‘তাহলে তো বেঁচে যাই।’
কাঞ্চন হাসতে হাসতে বলল, কিন্তু দীর্ঘশ্বাস চাপতে পারল না। রেখা ঠোঁটে ফুল ফুটিয়ে প্রশ্ন করল, ‘আহা, অ্যাজমাটা আবার মাথাচাড়া দিল?’
কাঞ্চন বলল, ‘জানো, এই কথার খেলা সত্যি আর ভালো লাগে না।’ রেখা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়াল।
ভালো লাগে না। ভালো লাগে না। চুরি করে একটু সময় নেওয়া, দুটো কথা, এক পেয়ালা কফি, লম্পট নদীতীরে নির্জনতার ব্যর্থ অন্বেষণ, তারপর অক্ষম ক্লান্তি ও ক্ষোভে অপরিচিতের মতো ঘরে ফিরে যাওয়া। একদিন, কোনো এক নিকট অথচ বিস্মৃত অতীতে, সবই ছিল স্বপ্না আর আজ, আর এখন, ঘেন্না করে। একই অভ্যাসবোধ, একই পরিবেশ, একই চায়ের দোকান আর রাস্তা আর গঙ্গার ধারের গাছতলা। এক ধরনের কথা বা কথা খুঁজে না পাওয়া বদল নেই, হায়! অথচ কলকাতা প্রতিমুহূর্তে বদলায়। পৃথিবী বদলায়। জীবন বদলায়। আমাদের বয়েস বেড়ে যাচ্ছে, মনে মনে আমরা আরও দ্রুত বুড়িয়ে যাচ্ছি। অথচ সেই মৌলিক ছকের ওপর খুঁটির মতো এগোচ্ছি, পেছোচ্ছি। এ-যুগের নিয়তিই হল বাল্য এবং প্রৌঢ়তা—মধ্যিখানে বিশাল চড়ায় ইচ্ছা ও অভিজ্ঞতা, ভালো লাগা, আর কর্তব্যের বিরোধে পোকার মতো গর্ত খুঁড়ে নিচে নামছি— অথচ সামনে সমুদ্র ছিল। হায় রে সমুদ্র! নিজেকে ফাঁকি দিচ্ছি কথায়, রেখাকে ফাঁকি দিচ্ছি কথায় আর পুঁথি থেকে তার সমর্থন খুঁজছি। কি যেন সেই কি যেন…ফুলগুলি কথা আর পাতাগুলি চারিদিকে পুঞ্জিত নীরবতা। সমুদ্রের মৌন, বক্ষের কাছে পূর্ণিমা লুকানো আছে। দিনে দিনে অর্ঘ্য মম। দিনে দিনে রূপবতী হবে পৃথিবী দিনের পর রাত্রি। কিন্তু রাত্রির পর? রাত্রির পর?
‘এই, এ-ভাবে হাঁটলে পথেই বৃষ্টি নামবে।’
উত্তরে অন্যমনস্কর মতো কাঞ্চন চিৎকার করে উঠল, ‘গাড়োয়ান, রেককে।’ বলেই সে নাকে মালতীফুলের গন্ধ পেল। কারণ শ্রীকান্তর গহর-ভাইয়ের কথা মনে পড়েছিল।
রেখা বলল, ‘ক্ষেপেছ?’
কাঞ্চন শুনল, নতুন গোঁসাই, ওঠো! অথচ সে সচেতন ছিল এসপ্ল্যানেডের সামনে দাঁড়িয়ে, সঙ্গে রেখা।
‘খিদিরপুর কেতনা?’
লুঙ্গির খুঁট দিয়ে গলাটা মুছে গাড়োয়ান বলল, ‘সওয়ারী কিধার?’
‘দেখতে পাচ্ছ না?’ কাঞ্চন বিরক্ত কারণ গাড়োয়ানের রক্তাভ চোখের হাসি তার কারণ ও অশ্লীল মনে হল। অথচ বিদেশী উপন্যাস এবং মধুসূদন দত্তের কলকাতার ইতিহাস পড়ে ঘোড়ার গাড়ি সম্পর্কে মনে যে স্মৃতির পরিমণ্ডল জন্ম নিয়েছে, তার চেহারা অন্য।
‘পোলের ওপারভি যাবেন?
‘না।’
‘গঙ্গার কিনারা দিয়ে?’
‘হ্যাঁ।’
‘চার টাকা লাগবে স্যার।’
চমকে উঠে বিরক্ত কাঞ্চন বলল, ‘ঠিক আছে।’
চলে যেতে দেখে গাড়োয়ান গাড়িটা এগিয়ে নিয়ে প্রশ্ন করল, ‘কত দিবেন?’
