আদিম সাম্যাবস্থার প্রাগবিভক্তি সংস্কৃতির প্রধান অভিব্যক্তি ইন্দ্ৰজাল। ইন্দ্ৰজালের প্রধান বিকাশ নাচের মধ্যে। নাচ, কিন্তু আমরা যে অবসর-বিনোদনকে নাচ বলতে অভ্যন্ত, তা নয়। নাচ বলতে চোদ্দ আনাই ইন্দ্ৰজাল। এই ইন্দ্ৰজাল সম্বন্ধে সভ্য মানুষের ভ্ৰান্তির অন্ত নেই। নাচ, কিন্তু আজকালকার অবসর-বিনোদন নয়। আদিম মানুষের কাছে বিনোদিত হবার মতো অবসর কোথায়? চার পা ছেড়ে সবে সে দু’পায়ে উঠে দাড়াতে শিখছে, আর শিখেছে আগেকার দুটো ফালতু পা-কে দু হাত হিসেবে ব্যবহার করতে। হাতিয়ার তৈরি করতে শিখল, তাই হাত। দুনিয়ার আর কোনো জানোয়ার হাতিয়ার বানাতে শেখেনি, ‘হাত” নেই। আর কারুর। হাতের সঙ্গে মগজের যোগাযোগ, তাই হাতিয়ার ব্যবহারের মাধ্যমেই বুদ্ধিরও ক্ৰমবিকাশ। কিন্তু আদিম মানুষের প্রথম সেই হাতিয়ার বড় স্থূল, প্ৰকৃতিকে জয় করবার কাজে প্ৰায় অকৰ্মণ্যের চেয়ে মাত্র একটুখানি বেশি। সামনে প্ৰকৃতি, বিরাট বিপুল প্ৰকৃতি -থুল আর প্রাকৃত ওই হাতিয়ার নিয়ে মানুষ এই প্ৰকৃতিকে যতটুকু জয় করতে পেরেছে, ততটুকুই তার দুঃখ-মুক্তি। প্ৰকৃতির সঙ্গে লড়াই, হাতে মাত্র সামান্য হাতিয়ার। কতটুকুই বা পেরে ওঠা যায়? তবু যেটা সবচেয়ে জরুরি কথা, হাতিয়ার হাতে প্ৰকৃতিকে জয় করতে নেমেছিল বলেই মানুষ প্ৰকৃতিকে চিনতে শুরু করল, আর চিনতে শিখাল যত ভালো করে, ততই ভালো করে। পারল জয় করতে। জ্ঞান এসেছে সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে, আবার জ্ঞান হয়েছে সংগ্রামের অন্ত্র, তাই সংগ্রামকে বাদ দিয়ে নিছক তত্ত্বজিজ্ঞাসার কথা আদিম মানুষের বেলায় ওঠেই না। কেবল মনে রাখতে হবে, এ সংগ্রাম মানুষের সঙ্গে প্ৰকৃতির, মানুষের সঙ্গে মানুষের নয়। কেননা, তখন ছিল আদিম সাম্যাবস্থা, মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কটা সমাজ-সহজ সম্পর্ক। শোষণ নেই, তাই শাসনও নেই। শোষণ থাকবে কেমন করে? হাতিয়ার তখন অতি স্থূল বলেই দলের সবাই মিলে প্ৰাণপাত পরিশ্রম করে পৃথিবীর কাছ থেকে যেটুকু জিনিস সংগ্ৰহ করতে পারে, তার সাহায্যে কোনমতে দলের সবাইকার মাত্র জীবনধারণটুকু সম্ভব। তাই কারুর পক্ষেই অপরের শ্রম দিয়ে গড়া জিনিস আত্মসাৎ করতে পারা সম্ভব নয়। অর্থাৎ কিনা সম্ভব নয় শোষণ। আর শোষণ সম্ভব নয় বলেই সম্পর্কটা হলো সমানে সমান। সাম্যসমাজ। যদিও কিনা আদিম। সকলেই সমান, কেননা সকলেই সমান গরিব হতে বাধ্য। তবুও, এই সাম্যজীবনে একের সঙ্গে দশের সম্পৰ্কটা যেন অঙ্গাঙ্গী। সমাজ তখন বিশিষ্ট মানুষের সমষ্টিমাত্র নয়, যেন এক অখণ্ড সমগ্ৰতা; একের সঙ্গে দশের সম্পর্ক সংখ্যাগণিতের সম্পর্ক নয়, অঙ্গাঙ্গী সম্পর্ক। তাই, মানুষের সংগ্ৰাম আর জান, কিংবা সংগ্রাম-জ্ঞানের সেই প্ৰাগবিভক্ত সত্তায়, সমগ্রতার চেতনা প্ৰতিফলিত-ব্যষ্টির চেতনা নয়, শ্রেণীর চেতনা নয়, সমগ্ৰ সমাজের প্রাগবিভক্ত চেতনা। এই চেতনা আদিম মানুষের গোষ্ঠী নৃত্যে, — গোষ্ঠী-নৃত্য গোষ্ঠী-জীবনের অঙ্গমাত্র। সে-নাচের মধ্যেই আদিম মানুষের সাংস্কৃতিক জীবন, কিন্তু সে সংস্কৃতিতে অবসর বিনোদনের উৎসাহ নেই, নেই বিশুদ্ধ তত্ত্ব অন্বেষণের তাগিদ। তার বদলে সোজাসুজি প্ৰকৃতিকে জয় করবারই তাগিদ। কিন্তু জয়োৎসাহের বাস্তব সম্ভাবনাটা নেহাতই সংকীর্ণহাতিয়ার যে তখন নেহাতই স্থূল ধরনের। তাই প্ৰকৃতিকে জয় করবার বাস্তব বিফলতাকে কল্পনার জয় দিয়ে, বা জয়ের কল্পনা দিয়ে পূরণ করে নেবার চেষ্টা। তারই নাম ইন্দ্ৰজাল। ইন্দ্ৰজাল মানে হলো, প্ৰকৃতিকে যে-কাজ করবার জন্যে বাধ্য করতে চাই, নিজেরাই সে-কাজের একটা নকল করা, আর মনে মনে কল্পনা করা যে, প্ৰকৃতি এই নকলটাকেই নকল কয়তে বাধ্য হবে।–অর্থাৎ কিনা আসল ঘটনাটা ঘটতে বাধ্য হবে প্ৰকৃতিতে। আকাশে হয়তো বৃষ্টির নকল তুললাম আর ভাবলাম সত্যিই বৃষ্টি হবে।
শ্ৰীমতী হারিসন দেখাচ্ছেন :
অসভ্য মানুষ হলো কাজের মানুষ। তার নিজের মনে যে-কাজ করবার ইচ্ছে, সে-কাজ করবার জন্যে কোনো দেবতাকে অনুরোধ করবার বদলে সে নিজেই কাজটা সারবার চেষ্টা করে। প্ৰাৰ্থনার বদলে সে উচ্চারণ করে মন্ত্র। এক কথায়, সে ইন্দ্ৰজাল ব্যবহার করে, আর প্রায়ই সে মেতে ওঠে। ঐন্দ্ৰজালিক নাচে। রোদ বা হাওয়া বা বৃষ্টি চাইলে সে গির্জায় গিয়ে কোনো অলীক দেবতার সামনে নুয়ে পড়ে না, নিজের গোষ্ঠীকে আহবান জানায়-আর তারপর সকলে মিলে একসঙ্গে রোদের নাচ বা হাওয়ার নাচ বা বৃষ্টির নাচ নাচতে শুরু করে। ভালুক শিকার বা ভালুক ধরবার আগে সে ভালুককে বশ করবার মতো শক্তি পাবার আশায় তার দেবতার পায়ে মাথা কোটে না, শিকারের মহড়া দেয় ভালুক-নাচ নেচে। আবার :
গ্রীকরা বুঝেছিল, আপনি যদি মন্ত্রাচরণ করতে চান, তাহলে কিছু কাজ করা দরকার; অর্থাৎ ‘আপনার মধ্যে শুধু কিছু ভাবাবেগ জাগলে চলবে না, তাকে কাজের রূপে প্ৰকাশ করতে হবে।’ তাছাড়া ‘মন্ত্রাচরণের একটি অঙ্গকে আমরা আগেই পরীক্ষা করেছি, সেই অঙ্গ হলো মন্ত্রাচরণ সমবেতভাবে করা দরকার, অনেকগুলি মানুষের পক্ষে এক সঙ্গে একই আবেগ অনুভব করা দরকার।’ ইত্যাদি ইত্যাদি।
এই তো গেল আদিম মানুষের নাচের কথা। ইন্দ্ৰজাল-এর আসল ব্যাপারটুকু লক্ষ করতে হবে। স্যার ফ্রেজার দেখাচ্ছেন :
বিশুদ্ধ ও অবিমিশ্র রূপে যেখানেই…ইন্দ্ৰজাল দেখা দিয়েছে, সেখানেই ধরে নেওয়া হয়েছে যে, প্ৰকৃতিতে কোনো রকম আধ্যাত্মিক বা ব্যক্তিগত কিছুর হস্তক্ষেপ নেই, একটি ঘটনা আর এক একটি ঘটনার অনিবাৰ্য ও নিয়ত অনুগামী। অতএব এর মূল ধারণা এবং আধুনিক বিজ্ঞানের মূল ধারণা অভিন্ন। ঐন্দ্রজালিক ভাবধারার মূলে রয়েছে একটি অব্যক্ত, কিন্তু বলিষ্ঠ ও বাস্তব, বিশ্বাস, সে বিশ্বাস হলো প্ৰকৃতির নিয়মানুবতিতায় বিশ্বাস।…তাই ঐন্দ্রজালিক ও বৈজ্ঞানিক ধারণায় ঘনিষ্ঠ সাদৃশ্য! উভয় ক্ষেত্রেই ঘটনাপরম্পরা নিখুঁত ও সুনিশ্চিত ভাবে নিয়ম মানে, সেই নিযমের ক্রিয়া নিখুঁতভাবে হিসেব করা যায়, আগে থাকতে ঠাহর করা যায়। প্রকৃতি থেকে খামখেয়াল, দৈবাৎ আর অকারণকে বর্জন করা… … …। ধর্ম যেহেতু মেনে নেয় যে, এই পৃথিবী চেতন শক্তির দাস–যে-শক্তিকে তোয়াজ করলে তার উদ্দেশ্য বদলে যেতে পারে,–সেইহেতু বিজ্ঞান এবং ইন্দ্ৰজাল উভয়ই ধর্মের একেবারে বিরুদ্ধ। কেননা উভয় ক্ষেত্রেই ধরে নেওয়া হয়েছে যে, প্ৰকৃতির পথ কোনো ব্যক্তিগত মন-মেজাজের খেয়ালখুশির উপর নির্ভর করে না, তার বদল নির্ভর করে যন্ত্রের মতো চালিত অলঙ্ঘনীয় নিয়মের উপর। ইন্দ্ৰজালের বেলায় এই স্বীকৃতিটা অব্যক্ত, বিজ্ঞানের বেলায় ব্যক্ত।