তার মানে, রাজনীতি সম্বন্ধে আপাত-নিরপেক্ষতাটুকু নির্দিষ্ট এক রাজনৈতিক শাসনকে স্বীকার করে নেবার উমেদারি ছাড়া আর কী? দেশের রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণটা তো আর ফ্রয়েডীয় ভাষায় মানসিক যাথার্থ্য (psychical reality) নয়, এক অতি Kot o ostoj-šPGC53 vrst: material reality ভূতের ভয়ের মতো শুধুমাত্র মানসিকভাবে যদি যথার্থ হতো তাহলে না হয় মনস্তত্ত্বমূলক কোনো পদ্ধতিতে তার সঙ্গে বুঝবার অন্তত আশ্বাসটুকুও পাওয়া যেতো। কিন্তু বাস্তব যথার্থ সম্বন্ধে অপক্ষপাতী হবার একমাত্র তাৎপর্য হলো তাকে স্বীকার করে নেওয়া, বড় জোর এই স্বীকৃতির দুর্ভোগকে ভুলে থাকবার একটু-আধটু আয়োজন করা।
সদরদের দিয়ে রাজনৈতিক উৎসাহ-মাত্রকে নির্বাসন দেবার যে-আয়োজন তারই বাস্তব পরিণতি হলো খিডকিদোর দিয়ে বর্তমান রাজনৈতিক ব্যবস্থার সমর্থনকে গোপন আমন্ত্রণ পাঠানো। তার মানে, রাজনীতি বিষয়ে এই নিরুৎসাহ-প্রচারটা আসলে এক সুনির্দিষ্ট রাজনীতির পক্ষে উৎসাহ-প্রচারেরই পরিণতি। প্রসঙ্গত বলা যায়, আজকের দিনে মতবাদগত সংগ্রামের ক্ষেত্রে অনুরূপ দৃষ্টান্ত দুর্লভ নয়। বুর্জেয়া শ্রেণীর পোষকতা-পরিপুষ্ট দার্শনিকেরা বুর্জোয়া-দর্শনেরই অনিবার্য প্রচারক, তবুও প্রচার কাজের কায়দা-কানুনটা আজ অভিনব। বুর্জোয়া জীবনাদর্শকে গ্ৰহণ করবার কথাটা তারা আর জোর গলায় বলছেন না, তার বদলে বলছেন সংশয়বাদের কথা: মানুযের সত্যান্বেষণ নিস্ফলতায় পর্যবসিত, জীবনের কোনো রকম মূল্য নির্ণয় করতে যাওয়াটাই আত্মপ্ৰবঞ্চনার নামান্তর। হালের তথাকথিত ‘পসোটিভিস্ট” থেকে শুরু করে “এক্সিসটেনসিয়ালিস্ট’ দৰ্শন পর্যন্ত সর্বত্রই এই কথা। যুক্তিতর্কের এতো রকম আর এতো সংকীর্ণ সব অলিগলি ঘুরিয়ে পাঠক-সাধারণকে এক অর্থহীনতার মুখোমুখিনিয়ে যাবার এমন কায়দা, সহজবুদ্ধিকে বিপর্যন্ত করবার এমন অপরূপ আয়োজন, যে দেখে তাক লেগে যায়। এতো মার্জিত, এমন সূক্ষ্ম, এমন নির্লিপ্ত যুক্তিতর্কের পেছনে যে কোনো রকম স্থূল শ্রেণীস্বর্থ লুকোনাে থাকতে পারে তা সন্দেহ করতে যাওয়াই যেন সন্দেহ-বাতিকের পরিচয়। অথচ, শ্রেণী:স্বার্থ একটা রয়েছেই।-যদিও প্রকটভাবে নয়, প্রচ্ছন্নভাবে। এবং এই শ্রেণী:স্বার্থকে দেখতে না পাওয়া অন্ধতারই প্ৰমাণ। কেননা, আজকের দিনে বাস্তব পরিস্থিতিটা ঠিক কী রকম তা একবার ভেবে দেখুন। বুর্জেয়া শাসনের কৃপায় বুর্জোয়া জীবন-দর্শন আজকের আকাশে বাতাসে মিশে রয়েছে; ইস্কুল-কলেজ থেকে শুরু করে ছাপাখানা-সিনেমা রেডিও পর্যন্ত সবকিছুর মাধ্যমে এই দর্শনকে প্রচার করবার প্রকট বা প্রচ্ছন্ন আয়োজন। এ-হেন পরিস্থিতিতে আপনাকে যদি বুঝিয়ে দেওয়া যায় দার্শনিক প্রচেষ্টাটুকু পণ্ডশ্রমেরই নামান্তর-মাত্র তাহলে কি ওই বুর্জেয়া দর্শন আরো নিষ্কণ্টক, আরো নিরাপদ হবার সুযোগ পাবে না? আপনি তো হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দিলেন, দার্শনিক বিচারের চেষ্টা আর করবেন না। আর এই বিচার-বিতৃষ্ণার সুযোগে আপনার মনে আপনার পারিপাশ্বিকে প্রচলিত জীবনদর্শনটি নিরুপদ্রবে। বাসা বাঁধতে পারবে।
রাজনীতি সম্বন্ধে ফ্রয়েডপন্থীর যে-ভঙ্গি তার বাস্তব পরিণতিও এই রকমই নয় কি?
