তর্ক তুলে আপনি হয়তো বলবেন, বাস্তব পৃথিবীর চাক্ষুষ অভাব-অভিযোগগুলো তাহলে কি কিছু নয়? শিশুমনের একটা আজগুবি আক্রোশই সব হলো ? পলাশীর প্রাঙ্গণ থেকে জালিয়ানওয়ালাবাগ, জালিয়ানওয়ালাবাগ থেকে সাতচল্লিশের দেশ-ভাগ—সব কিছুই হলো গৌণ, নিমিত্তমাত্র? ফ্রয়েডপন্থী বলবেন, তাই-ই। তা নইলে আমন আক্রোশের ভাবটা আসে কোথা থেকে? আবেগ-উত্তেজনায় আমন আত্মহারা হয়ে পড়া কেন ? রাজনীতির প্রেরণাটা যদি নিছক বাস্তববোধ থেকেই সঞ্চারিত হতো। তাহলে রাজনীতির আবহাওয়াটা হতো শান্ত, নির্লিপ্ত-বৈজ্ঞানিক গবেষণাগারের আবহাওয়াটা যে-রকম। আঁকি কষবার সময় আমরা যে-রকম স্থির অবিচলিত, বৈপ্লবিক আওয়াজ তোলবার সময় তো আর তা নাই। তার কারণ, গণিতের হিসেবা-নিকেশের খুঁটি হলো বাস্তববােধ, আর বৈপ্লবিক চেষ্টার ভিত্তিতে নির্জনের আবেগ।
এর পরও যদি আপনি নেহাত নাচার না হন তাহলে হয়তো প্রশ্ন তুলবেন: তাহলে সব দেশে সব যুগে তুমুল বৈপ্লবিক আন্দোলন চলছে না কেন ? বিদেশী শাসক না থাকলেও অন্তত স্বদেশী শাসক তো সর্বত্রই; বিদেশী শাসকের তবে দিন কাটে এমন দৃষ্টান্তও তো কম নয়। অর্থাৎ, ফ্রয়েডীয় পিতৃ-প্রতীক তো সর্বত্রই এবং ফ্রয়েডীয় মতে নির্জনের অন্ধ পিতৃদ্রোহটাও এমন কিছু একটা বিশেষ কালের মানব মনস্তত্ত্বের লক্ষণ নয়! অথচ, ইতিহাস-বিচারে দেখতে পাওয়া যায় যখন—তখন বিপ্লব হয় না, বৈপ্লবিক আন্দোলনের জন্যে বৈপ্লবিক পরিস্থিতির প্রয়োজন। এবং বৈপ্লবিক পরিস্থিতি বলতে একান্ত বাস্তব, একান্ত পার্থিব জিনিস বোঝায়-মোহমুক্ত সমাজতত্ত্ববিদ নিখুঁত বৈজ্ঞানিক হিসেব করে তার নিভুল রূপ নিৰ্ণয় করতে পারেন। এই যুক্তি ফ্ৰয়েডপহীকে হয়তো কিছুটা টলাতে পারে। তবুও তিনি নিশ্চয়ই আত্ম-প্ৰকল্প-ভ্ৰষ্ট সহজে হবে না। হয়তো জবাব দিয়ে বলবেন, এ-কথা অস্বীকার করে কী হবে যে বৈপ্লবিক পরিস্থিতি ছাড়া বৈপ্লবিক আন্দােলন হয় না। তবুওই পরিস্থিতিটুকুকেই বৈপ্লবিক আন্দোলনের মূল কারণ বলা চলবে না। মূল কারণ নির্জন আবেগের গরমিল, যে-গরমিল অন্য বাস্তব পরিস্থিতি পেলে তাকে আশ্রয় করে রাজনৈতিক বিপ্লব সৃষ্টি করে, বাস্তব পরিস্থিতি না পেলে অন্য কিছুকে অবলম্বন করে অন্য পথে আত্মচরিতার্থতা অন্বেষণ করে। উপমা দিয়ে ফ্রয়েডপন্থীর বক্তব্যটুকু ব্যাখ্যা করা যায়: অন্ধকার পথে মাতাল অবস্থায় গাড়ি চালাতে গিয়ে কেউ হয়তো একটা দুর্ঘটনা ঘটিয়েছে। অন্ধকার না থাকলে বা হাতে গাড়ি না থাকলে দুর্ঘটনা ঘটতো না নিশ্চয়ই। কিন্তু এগুলিই তো দুর্ঘটনার কারণ নয়। আসল কারণ হলো, চালকের মত্ত অবস্থা। হাতে গাড়ি না পেলে অন্য কিছুকে অবলম্বন করে অন্য কোনোভাবে তার মাতলামি আত্মপ্ৰকাশ করতে হয়ত! (৪)
