তারপর গাড়ি চলতে শুরু করল। পর পর কতগুলো বাস বাতাসের ঝাপটা দিয়ে চলে গেল। জানলার পাশে দু’একজন যাত্রী একটু ঝুঁকে কাঞ্চনদের দেখল। নানা ধরনের শব্দের ভেতর। ঘোড়র ক্ষুরের অলস অথচ একটানা আওয়াজ কাঞ্চনের মনে কিসের যেন অনুষঙ্গ আনতে চাইছে। গাড়িটা দক্ষিণে ঘুরল। কাৰ্জন পার্কের পাশ দিয়ে স্বল্প আলো আর নির্জনতার দিকে ধীরে এগোতে লাগল। এসপ্ল্যানেডের মোড়ের সেই আশ্চর্য শব্দপ্রবাহ স্তিমিত হয়ে পেছনে পড়ে রইল, যেন এক চিত্রিত শব। এখন কৃচিৎ রিকশার গুঞ্জন, দু-একটা গাড়ির দ্রুত অন্তর্ধান, পথচারীর আকস্মিক কণ্ঠস্বর। কাঞ্চন এতক্ষণে অনুভব করল চৌরাস্তার ভিড়ে ঘোড়ার গাড়িতে বসে থাকতে সে অত্যন্ত কমপ্লেক্স বোধ করছিল।
আর বৃষ্টি নামল। রেখা বাইরে হাত পেতে ধরলা ফোঁটা ফোঁটা জলে হাতটা অপরূপ হয়ে উঠল রেখার আঙুলগুলিতে একটি মুদ্রার ভঙ্গি। ঘোড়ার ক্ষুরের অলস অথচ অবিচ্ছিন্ন শব্দপ্রবাহে কাঞ্চনের মনে হঠাৎ নূপুরের মৃদু, অস্ফুট শব্দতরঙ্গের অনুষঙ্গ এলা। সারেঙ্গিতে গাঢ় পুরুষালি ছড়ের টানে চন্দ্রকোশ বেজে উঠল। রাধার চোখ, রাধার আঙুলে মিনতি! সঈ, কেনা বাশী বা কালিনী নঈ কূলে। কড়ি মধ্যম সমুদ্র স্তম্ভের মতো কোমল ধৈবতে ভেঙে পড়ে কোমল গান্ধার ছুঁয়ে ষড়জে ফিরে এল। আর বৃষ্টি দ্রুত হল। চাকার শব্দ, ক্ষুরের শব্দ। বৃষ্টির মাঝে মাঝে সহিসের চাবুক বাতাসে একটা সূক্ষ্ম মীড় টেনে দিচ্ছে। অজস্র জলবিন্দু ওদের মুহূর্তে ভিজিয়ে দিল।
‘বাবু?’
‘কেন?’
‘পর্দাটা ফেলে দিব?’
কাঞ্চন জানত না এ জাতীয় ফিটনে পরদা থাকে। অবাক হয়ে বলল, ‘দাও।’ মুহূর্তে যেটাকে ভেবেছিল গাড়ির ছাউনি, তার ওপর থেকে দুপাশে দুটো চামড়ার পরদা ঝুলে পড়লা আর হঠাৎ তারা সমস্ত পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল।
স্তব্ধ দুজনে বসে রইল। কেউ কারোর দিকে তাকাতে পারছে না। এ কি আশ্চর্য ঘটনা! আমরা নির্জনতা খুঁজতাম, যেখানে ঘনিষ্ঠ বসা যায়। কলকাতা শহরে নির্জনতা নেই। আমরা অবসর খুঁজতাম, যেখানে নিবিড় হওয়া যায়। আমাদের জীবনে অবসর পাই না। আমরা একটা পরিমণ্ডল খুঁজতাম, যেখানে আমরাই অধীশ্বর। আমাদের সময় সে পরিমণ্ডল দেয় না। অথচ আজ, অথচ একি, অথচ এভাবে বন্ধ গাড়ি চলছে, বাইরে বৃষ্টি আজ আমাদের বিবাহের প্রথম বার্ষিকী। আমার স্ত্রী রেখা—পরমেশ্বরকে সাক্ষী করে—ধর্মপত্নী…
‘এই, কি ভাবছ?’
কাঞ্চন দীর্ঘশ্বাস চেপে বলল, ‘কিছু না।’ বলেই হেসে ফেলল। কারণ এর পরেই সে জানে রেখা বলবেকথা নয়, ভাবনা নয়, তাহলে এখন তোমার মনে ‘সিচুয়েশন ভেকেন্ট’ নোটিশখানা আবার ঝুলিয়েছ? কিন্তু রেখা কাঞ্চনের মুখের দিকে অপলক তাকিয়ে শুধু বলল, ‘কিছু বলো।
হাতের তেলোর ওপর মাথা রেখে ঘাড়টা পেছন দিকে ঈষৎ ঝুলিয়ে জানুর ওপর আড়াআড়ি পা ফেলে রেখা শিথিল ভঙ্গিতে বসেছিলা একগোছা ভেজা চুল কপালের ওপর টিকলির মতো কুঁকড়ে ঝুলে আছে। গর্বে আনন্দে রেখা যেন রাজেন্দ্রাণী।
প্রায়ই আজকাল রেখাকে অপরিচিত মনে হয়। কি এক ঔদাসীন্যে হঠাৎ সে অনেক দূর চলে যায়। আসলে গত একবছরে, বিয়ের পর, আহ আমাদের বিয়ে একটা কৌতুক। কিন্তু সত্যিই তো তারপর রেখাকে নতুন করে কিছুই জানিনি। রেখার শরীর না, মন না, অভ্যাস না। আসলে আমরা দুজনেই আমাদের অনেক আকাঙ্ক্ষা পরস্পরের কাছে গোপন করে যাচ্ছি, নিজের কাছে মহৎ থাকার তাড়নায় পরস্পর ছদ্মবেশ পরেছি।
‘কিছু বলল না গো?’
