ফ্রয়েডীয় মতবাদের এই মূল দাবি মনে রাখলে বুঝতে পারা যাবে, বিপক্ষ আলোচনার মধ্যে মনোবিকারের লক্ষণ খোঁজবার ব্যাপারে ওঁদের সঙ্গতিটা ঠিক কোথায়। ওই নির্জন মনের কথা যদি বৈজ্ঞানিক বাস্তব হয়, এবং ফ্রয়োভীয় আলোচনার প্রধান উৎসাহ যদি ওই নিজৰ্দ্ধানের উপর আলোকপাত করবার চেষ্টাই হয়, তাহলে সে-আলোচনার বিরুদ্ধে আমাদের তরফ থেকে প্রতিবন্ধ জাগা তো স্বাভাবিকই; সভ্যমানুষ সদাসর্বদা নিজের সম্বন্ধে যে-কথা এমন কি নিজের কাজ থেকেও গোপন করতে চায়, সেই কথা প্ৰকাশ করে দেবারই প্রধান তাগিদ ফ্রয়েডের, ফলে ফ্রয়েডের বিরুদ্ধে সভ্যমানুষের স্বাভাবিক। আপত্তি। এবং তার আপত্তিই ততো বেশি যার নিজের মনে নিৰ্ত্তান মনের উৎপাত যতো প্রবল। কেননা, তার মনে সজ্ঞানে-নির্জনে রফা হয়নি, দুয়ের মধ্যে প্রবল দ্বন্দু। অতএব, ফ্রয়েডবাদের বিরুদ্ধে আপত্তির বহর দেখেই আন্দাজ করা চলে কার মনে সজ্ঞানে-নির্জনে দ্বন্দুটা কী রকম। ফ্রয়েডীয় মতে এই দ্বন্দুের নামই হলো মনোবিকার। তাই বিপক্ষ সমালোচনার মধ্যে মনোবিকারের লক্ষণ।
অবশ্যই প্রশ্ন উঠবে, বিরুদ্ধ সমালোচনা যদি একান্তই প্রতিবন্ধ-প্রসূত হয় তাহলে কি ফ্রয়েডবাদকে ধ্রুব সত্য বলে সোৎসাহে মেনে নেওয়াই সুস্থ ও বৈজ্ঞানিক মনের একমাত্র পরিচয় ? ফ্রয়েড বলবেন, তাও নয়। অতিভক্তিটা আবার যে চোরের লক্ষণ! মাত্রাতিরিক্ত উৎসাহ নিয়ে ফ্রয়েডবাদের কাছে আত্মনিবেদন করবার ভঙ্গিটাও ফ্রয়েডের মতে ওই একই প্ৰতিবন্ধের উলটো দিক মাত্র, কেবল এর মধ্যে এমন এক চালাকি আছে যে প্ৰতিবন্ধের পরিচয়টা চট করে চোখে পড়ে না। দৈনন্দিন ব্যবহারের মধ্যেও এ-রকম চালাকির নমুনা দুর্লভ নয়। যেমন ধরুন, একজন কেউ এমন সব কথা বলছে বা এমন মত প্ৰকাশ করছে যা আমার কাছে একেবারে বিরক্তিকর মুখতার সামিল। আমি তার সঙ্গে জোর গলায় তর্ক করতে পারি। কিন্তু যদি চালাকি করতে চাই তাহলে হয়তো খুব সোজাসুজি—এমন কি সোৎসাহ বিস্ময়ের অভিনয় করে-তার সব কথা সরাসরি মেনে নিয়ে তার মুখ বন্ধ করে দেবো। তার কথা তখন আর আমার স্পর্শও করবে না, বিব্রতও করবে না।
প্রশ্ন হলো, তাহলে? যদি বিরূপ সমালোচনা আর সোৎসাহ স্বীকৃতি দুয়ের পিছনেই মানসিক গণ্ডগোলের পরিচয় থাকে তাহলে কি ফ্রয়েডীয় মতে ফ্রয়েডবাদকে যাচাই করবার-এমন কি সম্যকভাবে চেনবার আর বোঝাবার-কোনো পথই নেই ? উত্তরে ফ্রয়েড যে-কথা বলছেন তা সত্যিই অতি-দুরূহ এক দাবি: বই পড়ে বা মাথা ঘামিয়ে এ-মতবাদকে চেনা-জানা যায় না, এর যাথার্থ্য-বিচার তো দূরের কথা। (১) ফ্রয়েড বলছেন, একে চেনবার-জানবার একমাত্র পথ হলো সহাদয়-সংশয়ের (benevolent scepticism-এর) মনোভাব নিয়ে কোনো এক ফ্রয়েডপন্থীর কাছে আত্মনিবেদন করতে হবে। (২) তিনি জানেন, মনের প্রতিবন্ধ ভাঙবার কৌশলটা ঠিক কী, যদিও অবশ্য দুঃখের বিষয় এ-ব্যাপারে সহজ আর সিধে কোনো পথ এখনও আবিষ্কৃত হয়নি। সাধারণত ফ্রয়েডীয় কৌশলে পারদর্শী ফ্রয়েডপন্থীর পক্ষে কাজ সমাধা করবার জন্যে একটানা