‘দ্যাখো, সেই পেয়ারটা’। কাঞ্চন অন্যমনস্কের মতো তাকিয়ে যুগলটিকে দেখল। কিন্তু তার চোখের সামনে স্পষ্ট করে ভেসে উঠল সুকুমার, প্রফুল্ল আর চন্দন। ওরা প্রায় পালিয়ে গেল। মালা দুটো আমার হাতে ছিল। ফুল নিয়ে আমি হাঁটতে পারি না। রেখার কপাল শূন্যা চাইলেও রেখা মালা হাতে বাড়ি ফিরতে পারবে না আমার পকেটে বিয়ের দলিল রেখার হাতটা ছুঁতে ইচ্ছে করছে। রেখাকে একবার বউ বলে ডাকতে—আহ, কি আশ্চর্য ইচ্ছে! আমরা পাশাপাশি হাঁটছি অথচ নীরবতা। বিয়ের পর একান্তে প্রথম কথা কি হবে, কি হতে পারে? আমি অস্ফুটে বলেছিলাম, গঙ্গায় বসলে হয়। রেখা অস্ফুটে বলেছিল, হুঁ। তারপর আমরা চৌরঙ্গীর বাস ধরেছিলাম আর উঠেই দেখেছিলাম রেখার বাবা! তারপর আমি দোতলায় গিয়ে বসলাম। রেখা একতলায়। তারপর অন্যমনস্কের মতো কিছুক্ষণ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বাসের যাত্রীদের লক্ষ্য করলাম আর বাসের বিজ্ঞাপন। জনৈক বিজ্ঞাপন দেখে যথার্থ মুগ্ধ হয়েছিলাম সুন্দর করে লেখা ছিল —’ডোন্ট কে ইন দি বাস, নট ইভন নাম্বার টেন’ তারপর জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে চৌরঙ্গী দেখতে খুব ভালো লেগেছিল। হঠাৎ কুয়াশা, মেঘ ও স্তিমিত আলোকমালা শোভিত তীরভূমি আর অন্ধকার, আর মাস্তুলের কথা মনে পড়ায় আমার খুব হাসি পেয়েছিল। অকস্মাৎ লক্ষ্য করেছিলাম আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ। তারপর রেখা নেমে গেল। একটিবার ব্যাকুল গ্রীবা তুলে হয়তো সে আমাকে খুঁজেছিল। রেখার জন্যে সেই মুহূর্তে আমার খুব মমতা হয়েছিল। হয়তো আমি একটু বেশি উচ্ছ্বসিত হয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ পৌঁছে গেছি লক্ষ্য করে হুড়মুড় করে নামছিলাম। দরজার কাছে কন্ডাক্টর বলল, টিকিট? অভ্যেসে বললাম, হয়ে গেছে। কন্ডাক্টর। বলল, দেখি? মুখ লাল করে পয়সা দিয়ে নেমে শুনলাম কন্ডাক্টর বলছে, হাতে আবার মালা নিয়ে যাওয়া হচ্ছে! রাস্তায় অসহায় দাঁড়িয়ে আমার কান্না পেয়েছিল। দু-পা হেঁটে মালা জোড়া ছুঁড়ে ফেলে দিয়েই লক্ষ্য করেছিলাম একটা স্থবির বলদ সেটি চিবুচ্ছে। কি একটা ভয়ে দ্রুত হাঁটতে লাগলাম কি একটা ভয় আমাকে তাড়া করলা রেজিস্ট্রারের চেম্বারটা মনে পড়ল–ছোট, ঠাসা। রেস্তোরাঁর কেবিনটা মনে পড়ল—ছোট, ঠাসা। বাসের সিঁড়িটা মনে পড়ল ছোট, ঠাসা। শোবার ঘরটা মনে পড়ল—ছোট, ঠাসা। আমার দম বন্ধ হয়ে এলা। স্পষ্ট দেখলাম রেখার কপালে নীল শিরা। মনে হল আমি চিৎকার করে কেঁদে উঠেছি। চমকে দু-হাতে মুখ চেপে ধরে বুঝলাম, চন্দ্রকোশা পায়ে পায়ে পানের দোকানটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম দিন রেখার সঙ্গে দেখা হতে বলেছিলাম, ‘জানো, আমাদের বিয়েয় স্বয়ং বিসমিল্লা সানাই বাজিয়েছে।’
‘এই কাঞ্চনবাবু?’
