আমি সর্ব্বদাই বলিয়া আসিয়াছি, বিদ্যাপতি ও গোবিন্দদাসের পদে কাব্য-লক্ষ্মী যেরূপ নিজ কৌটা খুলিয়া নানা জহরৎ ও মণিমুক্তা দেখান, চণ্ডীদাসের কবিতায় কাব্য-লক্ষ্মীকে তেমন করিয়া পাওয়া যাইবে না। এখানে তিনি রহস্যময়ী, ভাবাবিষ্টা,–কাব্যলোকের ঊর্দ্ধে যে ধ্যানলোক, তিনি সেই ধ্যানলোকের দিকেই ইঙ্গিত করেন বেশী। তিনি স্বল্পভাষী; কিন্তু তাহার কথার মূল্য খুব বেশি, মহাজনের কষ্টি-পাথরে তাহা ধরা পড়ে।
কৃষ্ণরূপ-দর্শনের পর রাধা নিজের আনন্দে নিজে মগ্না। তিনি জগৎ হইতে স্বতন্ত্র হইয়া পড়িয়াছেন, তিনি আনমনা, আবিষ্টা; তিনি একেলা বসিয়া থাকেন, সখীগণের সঙ্গও আর ভাল লাগে না। কেহ কিছু বলিলে শুনিয়াও তাহা শোনেন না, স্বীয় আনন্দে বিভোর, ধ্যানমূর্ত্তি। ধ্যানের সার বস্তু কৃষ্ণরূপ তিনি দেখিয়াছেন, চক্ষু চারিদিকে সেই রূপের সন্ধান করে; আবেশে নীলাভ কৃষ্ণমেঘের দিকে চাহিয়া ধ্যানস্থ হইয়া যান–সেই কৃষ্ণবর্ণ-মাধুর্য্যে তাঁহার নিশ্চল চক্ষুর তারা যেন ডুবিয়া যায়। কখনও বা মেঘের কাছে তিনি কাতরোক্তি করিতেছেন; কি বলিতেছেন, কে বলিবে? কিন্তু যক্ষ যেরূপ মেঘকে দূত নিযুক্ত করিয়া প্রেমের বার্ত্তা পাঠাইয়াছিল–ইহা সেরূপ মেঘদূরের কথা নহে; এখানে রাধা কৃষ্ণের–কৃষ্ণ-রূপের–কৃষ্ণবর্ণের নমস্য প্রতীক-স্বরূপ নব মেঘের উদয় দেখিয়া হৃষ্টা হইয়াছেন, তখন যে কথা মুখে আসে, তাহা পৃথিবীর ভাষা নহে–সে ভাষা দেবলোকের ভাষা। কোন মল্লিনাথের (?) সাধ্য নাই যে, সে ভাষার টিকা করে, স্বয়ং চৈতন্য তাঁহার জীবন দিয়া তাহার টীকা করিয়াছেন। রাধা–
“আকুল নয়নে চাহে মেঘপানে
কি কহে দু’হাত তুলে।” (চ)
মেঘের দিকে দু’হাত তুলিয়া তিনি কি যেন কি কথা বলেন!
এ ‘কি জানি কি কথা’ বুঝাইতে চাহিয়া কৃষ্ণকমল দুইটি মর্ম্মস্পর্শী গান রচনা করিয়াছেন, তাঁহার “রাই-উন্মাদিনী” নাটকে তাহা আছে। একটির আরম্ভ এইরূপঃ– (মেঘ-সম্বোধনে)
“ওহে তিলেক দাঁড়াও দাঁড়াও, হে এমন করে যাওয়া উচিত নয়।
যে যার শরণ লয়, নিঠুর বঁধু, তারে কি বধিতে হয়।”
অপরটি–
“কি ভাবিয়া মনে দাঁড়িয়া ওখানে, একবার নিকুঞ্জকাননে কর পদার্পণ।
একবার আসিয়া সমক্ষে দেখিলে স্বচক্ষে,
জান্বে,–কত দুঃখে রক্ষে করেছি জীবন।” (কৃ)
রাধিকার এই ধ্যানাগারের নিস্তব্ধতায় অপর সকলের প্রবেশ নিষেধ এখানে চাঁপা ফুলের মালা খুলিয়া ফেলিয়া তিনি স্বীয় নিবিড় আলুলায়িত কুম্বলের বর্ণশোভা দেখিতেছেন, সেই শোভায় আবিষ্ট হইয়া পড়িয়াছেন–“না চলে নয়নের তারা।” নবোদিত কৃষ্ণমেঘের স্নিগ্ধ বর্ণে কাহার দেহ-প্রভা দেখিয়া মুহুর্মুহু চক্ষু অশ্রুসিক্ত হইতেছে, এবং একদৃষ্টে ময়ূর-ময়ূরীর নীলমণি-খচিত কণ্ঠে কাহার বর্ণাভাসের সন্ধান করিতেছেন? এই অনধিগম্য ধ্যানের কক্ষে চণ্ডীদাস প্রবেশ করিয়া রাধার যে চিত্রটি আঁকিয়াছেন, তাহা এইরূপঃ–