রেখা হঠাৎ উত্তর দিল, ‘দু-টাকা।’
কাঞ্চন গম্ভীর হয়ে রেখার দিকে তাকাল। রেখা দর কষছে? রেখা এই অশ্লীল, ধূর্ত গাড়োয়ানটার সঙ্গে যেচে কথা বলল, রেখা কি আজ প্রতিপদে প্রমাণ করবে আমি কাপুরুষ, আমি
জীবন থেকে পালাচ্ছি? রেখা কি আজ, রেখা কি, এই সব ছুটকো স্মার্টনেস, অথচ রেখার পক্ষে–
‘তিনটে টাকা দিন মা।’
রেখা হেসে কেটে কেটে বলল, ‘ট্যাকসিতে দু-টাকাও লাগে না।’
গাড়োয়ানটা আহত ভঙ্গিতে সামনে ঝুঁকে একটা ঘোড়ার রোগা পিঠে চাপড় মেরে নিজের জিভে আক্ষেপ প্রকাশ করে বলল, ‘আরে হায়, মিসিন আর জানবার এক হল দিদি? আচ্ছা, আট আনা বখশিস দিয়ে দেবেন। আচ্ছাসে ঘুমিয়ে দিব।’
লাফিয়ে নেমে যখন দরজাটা খুলে ধরল তখন আবার রেখাকে অপরিচিত মনে হল বিব্রত, ভীত চোখে সে কাঞ্চনের দিকে তাকাল, তারপর গাড়িটার ভেতরো ব্রুদ্ধ কাঞ্চন কোনো কথা না বলে ত্বরিতে উঠে পড়ল।
আঁচলটা ভালো করে জড়িয়ে রেখা এক কোণে কুঁকড়ে বসেছিল। উল্টোদিকের গদিতে নিজেকে ছড়িয়ে প্রায় আধশোয়ার ভঙ্গিতে বসে কাঞ্চন চারমিনার বের করল। ভেবেছিল রেখা এত তাড়াতাড়ি আবার সিগারেট ধরাতে নিষেধ করবে। কিন্তু রেখা নির্বাক লাল আলোের সংকেতে গাড়ি তখনও ট্রাম লাইনের ওপারে যেতে পারে নি কাঞ্চন অদ্ভুত আনন্দ বোধ করল। রেখা এই আলো, এই অরণ্য, এই পরিপার্শ্বকে ভয় পাচ্ছে। ঘোড়ার গাড়িতে আমার সঙ্গে উঠেছে তাই ভয় পাচ্ছে। আমার সঙ্গে উঠে ভয় পাচ্ছে। ফিটনের দু-পাশ খোলা। সত্যিই চারদিকে অমতের অজস্র সন্তান কে না কে দেখছে জানি না। রেখার পরিবার আছে, সমাজ আছে, আমি একটা পুরুষ। ওহো, আমি পুরুষ। বেড়ে।
‘আলোর দিকে মুখ রাখুন হলদের পর সবুজ আলো জ্বললে দুই দাগের মধ্য দিয়ে সাবধানে রাস্তা পার হন। মনে রাখবেন, জীবন অমূল্য সামান্য ভুলের মাশুল ভয়ানক। আলোর দিকে মুখ রাখুন
কাঞ্চন হা হা করে হেসে উঠল।
‘কি?’
‘সাবধানে পথ চলুন সপ্তাহ। ফলে আরও ট্রাফিক জামা বেশ বলেছে, আলোর দিকে মুখ রাখুন। তোমার যাবতীয় জেসচার আর ঘোষণাটা মিলে পুরো শরৎ চাটুজ্জে টাইপ।’
‘কি আর করি বলো? প্রবোধ সান্যালের নায়কের সঙ্গে প্রমোদ ভ্রমণে বেরিয়ে রবীন্দ্রনাথের নায়িকা হলে গুরুচণ্ডালীর দোষ সামলাবে কে?
কাঞ্চন সিগারেটে টান দিল। রেখার স্মার্ট উত্তর তাকে এই মুহূর্তে যথেষ্ট বিরক্ত করেছে। অথচ আমি জানি না ঠিক কি চাই। কি হলে খুশি হতামা রেখার অস্বস্তি মিথ্যে নয়, তুচ্ছ নয়। আমি একটা কলেজের শিক্ষক। রেখাকে এনে সংসারে স্ত্রীর মর্যাদা দেবার সাধ্য আমারই নেই। বাড়ির ক্রমাগত বিয়ের সম্বন্ধ ভেঙে, যাবতীয় লুকোচুরির নিষিদ্ধ পথে সে তার ভালোবাসা—রেখাই উদ্যোগ নিয়ে রেজিস্ট্রেশন—তার ভয় শেষ পর্যন্ত বাবা নিষ্ঠুর—শেষ পর্যন্ত বাবা কিছুতেই জাতের অভিমান—তখন তাঁকে ঠেকাবে বিয়ের দলিল—কারণ সে জানে আমাদের হতকুৎসিত সংসারে হঠাৎ চলে আসা সম্ভব নয়া সে জানে যতদিন না অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ছে ততদিন তার পক্ষেও বাবাকে আঘাত দেওয়া— আহ, এইভাবে ঠিক এইভাবে আমরা স্বার্থপর হতে পারি না। অথচ যাদের জন্য ত্যাগ, তাদের প্রতিও মনে মনে বিদ্বেষ পোষণ করি। আর দুঃখ পাই। নিজের কাছে ক্রমাগত ছোট হতে থাকি। অথচ জানি না ঠিক কি চাই।