নিজের প্রিয়তম শিষ্যকে এমন খোলাখুলিভাবে একটা বিশেষ রাজনীতি নিয়ে কোমর বাঁধতে দেখলে স্বয়ং ফ্রয়েড হয়তো লজ্জিতই হতেন; তার কারণ এই নয় যে ফ্রয়েড নিজে এই রাজনীতির সঙ্গে নিজেকে সংযুক্ত করেননি। তার কারণ হলো এই যে, ফ্রয়েডের সময় দিনকাল এমন ‘খারাপ’ হয়ে পড়েনি। তখনও পর্যন্ত একটা উদার, দরাজ ভাব, একটা মোলায়েম আপাত-নিরপেক্ষ মুখোশ পরা সম্ভব হতো—ওই নির্দিষ্ট রাজনীতির প্রচারক হওয়া সত্ত্বেও সম্ভব হতো। আজকের দিনে তা আর চলছে না। এ-কথায় তো কোনো সন্দেহ নেই যে জোন্স-ই আজকের দিনে সবচেয়ে প্ৰবীণ এবং সবচেয়ে সৌম্য-শান্ত ফ্রয়েডপন্থী। তাঁরই এই দশা।
তাঁরই যখন এই দশা তখন ছোটোখাটো ফ্রয়েডপন্থীদের রাজনৈতিক তাণ্ডব যে অনেক বেশি বীভৎস হয়ে দাঁড়াবে তাতে আর সন্দেহের অবকাশ কোথায়? এই তাণ্ডবের লীলাভূমি আজ মার্কিন মুলুকে। ফ্রয়েডপন্থীদের পক্ষে এতো পত্রিকা প্রকাশ করবার, এতো বই লেখবার ধূম কোথাও নেই। সেই সব পত্রিকার পাতাগুলি উল্টে যান, উল্টে দেখুন বইগুলির আলোচ্য বিষয়। দেখবেন, কোনো অজ্ঞাতকুলশীল ফ্রয়েডপন্থী হয়তো মলটভ-এর মানসিক রোগটা নির্ণয় করবার চেষ্টা করছেন, কেউ বা স্টালিনের। পৃথিবীর বুক থেকে সাম্যবাদের উপদ্রব কেমন করে দূর করা যায় তার আলোচনাও কম নয়। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ আজ যুদ্ধ না বাধিয়ে টিকতে পারে না, তাই ফ্রয়েডপন্থীদের লেখায় যুদ্ধবাদের প্রচার। মনে রাখতে হবে, সাম্প্রতিক ফ্রয়েডবাদের আজ প্রথম ও মূল আলোচ্য বিষয় হলো মানবমনের জিঘাংসা (aggression)। এই জিঘাংসাই নাকি মানুষের সবচেয়ে প্রাথমিক সহজবৃত্তি। (৭)
তর্ক তুলে কেউ হয়তো বলবেন, যদিই বা মেনে নেওয়া যায় আজকের দিনে মার্কিন মুলুকে রাজনৈতিক উৎসাহে ফ্রয়েডবাদের ব্যবহারটা খুব বেড়েছে, তাহলেই তো সেটা ফ্রয়েডবাদের কোনো নিজস্ব দোষ হবে না। যুদ্ধবাদীরা আণবিক বিজ্ঞানকে যুদ্ধের কাজে নিয়োগ করতে চাইছে, কিন্তু অপরাধটা কি আণবিক বিজ্ঞানের? পূর্বপক্ষ হয়তো বলবেন, ফ্রয়েডবাদ একটা বৈজ্ঞানিক মতবাদ মাত্র; সেটা ভুল হতে পারে, ভুল না। হতেও পারে। কিন্তু তার প্রয়োগ-অপ্ৰয়োগের কথাটা একেবারেই স্বতন্ত্র। সে-কথা তুলে এই মতবাদকে সমালোচনা করতে যাওয়া বৈজ্ঞানিক মেজাজের পরিচয় নয়।
উত্তরে বলবো, এ-তুলনাটা ঠিক হলো না। কেননা ফ্রয়েডবাদের নিজস্ব ধর্মই এমন যে ওই নির্দিষ্ট রাজনীতির সঙ্গে তার নাড়ির যোগ। এমন বিষয় নিয়ে আলোচনা, এমন সিদ্ধান্তে গিয়ে পৌছানো, যে এই নির্দিষ্ট রাজনৈতিক ব্যবহারের জন্যে তৈরি জমি যেন। তার মানে ফ্রয়েডবাদ এবং ফ্রয়েডবাদের রাজনৈতিক প্রয়োগকে আলাদা করা যায় না, যেমন হয়তো আণবিক বিজ্ঞানের বেলায় অন্তত চেষ্টা করা যেতে পারে। অবশ্য এই কথা স্পষ্টভাবে প্ৰতিপন্ন করবার জন্যে ভবিষ্যতে ফ্রয়েডবাদের মূলসূত্রগুলির আলোচনা তোলা দরকার হবে।
কিন্তু আপাতত যে-আলোচনা হচ্ছিলো: রাজনৈতিক উৎসাহের বিরুদ্ধে যুক্তি নিয়ে আলোচনা। উত্তরে স্বপক্ষ-দােষের কথা তুলেছি: ফ্রয়েডবাদের নিজস্ব রাজনৈতিক উৎসাহ। এই উৎসাহের প্রকাশ দুদিক থেকেই। ব্যঞ্জনার দিক থেকে এবং সোজাসুজি রাজনৈতিক পক্ষপাতের দিক থেকে। কেবল, রাজনীতিটা একটা নির্দিষ্ট রাজনীতি—বুর্জোয়া রাজনীতি—এই যা বৈশিষ্ট্য।
আমাদের দেশে চলতি কথায় বলে: পাঁচ কড়ায় গণ্ডা গুনছিস কেন ? না, আমি যে ন্যাকা। তিনি কড়ায় গোন না! —না, আমার যে কম হবে!