সামাজিক দৃষ্টিকোণের কথা পরে তোলা যাবে। আপাতত, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার এজলাসে আমার জবানবন্দিন্টুকু পেশ করা যাক—যদিও স্পষ্ট ভাবেই বলে রাখতে চাই যে পূর্বপক্ষ-খণ্ডনের এক কৌশল হিসেবেই এই প্রচেষ্টা, অর্থাৎ কিনা বস্তুনিষ্ঠ বৈজ্ঞানিক বিচারের এজলাসে এই জবানবন্দির মূল্য সত্যিই সংকীর্ণ। জবানবন্দিটা হলো, শিক্ষার্থী হিসেবে দীর্ঘ দিন ধরে দৈনিক একঘণ্টা করে ফ্রয়েড-গোষ্ঠী-স্বীকৃত সুকৌশলী ফ্ৰয়েডপন্থীর কাছে আমি আত্মনিবেদন করেছিলাম এবং অপরোক্ষভাবে ফ্রয়েডীয় পদ্ধতির প্রয়োগ ব্যক্তিগতভাবে আমার নিজের উপর হতে দেখেছি এবং শেষ পর্যন্ত ফ্রয়েডসমাজ আমাকে জানিয়েছিলেন যে শিক্ষার্থীর পক্ষে যতোখানি গভীরভাবে এই পদ্ধতির সাহায্যে আত্মোপলব্ধির প্রয়োজন আমার ক্ষেত্রে তা সম্পূর্ণ হয়েছে। প্রসঙ্গক্রমে বলা দরকার, ফ্রয়েডপন্থীর মতেই সাধারণ রোগীর রোগলক্ষণ নিবারণের জন্যে যতোখানি গভীর মনঃসমীক্ষণ প্রয়োজন, শিক্ষার্থীর পক্ষে প্রয়োজন তার চেয়েও বেশি। আশা করি এই আত্মকাহিনীর নজির তোলবার পর ফ্রয়েডপন্থীরা আমার সমালোচনায় যুক্তিতর্ক ও বাস্তব দৃষ্টান্তর দোষক্ৰটি অন্বেষণ করবেন—আমার ব্যক্তিগত আবেগঅনুভূতিতে গরমিল আছে, এমনতরো দাবি করে আমার সমালোচনার জবাব দেবেন না। বলাই বাহুল্য, এই কৈফিয়তটা শুধুমাত্র প্রতিপক্ষের উদ্দেশ্যে, প্রতিবন্ধ-সংক্রান্ত ফ্রয়েডীয় সমালোচনা নয়। সে-সমালোচনা পরে তোলা হবে।
কিন্তু রাজনৈতিক উৎসাহ ? রাজনৈতিক মতবাদ? বিশেষ করে বৈপ্লবিক রাজনীতি ? ফ্রয়েডপন্থীর কাছে যে এ-জাতীয় উৎসাহের অন্তত চোদ আনা প্রেরণাই হলো নির্জন মনের সমীক্ষণ-সাপেক্ষ পিতৃদ্রোহ। এখানে ফ্রয়েডীয় বক্তব্যটার সঙ্গে সাধারণের অভিজ্ঞতা এবং ধারণার এতো তফাত যে সে-বক্তব্যের জবাব দেবার আগে বক্তব্যটা একটু বিশদ করা দরকার। ফ্রয়েডের মতে নিতান্ত শৈশবদশা থেকেই মানুষের মনে—পিতৃশাসনের বিরুদ্ধে একটা তীব্র আপত্তি আর বিদ্বেষ জমা হতে থাকে। তার কারণ, ফ্রয়েড বলেন, শিশুর কাছে অবাধ সুখভোগের আকাঙ্ক্ষাই জীবনের একমাত্র আকাঙ্ক্ষণ, অথচ শিশুর ক্ষুদ্র জগৎটুকুর মধ্যে পিতৃশাসনই এর বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড়ো বাধা। তাই বিদ্বেষ, পিতৃদ্রোহ। অবশ্যই বয়স বাড়াবার সঙ্গে সঙ্গে জাগতিক অভিজ্ঞতা এবং সামাজিক নীতি-শিক্ষার চাপে এই বিদ্বেষ, এই বিদ্রোহ, আমরা মনের গোপনে লুকিয়ে ফেলবার চেষ্টা করি। অর্থাৎ ফ্রয়েডের পরিভাষায়, নির্জ্ঞানের মধ্যে একে নির্বাসনে পাঠাই। কিন্তু নির্জ্ঞানে নির্বাসিত হলেও ওই পিতৃদ্রোহ মরে না, উপে যায় না। বয়ঃপ্ৰাপ্তির পরেও মনের মধ্যে টিকে থাকে। আর যদি টিকেই থাকে তাহলে তার পক্ষে চরিতার্থতা খোঁজবার পথই হবে একমাত্র পথ। কিন্তু সোজাসুজি চরিতার্থতার পথে বাধা দেখে ছদ্মবেশী চরিতার্থতার পথ খুঁজতে চায়। ছদ্মবেশী চরিতার্থতা নানান রকমের। তার মধ্যে এক রকম হলো বৈপ্লবিক রাজনীতি। কিন্তু কেন? কেমন করেই বা? ফ্রয়েডপন্থী বলবেন, পরিণত বয়সে আমরা যখন পারিবারিক অভিজ্ঞতার ক্ষুদ্র গণ্ডিটুকু থেকে