কিন্তু শুধু ওইটুকুই নয়। শুধু যে ওই রকম খিড়কিদের দিয়ে বর্তমান শাসনব্যবস্থার সমর্থনকে গোপনে আমন্ত্রণ জানানো তাই নয়। বাস্তবভাবে দেখলে দেখা যায়। যতোই দিন যাচ্ছে ততোই ফ্রয়েডপন্থীরা সোজাসুজিভাবে, স্পষ্টাস্পষ্টিভাবে, একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক মতবাদের সঙ্গে নিজেদের সংযুক্ত করছেন। ফ্রয়েডীয় মতবাদের মূল কথাগুলি আলোচনা করলে দেখতে পাবো কেমনভাবে তার মধ্যে সাম্রাজ্যবাদী রাজনীতির প্রচ্ছন্ন সমর্থন। কিন্তু সে-আলোচনা পরে তোলা যাবে। আপাতত দেখা যাক ফ্রয়েড এবং ফ্রয়েডপন্থীদের স্পষ্ট এবং সোজাসুজি রাজনৈতিক উক্তিগুলির কথা। এই উক্তিগুলি মোটেই রাজনীতি নিরপেক্ষতার পরিচয় নয়। তার বদলে, স্পষ্টাক্ষরে পুঁজিবাদী রাজনীতির সমর্থনমাত্র, কিংবা, যা একই কথা, মেহনতকারী জনগণের সমাজতান্ত্রিক রাজনীতির বিরুদ্ধে প্রচার মাত্র।
অবশ্যই মনে রাখতে হবে, বাস্তব পৃথিবীতে দিনের পর দিন পুঁজিবাদের পরমায়ু নিঃশেষ হয়ে আসছে। তার মানে, উলটো দিক থেকে বললে বলা যায়, দিনের পর দিন সমাজতন্ত্রের শক্তি হয়ে উঠছে দুর্বার, দুৰ্জয়। বছর বিশেক আগেকার পৃথিবীর অবস্থার সঙ্গে আজকের পৃথিবীর অবস্থােটা তুলনা করুন, এই বাস্তব সম্বন্ধে কোনো সন্দেহের অবকাশ থাকবে না। আর তাই, পুঁজিবাদের যাঁরা প্রচারক তাদের অবস্থা হয়ে উঠেছে বেপরোয়া, মরিয়া। ফলে তারই অপর পিঠে সমাজতন্ত্রের সমালোচনাটা পরিণত হচ্ছে নোংরা খিস্তি-খেউড়ে।
প্ৰায় বিশ বছর আগে স্বয়ং ফ্রয়েড সমাজতন্ত্র এবং মার্কসবাদের যে-সমালোচনা করেছেন তাঁর সঙ্গে আজকের দিনের ‘আন্তর্জাতিক সাইকো এ্যানালিটিক্যাল সোসাইটির’ সভাপতি আর্নসট জোনস-এর উক্তির তুলনা করুন।
প্ৰায় বিশ বছর আগে (১৯৩২-এ) ‘জীবনের দর্শন’ শীৰ্ষক প্ৰবন্ধ (৫) লেখবার সময় ফ্রয়েড বলছেন তাঁর–মনঃসমীক্ষণ বা সাইকোএ্যানালিসিসের–দার্শনিক মত (weltanschauung) আর কিছুই নয়—বৈজ্ঞানিক বিশ্বালোচনের নামান্তরমাত্র। এই বিশ্বালোচনের সমর্থন করতে গেলে বিপরীত বিশ্বালোচনের দাবি-অর্থাৎ, বিজ্ঞান বিরোধী বিশ্বালোচনের দাবি-খণ্ডন করা দরকার। এবং আধুনিক যুগে প্রচলিত বিজ্ঞান-বিরোধী বিশ্বালোচনের দাবি বলতে ফ্রয়েড প্রধানত দুটি মতের আলোচনা তুলছেন। এক হলো, “থিয়ােরি অফ রিলেটিভিটি’, যা