রেখার মুখে গো শব্দটা কাঞ্চনকে চমকাল। বাস্তবিক, অবস্থায় পরিবেশে শব্দের ওজন কি আশ্চর্য বদলে যায়। অন্য সময় হলে গ্রাম্য বলে পরিহাস করার সুযোগ নিশ্চয়ই ছাড়তাম না। আসলে আমি তো আমি, আমার তাবৎ অস্তিত্ব এমনই কিছু সম্বোধনের জন্য কাঙাল হয়ে থাকে।
‘বউ?’
রেখা উদ্ভাসিত মুখে কাঞ্চনের দিকে তাকাল।
‘বউ?’
‘উঁ?’
‘আমাকে একবার স্বামীন বলে ডাকবে?’
‘যাহ।’
‘ডাকোনা?’
‘যাহ।‘
‘প্লীজ একবার ডাকো।
‘না গো, ভীষণ লজ্জা করে।’
‘আচ্ছা, ফিসফিস করে বলো। একবারটি শুনতে ভীষণ ইচ্ছে করছে। আসলে বুঝলে—‘
রেখা কাঞ্চনের কথার মধ্যে হঠাৎ স্পষ্ট করে বলল, ‘স্বামীন।’ বলেই দুহাতে মুখ ঢেকে ঝির ঝির করে হেসে উঠল। হাসিটা হঠাৎ ক্ষুরের শব্দের সঙ্গে এক হয়ে মিশে গেল। কাঞ্চন নাকে ভেজা মাটির গন্ধ পেল।
ছুঁতে ইচ্ছে করছে। খোঁপাটা খুলে একমুঠো ফুলের মতো চুলগুলো যদি রেখার মুখে-বুকে। ছড়িয়ে দিই! হাতটা ধরব? কান পেতে রেখার হৃৎপিণ্ডের শব্দ যদি শুনতে পেতাম? আমার রক্ত, আমার মন বৃষ্টি হতে চায়। একটা কথা ধ্রুব বুঝেছি। বৈষ্ণব কবিরা যৌবন সম্পর্কে যে উল্লাস প্রকাশ করেছেন, তা মিথ্যো আসলে যৌবন আমাদের লজ্জা, আমাদের যন্ত্রণা। আমি পারি না, আমি পারি না এখানে রেখাকে অপমান করতে।
আঁচল সরে গিয়েছিল একটা সেফটিপিনা কাঞ্চনের খুব ইচ্ছে হল বলে, জামায় বোতাম লাগিয়ে নিতে পারো না?বলল, ‘কি দেখছ এমন করে?
রেখা হাসল। বলল, ‘জানো, আজ প্রথম লক্ষ্য করলাম তোমার গলায় একটা তিল আছে।’
‘এই অন্ধকারে?’
‘হুঁ। যখন সিগারেট ধরালে, হঠাৎ তোমার—‘
‘যাহ।‘
‘ভালো লাগছে তোমার?
‘খুউব।’
ভালো লাগছে রেখার। কি অমোঘ এই ভালো লাগা। আমি জানি রেখা কি চায়। আমি জানি আমি কি চাইছি। অশ্বক্ষুরের ধ্বনি চেতনা অবশ করেছে। এই আমার শরীর গীর্জার উজ্জ্বল মোমবাতি, বিন্দু বিন্দু ঘাম ঝরে পড়ছে। অশ্বমেধ যজ্ঞের গর্বিত ঘোড়াটি ঘাড় বেঁকিয়ে আগুনের নিঃশ্বাস ফেলে চলে গেল আর দ্রাবিড়-কন্যা আর্য-ঘোড়সওয়ারের পায়ের তলায় হা হা করে। কেঁদে উঠল। তারপর চেঙ্গিজ খাঁর অশ্বারোহী দল শেকল বেঁধে দাসদের টেনে নিলা তারপর লরেন্স ফস্টর ধুলো উড়িয়ে দিল্লীতে পতাকা ওড়াল। আর পতাকার রঙ পালটায়। স্বর্গের উচ্চৈঃশ্রবা এখন ধর্মনিরপেক্ষ কলকাতার মাঠে পাটোয়ারী বুদ্ধিতে বাজি দৌড়য়। আর যে যজ্ঞের অশ্বকে ফিরিয়ে আনতে ভগীরথ মর্ত্যে গঙ্গা এনেছিল, মাত্র আড়াই টাকার বিনিময়ে সে আমাদের খিদিরপুর পৌঁছে দেবো কাঞ্চন চোখ বন্ধ করে ক্ষুর এবং হ্রেষাধ্বনি শুনতে লাগল। সত্য যে, দিগ্বিজয়ী অশ্বের শোণিতে যজ্ঞের আহুতি পূর্ণ হয়।