আমাদের কাছে পিতাই আর একমাত্র শাসক—একমাত্র কর্তৃপক্ষ—নন। শাসক বলতে—কর্তৃপক্ষ বলতে—তখন সরকার, সরকারী ব্যবস্থা, আমলা, রাজপুরুষ। ফ্রয়েডীয় পরিভাষায় এ-সবই হবে পিতৃ-প্রতীক, ‘ফাদার-ইম্যাগো’। অর্থাৎ শিশুমনের কাছে পিতা যেভাবে শাসকের জায়গা জুড়ে ছিলেন পরিণত মনের কাছে এইগুলিই সেই রকম জায়গা জুড়ে থাকে। তাই, শৈশবের ওই সঞ্চিত পিতৃ-বিদ্বেষ পরিণত বয়সে এই পিতৃ-প্রতীকগুলির উপর গিয়ে পড়ে। অর্থাৎ বিপ্লবের মনোভাব। বৈপ্লবিক রাজনীতি। অবশ্যই, দায়িত্বশীল ফ্রয়েডপন্থী স্বীকার করবেন যে রাজনীতির মধ্যে ষোলো আনাই এই রকম নির্জন মনের পিতৃ-বিদ্বেষ নয়। অর্থাৎ, রাজনীতির মধ্যে কিছুটা শুদ্ধ ও নির্মল রাজনৈতিক হিসেবা-নিকেশের পরিচয় থাকতে পারে। কিন্তু রাজনীতির মধ্যে আবেগ-উত্তেজনার যে-দিক সেটা নিজ্ঞানের পিতৃদ্রোহই। এবং অনেকের ক্ষেত্রে, ফ্রয়েডপন্থী বলবেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই—নির্জনের জটিলতা, সচেতন মনের তথাকথিত নির্মল হিসেবা-নিকেশকে অজুহাত হিসেবে হালের ইতিহাসে সাধারণ মানুষ “বন্দেমাতরম” বলে বিদেশী শাসকদের বিরুদ্ধে উত্তেজনায় অধীর হয়ে উঠেছিলো। এর পিছনে কি শুধুই নির্মল রাজনৈতিক চেতনার পরিচয়? ফ্রয়েডপন্থী নিশ্চয়ই তা স্বীকার করবেন না। তিনি বলবেন: মানুষের মনের কাছে জননী আর জন্মভূমি এক জিনিস। অর্থাৎ মাতৃভূমি হলো মাতৃপ্রতীক, ‘মাদার-ইম্যাগো’। এবং ফ্রয়েডীয় মতে শিশুমনের সবচেয়ে বড়ো চাহিদা মাকে ভোগ করবার আকাঙ্ক্ষণ (ইডিপাস কমপ্লেংকস)। আসলে ওই পিতৃ-বিদ্বেষের মূলেও রয়েছে এই ভোগাকাঙ্ক্ষা : মাকে একান্তভাবে পাবার সবচেয়ে বড়ো বাধা হলো বাবা, অবাধ উপভোগের যে-চাহিদা তার বিরুদ্ধে পিতার শাসনই সবচেয়ে কঠিন। এখন, মাতৃভূমি যদি মাতৃ-প্রতীক হয়। আর মানুষ যদি দেখে তার এই মাতৃ-প্রতীককে বিদেশী শাসকের দল এমনভাবে উপভোগ করছে, যে তার নিজের পক্ষে উপভোগের সম্ভাবনা বন্ধ—অথাৎ বিদেশী শাসকের দল হয়ে দাঁড়িয়েছে নিখুঁত পিতৃ-প্রতীক—তাহলে দেশের মানুষ তো মায়ের নামে ক্ষেপে উঠবেই। “বন্দেমাতরম” বলে ওই ছোট্ট আওয়াজটুকুর মধ্যে আমন অদ্ভুত যাদুশক্তির যোগানটা ঠিক কোথা থেকে তার হদিস দিয়ে ফ্রয়েডপন্থী তাই বলতে চাইবেন, এর ভিতর একটি গুঢ় মানসিক তত্ত্বকে সর্বাঙ্গীণভাবে ব্যবহার করবার নিপুণ আয়োজন রয়েছে যে।