উভয় উদ্ধৃতিকে দীর্ঘতর করবার প্রলোভন সংবরণ করতে হয়; তবু এটুকু থেকেই আদিম মানুষের নাচে-ইন্দ্ৰজালে মেশা প্ৰাগ্বিভক্ত সংস্কৃতি সম্বন্ধে কয়েকটা মূলসূত্র আবিষ্কার করা যাবে।
প্রথম এ-সংস্কৃতি একের নয়, দশের; ব্যষ্টির নয়, গোষ্ঠীর। বিদগ্ধ ব্যক্তি বা বিদগ্ধ সমাজ বলে আলাদা কিছু নেই, সংস্কৃতি যতটুকু তাতে সকলেই সমান অংশীদার। দ্বিতীয়ত, এ-সংস্কৃতির প্রধান উদ্দেশ্য প্রয়োগ, কর্ম, প্ৰকৃতিকে জয় করা। বিশুদ্ধ জ্ঞান চর্চা বা অবসর বিনোদনের তাগিদ নয়, তাগিদ যেটুকু, সেটুকু কাজের তাগিদ। প্রয়োগের খাতিরেই জ্ঞান, আবার জ্ঞানের দরুন প্রয়োগের উন্নতি-জ্ঞান আর কর্ম পৃথক হয়ে পড়েনি, জ্ঞান আর কর্মের প্রাগ বিভক্ত সমন্বয়। তৃতীয়ত, চেতনকারণবাদের দিকে, ধর্মের দিকে, ভাববাদের দিকে ঝোক নেই। ঝোকটা বহিঃপ্রকৃতিকে বশ করবার দিকে, বহিঃপ্রকৃতির অমোঘ নিয়মকে আবিষ্কার করবার দিকে, এক কথায় বস্তুবাদের দিকেই। তাই বলে সচেতন জড়বাদের উপর ইন্দ্ৰজালের প্রতিষ্ঠা সত্যিই নয়; তা হবার কথাও নয়। আদিম অসভ্য মানুষ দল বেঁধে প্রকৃতিকে জয় করবার চেষ্টা করত, কিন্তু তখন তার সামর্থ্য অতি ক্ষীণ, তার সার্থকতা নেহাতই সংকীর্ণ। বৃষ্টির নাচ নাচলে সত্যিই এমন কিছু বৃষ্টি পড়ার বাস্তব সম্ভাবনা নেই, শিকারের নাচ নাচলেই এমন কিছু মৃগয়া সমাধা হবার কথা নয়। বাস্তব সাফল্যের সংকীর্ণতাকে কাল্পনিক সাফল্য দিয়ে পুরণ করা। ইন্দ্ৰজালের তাই অনেকখানিই ইচ্ছাপুরণ। তবুও তখন এই ইচ্ছাপূরণটুকুও জীবনসংগ্রামের অঙ্গ। এ ইচ্ছাপুরাণ বাস্তব সংগ্রামে উদ্দীপনা জুগিয়েছে। অনেক মানুষ দল বেঁধে একসঙ্গে নাচছে। বৃষ্টির নাচ, কিংবা ভালুক শিকারের নাচ। নাচছে আর ভাবছে, বৃষ্টিকে জয় করা গিয়েছে, জয় করা গিয়েছে শিকার। বৃষ্টি এবার পড়বেই পড়বে, শিকার এবার জুটবেই জুটবে। তারপর দল বেঁধে একসঙ্গে বেরিয়ে পড়া-মনের সামনে দুলছে কামনা সফল হবার ছবি, আর সেই ছবির কাছ থেকে পাওয়া প্রেরণার ফসল জোগাড় করা, শিকার সমাধা করা অনেক বেশি সহজ! এই প্রেরণাটুকু বাদ দিলে তখনকার ওই ভোঁতা হাতিয়ার হাতে পৃথিবীর সঙ্গে সংগ্রাম অনেক দুরূহ হয়ে দাঁড়াত। তাই ইন্দ্ৰজাল তখন প্ৰকৃতিকে জয় করবার পথে মানুষকে এগিয়ে নিয়ে গেছে অনেক বেশি করে, অনেক ভালো করে।
