যদি হরি স্মরণে সরসং মনো-
যদি বিলাসকলাসু কুতুহলং।
মধুরকোমলকান্তপদাবলী
শৃণু তদা জয়দেব সরস্বতীম্।।
যাঁহারা ভগবৎপ্রসঙ্গ শুনিতে চাহিবেন এবং যাঁহারা পার্থব প্রেমের আস্বাদ প্রত্যাশা করেন, সেই উভয়বিধ পাঠকের তৃপ্তির উপকরণ গীতগোবিন্দে আছে।
চণ্ডীদাস যখন নাম-জপের কথা বলিতেছেন, রাধাকে নীলাম্বরী শাড়ী ছাড়াইয়া গৈরিক বাস পরাইতেছেন, তাঁহাকে দিয়া উপহাস করাইতেছেন (“বিরতি আহারে, রাঙ্গা বাস পরে”), তখন আমরা সত্যই সেই পরমার্থিক ইঙ্গিত বুঝিয়াছি। এই উপলক্ষে কবি আরও স্পষ্ট করিয়া বলিয়াছেন “যেমন যোগিনী পারা।” রাধার ভাব-বিহ্বলতা বাড়িয়া যাইতেছে, তিনি জপ ছাড়িতে পারিতেছেন না, নাম–“বদন ছাড়িতে নাহি পারে”। কোন কোন স্থানে রাধিকা মন্দিরের পুরোহিতের ন্যায় মন্ত্রপাঠ করিতেছেন,–
“অখিলের নাথ, তুমি হে কালিয়া,
যোগীর আরাধ্য ধন,
গোপ-গোয়ালিনী, হাম অতি দীনা
না জানি ভজন পূজন।”
“বঁধু কি আর বলিব আমি আমার জীবনে মরণে
জনমে জনমে প্রাণ-বঁধূ হইও তুমি,
তোমার চরণে, আমার পরাণে
বাঁধিল প্রেমের ফাঁসি
সব সমাপিয়া, এক মন হৈয়া
নিশ্চয় হইলাম দাসী” (চ)
এই গানটি কিছু কিছু পরিবর্ত্তন করিয়া ব্রাহ্মগণ তাঁহাদের ধর্ম্মসঙ্গীতগুলির মধ্যে স্থান দিয়াছেন। [‘বঁধুর’ স্থানে ‘প্রভো’, “জনমে-জনমে”র স্থলে “জীবনে জীবনে”, “ফাঁসি”র স্থলে “ফাঁস”, সুতরাং দাসীর স্থলে ‘দাস’] এই গানটি সম্বন্ধে পরে আরও কিছু লিখিব। এরূপ অনেক পদ আলোচনা করিলে দেখা যাইবে, চণ্ডীদাসের মূল সুর কোথায়? তিনি জগতের ভিতর দিয়া জগদীশ্বরকে দেখিয়াছিলেন,–তিনি কোন মন্দিরে তাঁহার সাক্ষাৎলাভ করিয়া লিখিয়াছেন,–
“ব্রহ্মাণ্ড ব্যাপিয়া আছয়ে যে জন,
কেহ না জানয়ে তারে,
প্রেমের আরতি যে জন জানয়ে,
সেই সে চিনিতে পারে।” (চ)
এই প্রেম-তীর্থের পথিকরে আমাদের এত ভাল লাগে এইজন্য যে, বিষ্ণুশর্ম্মা যেরূপ গল্প শুনাইতে যাইয়া রাজকুমারদিগকে নীতি-শিক্ষা দিয়াছিলেন, চণ্ডীদাসের তেমনই মানুষী প্রেমের কাহিনী দ্বারা লুব্ধ করিয়া তাঁহার দেশবাসীকে সর্ব্ব কথার মধ্যে যাহা সার কথা তাহাই শিখাইয়াছিলেন। ভাল গায়েনের মুখে কীর্ত্তন না শুনিলে বৈষ্ণব কবিগণের পদের অর্থ সম্যক্ বুঝা যাইবে না। যেরূপ গাছ-গাছড়ার উপাদানের সঙ্গে না মিশাইলে ভেষজ সার্থক হয় না, সেইরূপ কীর্ত্তনের আসরে না গেলে মহাজনগণের স্বরূপ আবিষ্কার করা অনেকের পক্ষে দুষ্কর হইবে।
