এতদিন পর্যন্ত সবদেশে সব যুগে এই একই কথা; বস্তুবাদের কপালে যদিই বা কখনো সাময়িক সাফল্য জুটেছে (যেমনটা দেখা যায় ফরাসী বিপ্লবের অগ্রদূত ফরাসী বস্তুবাদের বেলায়), তবুও সেই সাফল্যের পরই বিদগ্ধ সমাজ হয় একে একেবারে সোজাসুজি উড়িয়ে দিতে চেয়েছে, আর না হয়। তো সংস্কার কয়ে নেবার নামে একেবারে সর্বস্বাস্ত করে ছেড়েছে। যে-সৰ দিকপাল দার্শনিক ভাববাদের অসম্ভবে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন, তাঁরাও কেউ বিপরীত মতবাদ–বস্তুবাদের–দিকে অগ্রসর হতে পারেননি, ভাববাদকে ছেড়ে আর এক অভিনব দার্শনিক মতবাদ সন্ধান করতে বেরিয়েছেন, আর শেষ পর্যন্ত এই অভিনব মতবাদের দোহাই দিয়ে প্রচ্ছন্ন ভাববাদের আঙিনাতেই ক্লান্ত দার্শনিক চেতনা এলিয়ে দিয়েছেন। ফলে দর্শনের ইতিহাসে চেতন-কারণবাদেরই অবিচ্ছিন্ন প্ৰতিপত্তি, দর্শন আর ভাববাদ যেন একই কাচের উত্তল আর অবতল দুটো দিকমাত্ৰ!
প্রশ্ন হলো : দর্শনের ইতিহাসে এমন ঘটনা ঘটল কেন? দর্শন কেন মুক্তি পায়নি ভাববাদের প্রায় একচ্ছত্র আধিপত্য থেকে? চেতনকারণবাদেই কেন তার একান্ত পরিণতি? তথাকথিত বিশুদ্ধ দর্শনের গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ থাকতে চাইলে এ-প্রশ্নের জবাব খোজা বিফল হবে। বড় জোর, শুধু এইটুকু বলা চলবে যে, এতদিন পর্যন্ত বুদ্ধির দাবিকে বা চেতনার দাবিকে (তথাকথিত বুদ্ধিবিতৃষ্ণ দার্শনিকরাও বুদ্ধিকে বাদ দিয়ে চেতনারই অপর কোন অঙ্গকে আশ্রয় করতে চেয়েছেন)। চরম দার্শনিক পদ্ধতি বলে মেনে নেবার দরুন দর্শনে এমনটা না হয়ে আর উপায় ছিল না! অথচ, পদ্ধতির দিক থেকে চেতনার উপর নির্ভর করা, আর পরিণামের দিক থেকে ভাববাদ-এ তো একই কথার ভিন্ন প্ৰকাশভঙ্গিমাত্র। কেন এমন হয়েছে? তাই আসল সমস্যাটা আরো অনেকখানি গোড়ার সমস্যা। সে-সমস্যা হলো : যুগ যুগ ধরে দার্শনিকেরা কেন চেতনার দাবিকে চূড়ান্ত দাবি বলে প্রচার করেছেন, কিংবা, যা একই কথা, পরমসত্তাকে চেতননির্ভর না বলে কেন শেষ পর্যন্ত শান্তি পাননি?
“বিশুদ্ধ” দর্শন এই “কেন’-র জবাব জোগাতে পারে না। অথচ মানবসমাজের ক্রমবিকাশের সঙ্গে মানব-চেতনায় দার্শনিক মতবাদের ক্রমবিকাশের কথাটা যদি মিলিয়ে ভাববার চেষ্টা করা যায়, তাহলে সেদিক থেকে এই প্রশ্নের জবাবটা স্পষ্ট : এতদিন ধরে এমনিতরো ঘটনা না ঘটে যেন উপায়ই ছিল না! কেননা যাকে আমরা “দর্শন” বলে মেনেছি, তার জন্ম শ্রেণীবিভক্ত সমাজের গর্ভে, সে লালিত হয়েছে শ্রেণীবিভক্ত সমাজের ক্ৰোড়ে, তার দেহ থেকে শ্ৰেণীবিভাগের চিহ্ন মোছা যাবে কেমন করে? ভাববাদ বা চেতন-কারণবাদ–সেই শ্রেণীবিভাগের চিহ্ন! সমাজে শ্রেণীবিভাগকে উচ্ছেদ না করলে তাই ভাববাদের হাত থেকে প্রকৃত মুক্তি পাবার প্রশ্ন ওঠে না; মার্কস বলছেন, দার্শনিকেরা এতদিন দুনিয়ার শুধু ব্যাখ্যাই খুঁজেছে, কিন্তু আসল কথা হলো দুনিয়াকে বদল করবার কথা। দুনিয়াকে বদল করা-পৃথিবীতে নতুন পৃথিবী, নবীন নিঃশ্ৰেণীক সমাজ। তখন মানুষের সঙ্গে সংগ্রামে মানুষ আর নিজেকে অপচয় করবে না, তখন থেকেই যেন মানুষের আসল ইতিহাস শুরু। প্ৰাক্-ইতিহাস শেষ, শুরু ইতিহাস। আর শেষ ভাববাদের। সোভিয়েট দেশে এই নবীন নিঃশ্ৰেণীক সমাজের প্রথম অঙ্কুর, তাই ভাববাদের হাত থেকে মুক্তি, বস্তুবাদের প্রথম বলিষ্ঠ প্ৰতিষ্ঠা।