তারপর প্রকৃতির সঙ্গে দিনের পর দিন একটানা সংগ্রামের চেষ্টায় উন্নত হলো মানুষের হাতিয়ার, আর তাই উৎপাদনশক্তি। মানুষ উৎপাদনা করতে শিখল নিছক বেঁচে থাকবার জন্যে যেটুকু জিনিস দরকার, তার চেয়ে অনেক বেশি জিনিস প্রকৃতির কাছ থেকে সংগ্ৰহ করতে, আর তখন থেকেই সম্ভব হলো অনেকের শ্রমের উপর নির্ভর করে কয়েক জনের পক্ষে শ্রমজীবনে অংশ গ্ৰহণ না করেও বেঁচে থাকা। ফলে, সেই আদিম সাম্যাবস্থা-বিচ্যুতি। শ্ৰেণীহীন সমাজ ভেঙে দেখা দিল নতুন সমাজ; সে সমাজে শ্রেণীবিভাগ, অতএব শ্রেণীসংগ্রামও। আর দেখা দিল ভাববাদ। ইন্দ্ৰজালের বদলে ধর্ম, আর ধর্মেরই সংস্কৃত সংস্করণ ভাববাদ। প্রয়োগের পরিবর্তে নিছক তত্ত্বজিজ্ঞাসার উৎসাহ। অব্যক্ত বস্তুবাদ বা জড়বাদের দিকে ঝোঁক ছেড়ে চেতনকারণবাদের বা ভাববাদের দিকে ঝোঁক।
শ্রেণীবিভাগের পাশাপাশি ভাববাদের উদয়। একে নিছক ঐতিহাসিক আপতন বলে উড়িয়ে দেওয়া চলে না। শ্রেণীবিভক্ত সমাজকে বদল করার মধ্যেও ভাববাদের চরম অসম্ভবের হাত থেকে প্ৰকৃত মুক্তি। একে রাজনৈতিক দল-বিশেষের প্রচারমাত্র বলে ব্যঙ্গ করাও অসম্ভব।
আদিম শ্রেণীহীন সমাজ ভেঙে দেখা দিল নতুন সমাজ-শ্রেণীবিভক্ত সমাজ।। একদিকে ব্ৰাহ্মণ-ক্ষত্ৰিয়, অপর দিকে শূদ্র; একদিকে ইসাক-ফেয়ারোপুরোহিত, অপর দিকে বঞ্চিত লাঞ্ছিত ক্রীতদাস; একদিকে শোষক-শাসকের দল, অপরদিকে শোষিত শ্রমিকের দল। দল বেঁধে সবাই মিলে প্ৰকৃতিকে জয় করবার চেষ্টা নয়-প্ৰকৃতির সঙ্গে সংগ্রামের ভার পড়ল শুধু একদল লোকের উপর; তারাই গতার খাটাবে, মাটি চাষবে, প্রাসাদ গড়বে, মন্দির গাথবে। শ্রমের ভার, কিন্তু শ্ৰমের ফলভোগের অধিকার নয়। সে-অধিকার অন্য শ্রেণীর, শাসক শ্রেণীর। পরান্নজীবী এই যে নতুন শ্রেণীর মানুষ, এদের পক্ষে গতির খাটাবার তাগিদ নেই একটুও; তাই গতর খাটানোটা নেহাতই ইতরের লক্ষণ–“শূকর-যোনি, শ্বা-যোনি চণ্ডাল-যোনি বা” (ছন্দোগ্য উপনিষদ)। চণ্ডাল হলো শুয়োর আর কুকুরের সমগোত্র। গতির খাটাবার তাগিদ এতটুকুও নেই বলেই মাথা খাটাবার দেদার অবসর। চিন্তা বা বুদ্ধি বা জ্ঞানবা যে কোনো নাম দিয়েই এই মাথা খাটানো ব্যাপারটাকে ব্যক্ত করা যাক না কেন-চরম উৎকর্ষ বলে ঘোষিত হলো। এই জ্ঞান-এর উপর শাসক শ্রেণীর একেবারে একচেটিয়া অধিকার, কেননা শোষিত জনগণের উপর গতির খাটাবার ভার, এবং তখন হাতিয়ারের এমন উন্নতি হয়নি যে, জনগণ অল্পমাত্ৰ গতির খাটিয়ে মানবসমাজের মোট অভাব দূর করে বাকি সময়টুকু সংস্কৃতির চর্চা করবে। তাই যাদের উপর গতির খাটানোর দায়, মাথা খাটাবার মতো অবসর তাদের কাছে কল্পনার অতীত। প্ৰাচীন মিশরী প্যাপিরসে লেখা থেকে এখানে কিছুটা উদ্ধৃত করবার প্রলোভন হয়। তখন গতির খাটাবার দায়টা যে আজকের শ্রমিকের দায়ের চেয়ে কিছুমাত্র কম নয়, তার প্রমাণ পাওয়া যাবে :