০৮. গৌরদাস কীর্ত্তনীয়া
আমি অনেক ভাল ভাল কীর্ত্তনীয়ার কীর্ত্তন শুনিয়াছি। বর্দ্ধমানের রসিক দাস, কুষ্টিয়ার শিবু, বীরভূমের গণেশ দাস প্রভৃতি প্রসিদ্ধ গায়েনদের কীর্ত্তনে মুগ্ধ হইয়াছি, কিন্তু নদীয়ার গৌরসাদকে যেরূপ দেখিয়াছিলাম, সেরূপ আর কোন কীর্ত্তনীয়াকে দেখি নাই। এক সময়ে আমি ইংরেজী ও সংষ্কৃত নানা কাব্য পাঠে আনন্দ পাইতাম, কিন্তু পান্থ যেরূপ নানা স্থান ঘুরিয়া শেষে বাড়ীর ঘাটে নৌকা বাঁধিয়া সোয়ান্তি পায়, আমি জীবন-সায়াহ্নে সেইরূপ কীর্ত্তনের আনন্দে অন্য সমস্ত মুখ ভুলিয়া গিয়াছি। গৌর দাস কীর্ত্তনীয়ার মধ্যে যে ভক্তি, প্রেম ও কাব্যের বিকাশ দেখিয়াছি, তাহাতে আমার মন একবারে কীর্ত্তনে মজিয়া গিয়াছিল। গৌরদাসের বর্ণ ছিল কালো, দেহ ছিপছিপে, মুখ-চোখে প্রতিভার কোনই ছাপ ছিল না। পথ দিয়া চলিয়া গেলে তাঁহাকে অতি সাধারণ লোক বলিয়া মনে হইত। মৃত্যুর পূর্ব্বে তাহার বয়স হইয়াছিল ৪৮/৪৯। এই লোকটি গানের আসরে নামিলে তাহার রূপ বদলাইয়া যাইত, সে নিজে না কাঁদিয়া শত শত লোককে অশ্রুজলে ভাসাইয়া লইয়া যাইত। সে ছিল সংগীতচার্য্য। তাল মান এ সকল ছিল তাহার আজ্ঞাকারী ভৃত্য, কিন্তু প্রেমের অলৌকিক প্লাবনে মনে হইত, তাহার সঙ্গীত-বিদ্যার কোন নিয়মের দিকে সে দৃকপাত করে না, অথচ সে যেদিকে একটু হাতের ইঙ্গিত করিয়াছে, কি পা বাড়াইয়াছে, সেইদিকেই তাল মান রাজার হুকুমে নফরের ন্যায় ছুটিয়া গিয়াছে। আখরগুলি তাহার হৃদয়োচ্ছ্বাস হইতে শত শত স্বর্ণপদ্মের ন্যায় ফুটিয়া উঠিয়াছে এবং তাহার সাবলীল কণ্ঠের বিলাপময় আলাপের পাছে রাগ-রাগিণী পতি-বিরহিতা স্ত্রীর ন্যায় পাগল হইয়া ছুটিতেছে। আমি এরূপ কীর্ত্তন আর শুনি নাই, তাহার ৪/৫ ঘন্টার কীর্ত্তন এক নিমেষের মত কোথা দিয়া চলিয়া গিয়াছে, তাহা বুঝিতে পারিতাম না। গৌরদাস সত্য সত্যই এই পৃথিবীতে স্বর্গরাজ্য স্থাপন করিবার শক্তি রাখিত। গোষ্ঠ গাহিতে গাহিতে সে প্রারম্ভে কৃষ্ণসখাদের যশোদার আঙ্গিনায় আনিয়া উপস্থিত করিত, সে যখন ‘গগনে হইল বেলা যত শিশু হয়ে মেলা রে-উপনীত নন্দের ভবনে’ কিবা বেণু-বীণা-বাঁশী রব, করয়ে রাখাল সব গাহিত, তখন যেন আকাশ পটে চিত্রিত সুরঞ্জিত প্রভাত দৃশ্যকে সকলের প্রত্যক্ষে উপনীত করিত। ইহার পরে আওত সুদামচন্দ রঙ্গিয়া পাগড়ী মাখে গাহিয়া সর্ব্বপ্রথম সুদামকে উপস্থিত করাইত। সে রূপ বর্ণনা অপূর্ব্ব। সুদামের মাথার পগগ কৃষ্ণপ্রেমের আবেশে বারে বারে খসিয়া পড়িতেছে, পগ লটপটি শিরে, তাহার গলায় মহির হারের সঙ্গে গো-বাধন দড়ি ঝুলিতেছে-স্ফুট চম্পকদল নিন্দিত তাহার বর্ণ। তৎপর অপরাপর সখার বর্ণনা, তাহাদের প্রত্যেকের ভিন্ন ভিন্ন রূপ, ভিন্ন ভিন্ন বেশভূষা- যার মা যেমন সাজায়েছে, কিন্তু তাহারা সকলে এক ডুরিতে বাঁধা, তাহা কৃষ্ণপ্রেমের ডুরি। চিত্রের পুত্তলীয় ন্যায় তাহারা একে একে নন্দের ভবনে উপস্থিত হইয়া দাদা বলাই এর আগমন প্রতীক্ষা করিতেছে। সুবলের সঙ্গে কৃষ্ণের অনেক তর্ক-বিতর্ক হইয়া গিয়াছে। সুবল বলিতেছে, এই বৃন্দাবনে তো সকলেরই মা আছেন, তোমার মা ইহাদের উপরে গেলেন কি করিয়া? আমরা তো মায়ের নিষেধ না মানিয়াই আসিয়াছি। তোমাকে ছাড়া আমরা থাকিতে পারি না-
যখন মায়ের কাছে ঘুমিয়ে থাকি,
তখন স্বপনে কৃষ্ণ কৃষ্ণ বলে ডাকি।
সত্যই ইহারা কৃষ্ণ প্রেমে তন্ময়। কৃষ্ণ বলিলেন, দেখ আমি চুড়া বেঁধে ধড়া পরে বসে রয়েছি- সে তোমাদেরই জন্য- মায়ের আদেশের প্রতীক্ষায়। আমার মা যে আমাকে ছাড়া তিলার্দ্ধও থাকিতে পারেন না- ইহার উপায় কি? যদি আমি না বলিয়া চলিয়া গেলে মা মারা যান, তবে ভাই কি করিব? সত্যি সত্যি বলছি-
একদিন নবনী খেয়েছিলেম লুকাইয়ে।
মরিতেছিলেন মা আমার না দেখিয়ে। (শে)
সুবল ছাড়িবার পাত্র নহে। সখাদের বিশ্বাস তাহারা কৃষ্ণকে যেরূপ ভালবাসে, মা যশোদাও তাহাকে সেরূপ ভালবাসিতে পারেন না। সে বলিতেছে-
“জানি রে তোর মায়ের প্রেম যত ভালবাসে,
সামান্য ননীর লাগি বেঁধেছিল গাছে।”
তোর দুখানি কোমল কর স্পর্শ করিতে আমরা আশঙ্কায় মরি, পাছে আমাদের কঠোর স্পর্শে তাহা ব্যথিত হয়, কোন্ প্রাণে মা যশোদা সেই কোমল হাত দুখানি দড়ি দিয়া বেঁধেছিলেন? সেই দড়ির দাগ এখনও তোর হাতে আছে, একটুখানি ননীর জন্য এত বড় শাস্তি দিলেন, সেই বাঁধার দাগ আমাদের বুকে শেলের মত বিধিয়া আছে। আর এক দিনের কথা-
বমল অর্জ্জুন যে দিন পড়েছিল গায়,
সে দিন তোর মা নন্দরাণী আছিল কোথায়?
তিনি এত বড় দুটো অর্জ্জুন গাছের সঙ্গে তো দড়ি দিয়া শিশুটিকে বাঁধিয়া গেলেন, কিন্তু যখন সে দুটো গাছ তোর ঘাড়ে পড়িল, তখন নন্দরাণী কোথায় ছিলেন- আমরাই তো তোকে আসিয়া বাঁচাইয়াছিলাম।