কিনা ফ্রয়েডের মতে বিজ্ঞানের ঘরে জন্মেও বিজ্ঞানকে ধবংস করবার কাজে এক-রকম কালাপাহাড়ী উৎসাহে মেতে উঠেছে, প্রচার করতে শুরু করেছে বাস্তব বিশ্ব সম্বন্ধে সুনিশ্চিত বৈজ্ঞানিক জ্ঞান সম্ভব নয়। রাজনীতিতে নৈরাজ্যবাদের মতোই সংস্কৃতির ক্ষেত্রে এই ‘থিয়োরি অফ রিলেটিভিটির’ অনাচার! এবং বিজ্ঞান-বিরোধী দ্বিতীয় মতবাদ হিসেবে তিনি উল্লেখ করছেন মার্কসবাদের। অবশ্যই বিনয়ের অভাব নেই। তিনি বলেছেন “এ-বিষয়ে আমার ব্যক্তিগত জ্ঞানের যে-অভাব সে-সম্বন্ধে আমি গভীরভাবে দুঃখিত।” এবং এক আধা-অভিনন্দনের ভঙ্গিতেই স্বীকার করেছেন, “মার্কস্বাদের আসল যেটা জোর সেটা অবশ্যই তার ইতিহাস সম্বন্ধে মতবাদ নয়, কিংবা এই মতবাদের ভিত্তিতে মার্কসবাদ যে-ভবিষ্যদ্বাণী করে তাতেও নয়; আসলে সেই জোরটা হলো, মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা কেমনভাবে তার বুদ্ধিগত, নীতিগত এবং শিল্পগত প্ৰতিক্রিয়াগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করে সে-বিষয়ে স্পষ্ট অন্তদৃষ্টি। মার্কসবাদ আবিষ্কার করলো পারস্পরিক সম্বন্ধ এবং কার্যকারণ সম্বন্ধের এমন একটি গুচ্ছ যাকে ইতিপূর্বে প্রায় সম্পূর্ণভাবেই অগ্রাহ্য করা হয়েছে।” (স্বাধীন তর্জমা, আক্ষরিক নয়)। কিন্তু, ফ্রয়েড বলছেন, মার্কস-এর কয়েকটি বক্তব্য আমার কাছে অদ্ভুত মনে হয়, মনে হয় এগুলি বস্তুবাদী তো নয়ই, বরং কুট হেগেল-দর্শনের অবশেষমাত্র। যেমন সামাজিক গড়নের বিবর্তন প্রাকৃতিক ইতিহাসের পরিণামমাত্র, কিংবা সামাজিক স্তরবিন্যাসের ধারা ডায়ালেকটিক পদ্ধতি মেনে চলে। তাছাড়া মার্কসবাদে শ্রেণী সংগ্রামের যে-কথা তাও ভ্রান্ত। কেননা ফ্রয়েডের মতে ইতিহাসের শুরু থেকেই বিভিন্ন মানবগোষ্ঠীর মধ্যে যে-সংঘাত তারই ফলে সামাজিক শ্রেণীর জন্ম হয়েছে এবং এই সংঘাতে যে-গোষ্ঠী বিজয়ী হয়েছিলো তার সম্পদ ছিলো দুরকম। এক হলো মানসিক সম্পদ; যেমন, জন্মগত আক্রমণ-বৃত্তি। আর দুই, পার্থিব সম্পাদ: যেমন ভালো অস্ত্রশস্ত্র। তাছাড়া মার্কসবাদের বিরুদ্ধে ফ্রয়েডের মূল আপত্তি হলো অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণের উপর জোর দিতে গিয়ে মার্কসবাদ অন্যান্য বিষয়ের কথা ভুলে যায়, ভুলে যায় মনস্তত্ত্বের কথা, ঐতিহ্যের কথা। ইত্যাদি।