মার্কসবাদের বাস্তব প্রয়োগ রুশ বলশেভিজম-এ। ফ্রয়েড তাই বলশেভিজম-আলোচনাও তুলছেন। বলছেন, বলশেভিজম-এর উৎসে বিজ্ঞানের প্রেরণা, কিন্তু তার বাস্তব পরিণতি হলো বিজ্ঞানবিরোধে, ধর্মমোহে। ধর্মমোহের লক্ষণটা কী? এক হলো, স্বাধীন চিন্তার বিরুদ্ধে কড়া রকম হুকুমজারি: ইসলাম ধর্মের কাছে কোরান যে-রকম, বলশেভিকদের কাছে সেই রকমই মার্কসীয় গ্রন্থ। দুই হলো, দীনদরিদ্রের কাছে সোনালী ভবিষ্যতের আশ্বাস। ধর্মের মতোই বলশেভিজম বলে, জনগণের উপস্থিত (অর্থাৎ পূর্ণ সাম্যব্যবস্থা প্রবর্তিত হবার আগে পর্যন্ত) যতো অভাব, যতো দুঃখকষ্ট, তা দুদিন পরে শেষ হবে— ইহকালের মতো পরকালে আর অপূর্ণ বাসনার তাড়না থাকবে না। তর্ক তুলে বলশেভিকরা হয়তো বলবেন, আমরা তো আর ইহলোক-পরলোকের তফাত করি নে-আমরা বলি ইহলোকেই, এই পৃথিবীতেই, জনগণের সুদিন আসন্ন হয়েছে। উত্তরে ফ্রয়েড বলছেন, এহেন কথাও নতুন কথা নয়। মনে রাখতে হবে ইহুদীদের ধর্মে পরকালের যে সোনালী ছবি তাও কোনো পরলোকের কথা নয়—ইহলোকেই, এই পৃথিবীর বুকেই। অবশ্যই ফ্রয়েড বিনয় করে বলছেন, বলশেভিজম-এর সব কথা তার ভালো করে জানা নেই, এবং এই তথ্যাভাবের জন্যে তিনি বিশেষ দুঃখিত।
সমাজতন্ত্রের মতবাদ এবং বাস্তব প্রয়োগ-থিয়োরি এবং প্র্যাকটিস সম্বন্ধে এই হলো স্বয়ং ফ্রয়েডের সমালোচনা! নজর করলে দেখা যায়। এ-সমালোচনায় নতুন কথা একটিও নেই। বুর্জোয়া মহলের পণ্ডিতেরা মার্কসবাদের মধ্যে কুট হেগেল-দর্শনের ভগ্নাবশেষ থেকে শুরু করে সোভিয়েট সমাজে নব্য ধর্মমোহের অভু্যত্থান পর্যন্ত প্রত্যেকটি কথাই বহুবার বলেছেন। এবং এই সব সমালোচনার অন্তঃসারশূন্যতা বহুবারই দেখানো হয়েছে। সাম্প্রতিক সমাজতন্ত্রবাদী গ্রন্থাবলীর সঙ্গে যার কিছুটাও পরিচয় আছে তার কাছে এই সব সমালোচনার প্রত্যুত্তর পুনরুক্তি-মাত্র হবে। আপাতত তাই সে-চেষ্টা করবো না। তার বদলে, ফ্রয়েডীয় সমালোচনার একটি বৈশিষ্ট্যের নজর দিতে বলবো ।
কি-রকম একটা উদার দরাজ আর বিনয়ী ভাব দেখুন: মার্কসবাদ তো সব একেবারে মিছে কথা নয়, এর মধ্যে কিছু কিছু সত্যি কথাও তো আছে। অবশ্যই, যে-সব কথায় বুর্জোয়া-শ্রেণীর আশু সর্বনাশ-সম্ভাবনা সেগুলির প্রতি একটুও দরাজ ভােব নয়: শ্রেণী-সংগ্রামটা ভুল, ইতিহাসের বিচারটা ভুল, আগামীকাল ইতিহাস কোন রূপ নেবে তার হিসেবটাও ভুল। মেজাজ যতোই উদার আর দরাজ হোক না কেন, বুর্জোয়াশ্রেণীর স্বার্থের সঙ্গে এই কথাগুলোর সংঘর্ষ যে বড়ো প্রকট। তাই মার্কসবাদের আপাত-নিরীহ কিছু দাবিকে সত্যের সম্মান দেওয়া যায়: মূল কথাগুলিকে মিথ্যা বলে বিষদাঁতটা ভেঙে দেওয়া গেলো, তারপর ওই ভদ্রলোক সাপটািকে কিছুটা দুধকলা খাইয়ে উদার মনোভাবের পরিচয় দেওয়া হলো।
স্বয়ং ফ্রয়েডের রচনায় এই উদার দরাজ ভাবটার দিকে বিশেষ করে নজর রাখতে বলছি, তার কারণ পুঁজিবাদের তরফের পণ্ডিতদের পক্ষে বিশ বছর আগে এমনতরো একটা ভঙ্গির অবকাশ তবু ছিলো। আজকের দিনে আর তা নেই। কেননা, প্রথম মহাযুদ্ধের পরেও বুর্জোয়াদের মনে টিকে যাবার যেটুকু ক্ষীণ আশা ছিলো। আজ তাও শেষ হয়েছে। অপর পক্ষে, বুজোয়াদের চােখে সমাজতন্ত্রের ভবিষ্যৎ তখনও পর্যন্ত অল্পবিস্তর অনিশ্চিত ছিলো: কিন্তু যতোই দিন যাচ্ছে ইতিহাস ততোই স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতরভাবে প্রমাণ করছে, এই অনিশ্চয়তার উপর নির্ভর করতে যাওয়াটা অলীক আত্মপ্ৰবঞ্চনাকে আঁকড়ে ধরবার চেষ্টা মাত্র। আজকের দিনে বুর্জেয়া তরফের প্রচারে তাই এমন উদার দরাজ আর বিনয়ী ভাবের বদলে বেপরোয়া আর মরিয়ার ভাব ।