এ কথা অবশ্যই স্পষ্ট যে বৈপ্লবিক রাজনীতি সম্বন্ধে ফ্রয়েডীয় মন্তব্যগুলি তার কয়েকটি মূল প্রকল্পের নিগমন-বিশেষ। ফলে সেই মূল প্রকল্পগুলি নিয়ে আলোচনা তোেলবার আগে রাজনৈতিক উৎসাহ সম্বন্ধে ফ্রয়েডীয় মতবাদের পূর্ণাঙ্গ জবাব দেওয়া সম্ভব নয়। এবং আত্ম-অভিজ্ঞতার পুনরুল্লেখ-প্রচেষ্টা জবাবদিহির মতো শোনাবে, জবাব হবে না। আপাতত তাই পূর্ণাঙ্গ জবাব দেবার চেষ্টাও করবো না, জবাবদিহির চেষ্টাও নয়। কিন্তু এখানে ফ্রয়েডপন্থীদের আত্মপক্ষ-দোষটুকু বৰ্ণনা করা অন্তত চিত্তাকর্ষক হবে। আত্মপক্ষ-দোষ বলতে বোঝাতে চাই, রাজনৈতিক উৎসাহের এই বিশ্লেষণকে যদিও আপাতত রাজনীতি-নিরপেক্ষ হবার ডাক বলে ভ্রম হতে পারে, তবুও প্রকৃতপক্ষে এর অর্থ দাঁড়ায় এক নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের প্রতি পক্ষপাতী হবার উমেদারিই। আর তাছাড়া যতো দিন যাচ্ছে ততোই বাস্তব রাজনীতিতে ফ্রয়েডপন্থীরা পক্ষপাতটুকু প্রকট থেকে প্রকটতর। হয়ে পড়ছে। অর্থাৎ, মতবাদগত তাৎপর্যের দিক এবং বাস্তব রাজনৈতিক পরিস্থিতির দিক—দুদিক থেকেই ফ্রয়েডপন্থীরা রাজনৈতিকভাবে মোটেই অনাসক্ত এবং অপক্ষপাতী নন, এক সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক পক্ষের apologists মাত্র। এই কথাটি মনে না রাখলে ফ্রয়েডতত্ত্বের স্বরূপ স্পষ্টভাবে বুঝতে পারাই সম্ভব হবে না।
মতবাদগত তাৎপর্যের দিক থেকে ফ্রয়েডবাদের রাজনৈতিক পক্ষপাতটা কীট-রকম প্ৰথমে তার আলোচনা করা যাক।
ফ্রয়েডপন্থী বলছেন, রাজনীতি নিয়ে উৎসাহটা সুস্থ আর স্বাভাবিক মনের পরিচয় নয়। কিন্তু এ-কথায় তো কোনো সন্দেহ নেই যে বাস্তব সমাজে, বাস্তব পৃথিবীতে, রাজনীতি বলে ব্যাপারটা একটা ধ্রুব সত্য। ফ্রয়েডীয় মতে, রাজনীতির মধ্যে সুস্থ মনের পরিচয় থাক আর নাই থাক বাস্তবভাবে প্রত্যেক যুগের মতো আজকের দিনেও একটা নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দল আমাদের জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করবার আয়োজন করছে। এ-ক্ষেত্রে আমাদের পক্ষে রাজনৈতিক নিরুৎসাহের একমাত্র অর্থ কী হবে ? বাস্তবভাবে আমাদের জীবনের উপর যে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ বর্তমান তাকেই মাথা পেতে মেনে নেওয়া, তাকে বদল করবার বা উচ্ছেদ করবার আয়োজনে যোগ না দেওয়া। অর্থাৎ, রাজনীতি সম্বন্ধে নিরপেক্ষ হবার প্রসঙ্গটা শেষ পর্যন্ত বর্তমান শাসক সম্প্রদায়ের রাজনীতিটাকে মাথা পেতে স্বীকার করে নেয়ার নির্দেশই। মেনে নিতে যদি আপনি অস্বীকার করেন, তাহলে ফ্ৰয়েডপন্থী এই অস্বীকারকে আপনার শৈশবের অন্ধ পিতৃদ্রোহের বিকাশ বলে বর্ণনা করবেন। তাই, দেশটাকে যে রাজনৈতিক দল যেমনভাবেই শাসন করুক না কেন, আপনি শুধু সে-সম্বন্ধে উদাসীন থাকুন, তাদের দিন ঢালাও সুযোগ।