“রাধার কি হৈল অন্তর-ব্যথা,
সে যে বসিয়া একলে থাকয়ে বিরলে
না শুনে কাহার কথা।
এলাইয়া বেণী, ফুলের গাঁথুনি, খসায়ে দেখয়ে চুলে।
আকুল নয়নে, চাহে মেঘপানে, কি কহে দু’হাতে তুলে।।
বিরতি আহারে–রাঙ্গা বাস পরে, যেমন যোগিনী পারা।
সদাই ধেয়ানে চাহে মেঘ পানে, না চলে নয়নের তারা।।
এক দিঠি করি, ময়ূরময়ূরী, কণ্ঠ করে নিরীক্ষণে।
চণ্ডীদাস কয় নব পরিচয়, কালিয়া বঁধুর সনে।”
ইহার পরঃ–
“সদাই চঞ্চল, বসন অঞ্চল সম্বরণ নাহি করে।
বসি থাকি থাকি, উঠয়ে চমকি–ভূষণ খসিয়া পড়ে।” (চ)
কাহার বাঁশীর সুরের আভাষ শুনিয়া, কাহার নূপুর-সিঞ্চিত পদ-স্পর্শের পুলকে, জগতের প্রতি রেণুতে রেণুতে বিন্দিত কাহার কৃষ্ণবর্ণের মাধুরিমা লক্ষ্য করিয়া রাধিকা চমকিত হইয়া উঠিতেছেন! চঞ্চল শাড়ীর অঞ্চল শরীর-মুক্ত হইয়া মাটিতে লুটাইতেছে এবং ভূষণ খসিয়া পড়িতেছে, তিনি তাহা সংবরণ করিতে পারিতেছেন না। এই উন্মাদভাব লক্ষ্য করিয়া চণ্ডীদাস বলিতেছেন, রাধিকাকে “কোথা বা কোন্ দৈব পাইল?” গায়েন এই গান গাহিবার সময়ে ঊর্দ্ধে অঙ্গূলী নির্দ্দেশ করিয়া আখর দিয়া জিজ্ঞাসা করিয়া থাকে, “সে কোন্ দেবতা, রাধিকাকে যিনি এমন করিয়া পাইয়াছেন?” পরবর্ত্তী সময়ে সে দেবতা নদীয়ার সোনার মানুষটিকে এমন করিয়া পাইয়াছিল, এজন্য তাঁহার জীবন-কথার দ্বারা চণ্ডীদাসের কবিতার টীকা হইয়াছে; নতুবা চণ্ডীদাসের কবিতার এই চিত্র, অন্ধের কাছে মহা-মাণিক্যের ন্যায়, সাধারণ নিকট মাটির ডেলার মত হইয়া পড়িয়া থাকিত।
চণ্ডীদাসের রাধা ও চৈতন্যের মূর্ত্তি পাশাপাশি রাখিয়া দেখিবেন একই ছবির দুটি দিক্ মাত্র।
চণ্ডীদাস লিখিয়াছেনঃ–
“ঘরের বাহিরে দণ্ডে শতবার তিল তিল আসে যায়।
মন উচাটন, নিশ্বাস সঘন, কদম্ব-কাননে চায়।।
রাধার এমন কেন বা হৈল।
সদাই চঞ্চল বসন অঞ্চল,–সংবরণ নাহি করে।।
বসি’ থাকি’ থাকি’, উঠয়ে চমকি’, ভূষণ খসিয়া পড়ে।।”
রাধামোহন চৈতন্য-সম্বন্ধে লিখিয়াছেনঃ–
“আজু হাম কি পদনু নবদ্বীপ-চন্দ।
কর-তলে করই বয়ান অবলম্ব।
পুনঃ পুনঃ গতাগতি করু ঘর-পন্থ।
ধেনে ধেনে ফুলবনে চলই একান্ত।
ছল-ছল নয়নে কমল সুবিলাস।
নব নব ভাব করত পরকাশ।”