বিশুদ্ধ দার্শনিক প্ৰত্যেকটি কথাতেই বিরূপ হবেন। না-হলেই বরং অবাক হবার কথা, কেননা তার চেতনাও যে এই শ্রেণীবিভক্ত সমাজেরই পরিণাম, তাই শ্রেণীবিভক্ত সমাজেরই মুখপাত্র দার্শনিক বিচার যদি সমাজ-বিপ্লবের প্ৰসঙ্গ তোলে, তাহলে তাঁর পক্ষে বিরূপবোধই স্বাভাবিক বইকী! মার্কসীয় দর্শনের বিরুদ্ধে আজকের দিনে কেন যে এত রকম অভিনব প্ৰতিবন্ধ, তার ব্যাখ্যাও এদিক থেকে খুঁজে পাওয়া যাবে।
আপাতত দেখা যাক, সমাজে শ্রেণীবিভাগের সঙ্গে দর্শনের ক্ষেত্রে ভাববাদের সম্বন্ধটা কী-রকম।
শ্ৰেণীবিভক্ত সমাজের গর্ভে দর্শনের জন্ম, শ্রেণীবিভক্ত সমাজের ক্ৰোড়ে। দর্শন লালিত, দর্শনের দেহে তাই শ্রেণীবিভাগের চিহ্ন। কিন্তু তার আগে? তার আগে মানবসমাজ শ্রেণীবিভক্ত ছিল না, আর তাই মানুষের চেতনা ভাববাদের আশ্রয় খুজতে বাধ্য হয়নি। আর এর পর? এর পর এক নবীন নিয়শ্রেণীক সমাজে-সে-সমাজে ভাববাদের বীজও বিলুপ্ত-এই বীজ থেকে উৎপন্ন বিষবৃক্ষ শুধু জীৰ্ণ শুষ্ক কাষ্ঠের মতো সংস্কৃতির জাদুঘরে গবেষকের কাছে ঐতিহাসিক বিস্ময়ের বিষয়মাত্র। পরমায়ুর দিক থেকে তাই শ্রেণী:সমাজ আর ভাববাদ সমব্যাপ্ত-কিংবা যেন একই কাচের উত্তল আর অবতল দুটো দিক।
আগে ছিল আদিম-সাম্যাবস্থা। মানুষের সংস্কৃতির সবটুকুকে তখন জুড়ে ছিল তার নাচ আর তার ইন্দ্রজাল,–কিংবা নাচে-ইন্দ্ৰজালে মেশা এক প্ৰাগবিভক্তি সাংস্কৃতিক সত্তা। এই যে প্ৰাথমিক প্ৰাগবিভক্তি সংস্কৃতি, এর স্বরূপ নিয়ে আলোচনা করলে দেখা যাবে, এর মূল দাবি ভাববাদের বিপরীত দাবি। আলোচনা করতে হবে, কেমন করে আদিম সাম্যাবস্থা-বিচ্যুতির পর –মানবসমাজে শ্রেণীবিভাগ দেখা দেবার পর -এই প্ৰাথমিক প্ৰাগবিভক্ত ভাববাদ-বিরুদ্ধ সংস্কৃতি থেকে ভাববাদী দর্শন (প্ৰথমে ধর্ম, আর তারপর ধর্মেরই পরিচ্ছন্ন সংস্করণ দর্শন বা অধিবিদ্যা) তত্ত্বান্বেষণের সমস্তটুকুকে জুড়ে বসতে লাগল। অবশ্যই শ্রেণীবিভক্ত সমাজেরও ইতিহাস আছে, শ্রেণীবিভাগের কাঠামোর মধ্যেও অনেক রকম পরিবর্তন ঘটেছে; তাই দর্শনের বা ভাববাদের চেহারাও যুগে যুগে এক নয়। আরো দেখতে হবে, শ্রেণীবিভাগের এই কাঠামো সত্ত্বেও মাঝে মাঝে বস্তুবাদ কেমন করে মাথা তুলে দাড়াবার চেষ্টা করছে। যেমন ধরা যায়, ফরাসী বস্তুবাদ, বা আধুনিক ইংরেজী বস্তুবাদ। তার আবির্ভাব তো শ্রেণীসমাজের যুগেই। শ্রেণীসমাজের মূলেই যদি ভাববাদী দর্শনের অনিবাৰ্য তাগিদ থাকে, তাহলে এমন ঘটনা সম্ভব হয় কেমন করে? অবশ্যই, ও-জাতীয় বস্তুবাদের দুর্বলতা ছিল। সেই দুর্বলতার দরুনই এই বস্তুবাদ বাধ্য হলো ভাববাদের জন্যে জায়গা ছেড়ে দিতে। তারপর আধুনিক যুগে সমাজতান্ত্রিক পরিকল্পনার আবহাওয়ায়, সোভিয়েট সমাজে মানবইতিহাসে প্রথম পবিপূর্ণভাবে ভাববাদ অগ্ৰাহ করবার-সচেতন আর সমবেতভাবে অগ্রাহ করবার-উৎসাহ দেখা দিল। এ-উৎসাহের উৎসই বা কোথায়? এ সব প্রশ্নের জবাব থেকে ভাববাদ খণ্ডনের মূল রহস্য আবিষ্কার করবার আশা আছে।