দু-তিনশো দিন ধরে দৈনিক একঘণ্টা করে চেষ্টার আয়োজন। তাছাড়া, এই কলাকৌশলেরই একটা অঙ্গ হলো নগদ-দক্ষিণা (রুপোর টাকায়) গ্ৰহণ করা। তা নইলে কাজ করে না। ফলে, ব্যাপারটা শুধু সময়-সাপেক্ষই নয়, ব্যয় সাপেক্ষও। তবু ফ্রয়েডীয় মতে এ ছাড়া আর কোনো পথ নেই। এইভাবে নিজের উপর একান্ত ব্যক্তিগত প্রয়োগ না দেখলে ফ্রয়েডের মতে তার মতবাদ সম্বন্ধে স্পষ্ট ধারণা পাওয়াই সম্ভব নয়, সমালোচনার অধিকার তো দূরের কথা। মনে রাখতে হবে, ফ্রয়েডীয় কলাকৌশলে শিক্ষা লাভ করবার ব্যাপারেও প্রথমে নিজের উপর এর প্রয়োগ করানোর নির্দেশ। অর্থাৎ, সাধারণ রোগীর চিকিৎসা করবার সময় ফ্রয়েডপন্থী যেমনভাবে দীর্ঘদিন ধরে রোগীর উপর তার পদ্ধতির প্রয়োগ করেন, ঠিক তেমনিভাবেই শিক্ষার্থীর উপরও প্রয়োগ করবেন। ওই একই পদ্ধতি। (৩) তাঁর যুক্তিটা সহজ: এইভাবে শিক্ষার্থীর পক্ষে শুধুই যে ফ্রয়েডীয় কলাকৌশল সম্বন্ধে অপরোক্ষ পরিচয় পাবার আশা তাই নয়, ফ্রয়েডবাদের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীর সভ্য মনে যে স্বাভাবিক প্রতিবন্ধ তা দূর করবারও এই হলো একমাত্র পথ।
ফ্রয়েডীয় কলাকৌশল এবং তার মতবাদের বিভিন্ন দিকগুলি নিয়ে পরে খুঁটিয়ে আলোচনা তুলবো। কিন্তু তার আগে যে-কথা শুরু করেছিলাম।–অর্থাৎ ওই সমালোচনার অধিকার নিয়ে কথা। স্পষ্টই দেখা যায়, অধিকারভেদের কথা তুলে ফ্রয়েডপন্থী ব্যাপারটাকে একান্ত ব্যক্তিগত এক স্তরে নিয়ে যেতে চান। এ দাবির বৈজ্ঞানিক তাৎপৰ্য যাই হােক না কেন, সমালোচককে বিব্রত করবার ব্যাপারে। এর ব্যবহারিক মূল্য আছে। কেননা, এর প্রকৃত বৈজ্ঞানিক উত্তর দিতে গেলে বস্তুনিষ্ঠ প্ৰমাণ-অপ্রমাণের নির্ভরে দেখানো দরকার যে, যে-মূলসূত্রগুলির উপর এ-দাবি প্রতিষ্ঠিত সেগুলিই সংশয়াত্মক বা ভ্ৰান্ত। অথচ, সেই প্ৰচেষ্টাকেই সুযোগ পাবেন। তাই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার স্তরেই সমালোচকের পক্ষে যদি কোনো জবাব দেবার অবসর থাকে তাহলে অন্তত কৌশল হিসেবে তার উল্লেখ। অপ্রাসঙ্গিক হবে না। কৌশল হিসেবে বলছি, কেননা বিজ্ঞান বা বিজ্ঞানসম্মান্য মতবাদের বিচারে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা-অনভিজ্ঞতার সাক্ষ্য তো সত্যিই সংকীৰ্ণমূল্য; তবুও তার উল্লেখ অন্তত ফ্রয়েডপন্থীকে সস্তুষ্ট করবে—নইলে তো। তিনি স্বপক্ষাদোষে দুষ্ট হবেন। প্রসঙ্গত বলে রাখা যায় যে সমালোচনা-সূত্রে আরো অগ্রসর হলে আমরা দেখতে পাবো ফ্রয়েডের এই দাবি এক বিশেষ সামাজিক দৃষ্টিকোণের অনিবার্য পরিমাণ মাত্র। সমাজতত্ত্বের প্রচলিত পরিভাষায় তার নাম বুর্জোয়া শ্রেণীর দৃষ্টিকোণ—যা কিনা, একান্তই আত্মকেন্দ্রিক ও ব্যষ্টিকেন্দ্রিক (subjective s individualistic) হতে বাধ্য। তাই, সমালোচনার যথার্থ্য তাঁর কাছে শুধুমাত্র বস্তুনিষ্ঠ প্ৰমাণ-অপ্ৰমাণের উপর প্রতিষ্ঠিত নয়-অধিকারভেদের, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার মুখাপেক্ষী।