বিশ বছর আগের মতোই-স্বয়ং ফ্রয়েডের মতোইআজকের দিনের ফ্রয়েডপন্থীরাও বুর্জেয়া রাজনীতিকে আঁকড়ে ধরতে চান। কিংবা, যা একই কথা, সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রচারে যোগ দিতে চান। কিন্তু সেকালের ছকে বাধা আপাত মোলায়েম বুর্জেয়া সমালোচনাগুলির পুনরুক্তি করার মতো মনের সম্পদটুকু ফুরিয়ে গিয়েছে। তাই সোজাসুজি গালাগালির পথ! প্রায় খিস্তি-খেউড়ের পথ। সেকালের মতো। আপাত-নিরপেক্ষতার ভঙ্গি কিসের সাহসে পাওয়া যাবে? তাই সোভিয়েটের মানুষদের নেহাত পাগল-ছাগল প্ৰতিপন্ন করবার চেষ্টা, সমাজতন্ত্রের নেতাদের মনে কোন মনোবিকারের তাড়না তারই কল্পিত বৰ্ণনা দেবার চেষ্টা, এবং সমাজতন্ত্রের প্রভাব থেকে পৃথিবীকে (অর্থাৎ বুর্জোয়াকে) বাঁচাতে গেলে কোন ধরনের কায়দা-কানুন অনুসরণ করতে হবে তাই নিয়ে মাথা ঘামানো।
নমুনা তোলা যাক।
বর্তমানকালে, ফ্রয়েডপন্থীদের মহাগুরু হলেন আর্নস্ট জোন্স। সম্প্রতি “আন্তর্জাতিক মানসিক স্বাস্থ্য সম্মেলনে” বক্তৃতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, রুশ জনসাধারণের মনে এমন যে উৎকণ্ঠার জের (উৎকণ্ঠােটা সোভিয়েট জনগণের মনে, না বুর্জেয়া প্রচারকের মনে ? সাইকো এ্যানালিসিসের ভাষায় এর নাম projection নয় তো?) তার কারণ হলো, ওদের মনে অত্যন্ত ব্যাপকভাবে এক পাপবোধের উৎপাত। পাপবোধটা এলো কোথা থেকে? কিসের পাপ ? জোন্স বলছেন, পিতৃহত্যার মহাপাপ। ওরা ওদের ছোট্ট পিতা জারকে খুন করেছে যে!(৬)
বলাই বাহুল্য, আপাত-বৈজ্ঞানিক শব্দ-সম্ভার সত্ত্বেও এ-জাতীয় উক্তির বৈজ্ঞানিক গুরুত্ব নেহাতই শূন্য। এমন কি পাল্টা প্রশ্ন করে এ-কথা তোলাও পণ্ডশ্রম যে চার্লসকে হত্যা করার ফলে ইংরেজ জনসাধারণের মনে পাপবোধ আর উৎকণ্ঠার তাড়না দেখা দেয়নি কেন, কেন দেখা দেয়নি ওই পাপবোধ আর উৎকণ্ঠা ফরাসীদের মনে-তারাও তো বিপ্লবের সময় তাদের “ছোট্ট পিতা”-কে খুন করতে কসুর করেনি!! মুসোলিনীকে হত্যা করবার দরুন ইতালির জনগণও কি ওই ফ্রয়েডীয় পাপবোধের বোঝায় পাগল হয়ে যাবে? পাগল হয়ে যাবে কি চীনের জনগণ চিয়াংকাইশোককে নির্বাসনে পাঠিয়ে ? এ-সব প্রশ্ন তোলা সত্যিই পণ্ডশ্রম। কেননা জোন্স-এর উক্তি বিজ্ঞানের ধারকছে ঘেঁষে। না, ইতিহাস বা সমাজতত্ত্ব নিয়ে কোনো গুরুত্বপূর্ণ চিন্তার পরিচায়কও নয়—খোলাখুলি রাজনৈতিক অপপ্রচার মাত্র, কেবল আপাত বৈজ্ঞানিক কিছুটা রঙ চড়িয়ে প্রচারটাকে চটকদার করবার চেষ্টা। আর, রাজনৈতিক প্রচার হিসেবে কতোখানি খেলো, কী রকম শাস্তা! ওর মধ্যে মোদ্দা কথা দুটাে। প্রথমত, রুশ বিপ্লব পিতৃহত্যার মতোই মহাপাতক। আর দুই হলো, সোভিয়েটের মানুষগুলো নেহাতই যেন পাগল-ছাগল; তারা যে আজ দুনিয়ার মেহনতকারী মানুষকে অত্যাচারের বিরুদ্ধে, যুদ্ধ-চক্রান্তের বিরুদ্ধে আগুয়ান হবার নেতৃত্ব দিচ্ছে তার আসল কারণ, তাদের মনের কোণায় মনোবিকারের তাড়না।