এক জন “ফুল বনে চলই একান্ত” অপরে কদম্বকাননের দিকে দৃষ্টিপাত করিতেছেন। একজন তিল তিল দণ্ডে দশবার ঘর-বাহির হইতেছেন, অপরে পুনঃ পুনঃ ঘর ও পথে যাতায়াত করিতেছেন না, অপরে করতল দ্বারা বদন অবলম্বন করিয়া আছেন–ইহা একই চিত্রপট।
০৭. অনুবাদ
রাধা ঘর-সংসার আগ্লাইয়া ছিলেন–সুখের সরঞ্জাম সকলই আছে; সংসারে দশজনের মত সংসারী সাজিবেন, গৃহস্থালী করিবেন–নববধূ রাধার মনে কত সাধ! কিন্তু সহসা কাহার নাম শুনিয়া চমকিয়া উঠিলেন–যিনি তাঁহার আপন হইতেও আপন–এ যে তাঁহার স্বর! সংসার যাঁহাকে পর করিয়া রাখিয়াছে, তথাপি যিনি প্রাণের প্রাণ, যুগ-যুগান্তর ধরিয়া রাধা যাঁহাকে চাহিয়াছিলেন, যাঁহাকে পাইবার জন্য কোন জন্মে কুটীরে কোন জন্মে রাজপ্রাসাদে, কোনবার সন্ন্যাসীর আশ্রমে, কোন বার মুছাফেরখানায়–কত বার কর রূপে ঘুরিয়া বেড়াইয়াছেন–কখনও সেওড়া-গাছকে বিল্বতরু-ভ্রমে পূজা করিয়া নিষ্ফল হইয়াছেন, কখনও বা মালতীহার-ভ্রমে সর্পকে গলায় জড়াইয়া দংশনের জ্বালায় ছটফট করিয়াছেন–কখনও গঙ্গা-ভ্রমে কূপোদকে অবগাহন করিয়া বিষাক্ত জীবাণু দেহে লইয়া আসিয়াছেন, যখন যেখানে গিয়াছেন–“তত্রতত্রাচলাসক্তি”–সেইখানেই আসক্তির মোহে কাঞ্চন বলিয়া কাচকে আঁকড়াইয়া ধরিয়াছেন–আজ সেই চির-অভীপ্সিত জীবন-ধন কৃষ্ণের নাম শুনিয়াছেন–তখনই কাণ সেই নাম চিনিল, নাম কাণের ভিতর দিয়া মর্ম্মে প্রবেশ করিল, প্রাণ আপন জনকে জিনিতে পারিল। এইবার ঘোর দ্বন্দ্ব–সংসার সবে সোণার শিকল গড়াইয়া আনিয়াছে–পায়ে পরাইবে–ঘোর আসক্তি জন্মিয়াছে–এই সংসার কেমন করিয়া ছাড়িবেন? অপরদিকে যাঁহার নাম শুনিয়াছেন, তিনি যে জগতের সকল কিছু হইতে আপন। নাম যে দুর্দ্দান্ত দস্যুর মত সকল আসক্তি, সকল কামনা ভাঙ্গিয়া-চুরিয়া আসিয়া পড়িয়াছে; হামাগুড়ি দিতে শিখিয়া দুরন্ত শিশু যেরূপ মায়ের সোণার গহনার বাক্সটি লইয়া টানাটানি করে, তাঁহার বড় সাধের আয়না, চিরুণী, ফিতা টান দিয়া ফেলিয়া দেয়–মা কিছুতেই তাহাকে রোধ করিতে পারেন না–রাধার আজ সেই অবস্থা! মা তাঁহার মূল্যবান্ অলঙ্কারগুলি জোর করিয়া–কাড়াকাড়ি করিয়া শিশুর হস্ত হইতে রক্ষা করিতে চান্, কিন্তু শিশু তাহা ছাড়ে না–নবোদ্গত দুটি দাঁত প্রকাশ করিয়া হাসে–সে হাসির মত অবাধ্য অথচ প্রিয়, অত্যাচারীর জোর এবং বিজয়ীর গর্ব্বের মত সে হাসির দুর্ল্লভ আনন্দ মাতার অপর সমস্তা চিন্তা ভুলাইয়া দেয়, আজ রাধার নাম শুনিয়া সেই অবস্থা হইতেছে। সে নাম শুনিবেন না–সংসারের সকল সুখের বিঘ্নকর কুলভঙ্গকারী নাম আর শুনিবেন না; পদ্মার মত উহা ঘর-বাড়ী ভাঙ্গিতে আসিতেছে; রাধা বিব্রত হইয়া আপনাকে রক্ষা করিতে চেষ্টা করিতেছেন,–