কাঞ্চন চমকে তাকিয়ে দেখল সুবিমলা বেহায়ার মতো একবার রেখার দিকে তাকিয়ে সুবিমল বলল, তারপর, কি খবর?’
কাঞ্চন কোন রকমে হেসে বলল, ‘বিকেল পাঁচটার পর থেকে এ পর্যন্ত নতুন কিছু ঘটেনি।’ না, তাই বলছি। একটা সিগারেট হবে? রেখা একটু সরে দাঁড়ালা। কাঞ্চন পকেট থেকে চারমিনার বের করে সুবিমলকে দিল, নিজে ধরাল। সুবিমল রেখার দিকে আর একবার তাকিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলল, আপনার বোন?
‘না’
‘ছাত্রী?’
‘না।’
‘ও, বুঝেছি।‘ সুবিমল মুখটা উজ্জ্বল করে বলল, ‘দেখেও আনন্দ। আপনাদের আর কি ভাবনা মশাই জীবন সামনে পড়ে আছে। এই আমি কলেজ সেরে, টিউশনি সেরে এখন বাড়ি ফিরে শুনব মা-র সঙ্গে ঝগড়া করে বৌদি রান্না চাপায় নি, ইত্যাদি আচ্ছা চলি যা বিষ্টি আসছে!’ দু-পা এগিয়ে সুবিমল আবার থমকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, ‘খবর শুনেছেন? ইউ.জি.সি-র টাকাটা নাকি আরও পেছিয়ে গেল। প্রিন্সিপালও হয়েছে তেমনি।’
‘লোকটি কে, মাস্টারমশাই?’
‘আমাদের কলেজের, ম্যাথমেটিকস।’
‘কি বলল?’
‘এই, তুমি আমার কে হও, ইত্যাদি।’ শেষ শব্দটা উচ্চারণ করেই কাঞ্চন সচেতন হল যে সুবিমল তার আগাগোড়া মধ্যবিত্ত সংলাপের মধ্যে এই একটি শব্দপ্রয়োগে আভিজাত্যের পরিচয় দিয়ে গেছে।
‘জানো, সেদিন আমাদের নমিতা, নমিতাকে মনে নেই তোমার—সেই যে ইসলামিক হিস্ট্রির…’
‘হুঁ, দেখা হয়েছিল?
‘হ্যাঁ তো। কথায় কথায় তোমার খবর জিজ্ঞেস করল। বলল, ‘কবে বিয়ে করছিস?’
‘কি বললে?’
‘বললুম, এই ভালো, বিয়ে করলেই তো সব ফুরিয়ে যায়। তার ওপর ছেলেপিলের ঝঞ্চাট, শাশুড়ী-ননদের ঝামেলা।’
তারপর দুজনেই স্তব্ধ হয়ে খানিক পথ হাঁটল। রাস্তায় ব্যস্ততা বাড়ছিল, কারণ বৃষ্টি আসছে। অথচ পরিপার্শ্ব সম্পর্কে ওরা সম্পূর্ণ উদাসীন ছিল।
‘রেখা।’
‘রেখা?’
‘কি?’
‘রেখা?’
এবার জবাব না দিয়ে রেখা হাসিমুখে কাঞ্চনের দিকে তাকাল। কাঞ্চন বলল, ‘জানো, ছেলেবেলায় মাকে এমনি অকারণে ডেকে জ্বালাতাম।’
রেখার হাসিমুখ মুহূর্তে শুকিয়ে গেল। মা-র নামে ওর বাড়ির কথা মনে পড়েছে। আমারও পড়ে। রেখা সম্পর্কে মা-র একটা চাপা স্নেহ লক্ষ্য করেছি। অনেক আগে রেখাদের বাড়ি গিয়েছিলাম, মাত্র একবার। রেখার মা-র চেহারা মনেই পড়ে না। বাবাকেও না। রেখার ভাই বোনেরা এই চার-পাঁচ বছরে নিশ্চয়ই কত বদলে গেছে।
‘আচ্ছা, আমি যদি চিৎকার করে লোক জানিয়ে বলি, এই যে দেখছেন ভদ্রমহিলা—ইনি আমার ধর্মপত্নী, তাহলে?
‘পাগল বলে ধরে নিয়ে যাবে, এই আর কি।’