সন্দেহ নেই। কিন্তু কোনো আধুনিক রাজনীতিকের কল্পিত প্রচার-পত্র নয়।
এ-হেন যে জনগণ, এদের পক্ষে মাথা খাটিয়ে বিশুদ্ধ জ্ঞান চর্চার কথা নিশ্চয়ই ওঠে না। ভগবান কী রকমের সুতো দিয়ে স্বৰ্গ থেকে পৃথিবীকে বুলিয়ে রেখেছেন? তিনি কেন সৃষ্টি করলেন মানুষকে, আর মানুষের মধ্যে সেরা মানুষ ফেয়ারোকে? পশ্চিমের কোন পাহাড়ের পিছন দিকে মৃত আত্মার জমায়েত? –এ সব প্রশ্ন জনগণের মাথায় ওঠে নি। মানুষকে এই জনগণ অমৃতের পুত্র বলে কল্পনা করবে। কেমন করে? কখন এরা বসে ভাববো : ওঁ উষা বা অশ্বস্য মেধ্যস্য শিরঃ। ‘সোহং ব্ৰহ্ম’ বা ‘তত্ত্বমসি শ্বেতকেতু’, কিংবা ওই ধরনের কোনো মহাবাক্যও এদের কারুর ঠোঁটে ফুটে ওঠবার কথা নয়। শ্রেণীবিভক্ত সমাজ। প্ৰকৃতির সঙ্গে সমবেত সংগ্ৰাম নয়। আর। আসলে সংগ্রাম বেটুকু, সেটুকুর দায় লুষ্ঠিত শোষিত জনগণের উপর; জীবন তাদের কাছে বোঝামাত্র, চিন্তার জাল বোনা দূরে থাকুক, মরবার ফুরন্থতটুকুও তাদের যেন নেই। গতির খাটিয়ে শরীর ক্ষয় করার পথই যেন তাদের সামনে একমাত্র পথ।
আর অপরদিকে মুষ্টিমেয় শোষকের দল। প্ৰকৃতির সঙ্গে লড়াই করবার হাতিয়ার তখন যতই অনুন্নত আর স্থূল হোক না কেন, শোষণের পদ্ধতি এত নির্লজ আর অকুণ্ঠ যে, শোষকের ঘরে বিলাসের প্রাচুর্য। তাই তাদের কাছে প্রয়োগের তাগিদ, প্ৰকৃতির সঙ্গে সংগ্রামের তাগিদ এতটুকুও নেই; নিছক চিন্তার জাল বোনাই সহজ আদর্শ। যারা খেতি চষে, কাপড় বোনে, পাথর কাটে, প্ৰাসাদ গড়ে, তারা নেহাতই ছোটোলোকের দল; গতির খাটানোটা ইতরের লক্ষণ, মাথা খাটানোর মধ্যেই মানবাত্মার চরম উৎকর্ষ।
মিসমার হয়ে গেল মেহনতের মর্যাদা। কেননা, সভ্যতার যেটা সদর মহল, যেখানে মালিকদলের জমকালো দরবার, সেখানে আর মেহনতকারী মানুষের ঠাই রইল না। মালিকদের পক্ষে দায় নেই মেহনত করবার, গতর খাটাবার। মাথা খাটিয়েই তারা ঠিক করে দেবে, কোনখানে কারা কেমনভাবে মেহনত করবে,-ফসল ফলাবে, কাপড় বুনবে, কাটবে। পাথর, গড়বে ইমারত। কিন্তু যে ক্রীতদাসের দল এই মেহনত করবে, তারা রইল চোখের আড়ালেই, পাইক-পেয়াদার চাবুক দিয়ে ঘেরা ছোট গণ্ডিটুকুর মধ্যে। তাই শ্রেণীবিভাগ দেখা দেবার পর থেকে যে-মন দিয়ে, যে-বুদ্ধি দিয়ে মেহনতের পরিকল্পনা, সেই মনের সঙ্গে, সেই বুদ্ধির সঙ্গে মেহনতকারী হাতের সম্পর্ক গেল ঘুচে। রাজদরবারে বসে মিশরের রাজা আর সভাসদেরা মিলে হয়তো পরিকল্পনা করল, মরুভূমির বুকে পাথর দিয়ে গাথা হােক বিশাল, বিরাট, পিরামিড। কিন্তু শুধু মাথা ঘামিয়ে এই পরিকল্পনাটুকু করেই তো সত্যিকারের পিরামিড গড়া হয় না। তার জন্যে আসলে দরকার লক্ষ মানুষের রক্ত-জাল-করা মেহনত, দীর্ঘ মেহনত। কিন্তু এই মেহনতটা সমাজের সদর মহলের আড়ালে, তাই চোখে পড়ে না। এই মেহনতের দায় ক্রীতদাসের উপর, শূদ্রদের উপর, ছোটলোকদের উপর। তাই এর মৰ্যাদা নেই। দিনের পর দিন মানুষ সভ্যতার কত আশ্চৰ্য চিহ্নই না গড়ে তুলতে লাগল। কিন্তু সভ্যতার এত আশ্চর্য কীর্তির মূলে আসল অবদান যে মেহনন্তের, সেই কথাটা আর মনে রইল না। মানুষ মনে করল, এত সব কীর্তির আসল যে-গৌরব, তা হলো মানুষের মনের, বুদ্ধির, চেতনার। অথচ, চেতনা বা মন বা বুদ্ধি – সব কিছুই যে শেষ পৰ্যন্ত মানুষের মেহনতের কাছে ঋণী, এই কথাটুকু ভুলে গেল মানুষ।