“ঢেউ দিও না জলে বলে কিশোরী।
দরশনে দাগা দিলে হবে পাতকী।।” (গো, ক)
কলসী জলে ডুবাইলে জলে আঁকা কৃষ্ণের ছায়া ঢেউ-এ ভাঙ্গিয়া যাইবে, এজন্য রাধা নিষেধ করিতেছেন; যিনি যোগীর যোগানন্দ, প্রেমিকের প্রেম-সিদ্ধি, যুগ-যুগ তপস্যার ফলে মুহূর্ত্তের জন্য তাঁহাকে পাইয়াছিলেন–এই আনন্দে বাঁধা দিলে পাপ হইবে, রাধা মৃদুস্বরে মিনতি করিয়া তাহাই বলিতেছিলেন।
তাহার পরের কথা চণ্ডীদাসের পদেই পাওয়া যাইবে।
০৬. আনন্দ
রাধা তাঁহার মনের অবস্থা কাহাকে বলিবেন? কেউ বা তাহা বিশ্বাস করিবে? কেন অহেতুক দিন-রাত্র অঙ্গ শিহরিত হয়–আনন্দ হৃদয়ে উথলিয়া উঠে, চক্ষুকে সামাল দিব কিরূপে? আনন্দ-ঘন অশ্রু কি করিয়া বোধ করিব? যাহা ভাবি, তাহাতেই হর্ষোজ্জ্বল চক্ষে অশ্রু বহিয়া যায়। লজ্জায় গুরুজনের কাছে দাঁড়াইতে পারি না–
“গুরুজন আগে দাঁড়াইতে নারি।
সদা ছল-ছল আঁখি।” (চ)
যেদিকে তাকাই, সেইদিকেই তাঁহার প্রকাশ–পুলকে চিত্ত ভরিয়া যায়ঃ
“পুলকে আকুল, দিক্ নেহারিতে, সব শ্যামময় দেখি।” (চ)
কিন্তু একটা সময় আছে, যখন আর আর আমাতে থাকিতে পারি না। সন্ধ্যায় যখন–
“রবি যায় নি পাটে,”
অস্তচূড়াবলম্বী সূর্য্য যখন পশ্চিম আকাশে স্বর্ণাক্ষরে কি লিখিয়া যান, কলসীকক্ষে সখীরা যমুনাতীরে যায়, তখন রাধার যে অবস্থা হয়, তাহা অবর্ণনীয়।
“সখীর সহিতে জলেরে যাইতে
সে কথা কহিবার নয়।” (চ)
যমুনায় সখীদের সঙ্গে যাইবার পথে রাধার মন কেমন করে, তাহা বলিবার নহে। রাধিকা অত্যধিক মনের উচ্ছ্বাসে সে কথা বলিতে পারিতেছেন না, তাহা বলিতে যাইয়া ভাবাবেগে কণ্ঠরোধ হয়, কেবল মাত্র দুটি কথায় মনের সেই অব্যক্ত অনির্ব্বচনীয় কথা আভাসে বুঝাইতেছেন–
“সে কথা কহিবার নয়।”
চৈতন্যদেব গয়া হইতে ভাগবত পাদ-পদ্ম দর্শন করিয়া নদীয়ায় ফিরিয়া আসিয়া প্রিয় গধাধরের কাঁধে হেলাইয়া কি দেখিয়াছেন, বলিতে পারেন নাই, বলিতে যাইয়া মূর্চ্ছিত হইয়া পড়িয়াছেন। রাধা এখনো যাহা বলিতেছেন, তাহা নিবিড় ও অস্পষ্ট,–
“সখীর সহিতে জলেরে যাইতে সে কথা কহিবার নয়।
যমুনার জল করে ঝল্মল তাহে কি পরাণ রয়।।” (চ)
এইখানেই শেষ, যমুনার জল ঝল্মল্ করে, তাহাতে প্রাণে এত ব্যথা কেন? এ ব্যথা, আনন্দের ব্যথা–আনন্দের আতিশয্যে বাক্রোধ যমুনার জলে সূর্য্যাস্তের রক্তিম আভা পড়িয়া ঝল্মল্ করিয়া উঠে, রাধা কি তাহাই বলিতেছেন? সন্ধ্যানিলে স্বর্ণচূড় যমুনাতরঙ্গ উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠে, রাধিকা কি সেই কথা বলিতেছেন? যমুনার জলে সখীদের নীল শাড়ীর আভা মিশিয়া যে ঔজ্জ্বল্য খেলিতে থাকে, রাধা কি সেই কথা বলিতেছেন? রাধা তো কিছু খুলিয়া বলেন নাই; তবে কি সে ভাব, যাহাতে তাঁর প্রাণ এমন আকুল হয়?
তরুশাখে স্থিত ময়ুরপুচ্ছালঙ্কৃত কৃষ্ণের প্রতিবিম্ব পড়াতে যমুনার জল ঝল্মল্ করিয়া উঠে, তাহাই তিনি দেখিতে যাইতেছেন; যমুনার পথে সেই কথা মনে হওয়াতে রাধার আনন্দে বাক্রোধ হইতেছে। সেই অবর্ণনীয় সুখের কথা–যমুনার নীল জলে প্রতিবিম্বিত কৃষ্ণরূপের কথা–বলিতে যাইয়া ভাবের উদ্বেলের আতিশয্যে তিনি আর কিছু বলিতে পারেন নাই, শুধু বলিতেছেন,
“যমুনার জল, করে ঝল্মল্, তাহে কি পরাণ রয়?”
এইভাবে অর্দ্ধ-প্রকাশ–অর্দ্ধ-অপ্রকাশ কণ্ঠের ভাষায় চণ্ডীদাস তাঁহার রাধাকে চিত্রিত করিয়াছেন, এই স্তব্ধ চিত্র দেখিলে মনে হয় যেন কুবের তাঁহার ভাণ্ডার আগলাইয়া দাঁড়াইয়াছেন–তাহার বাহ্য প্রকাশ নাই। কৃষ্ণপ্রেমের এই “অনভিব্যক্ত রত্বোৎপত্তিরিবার্ণবঃ” ছবির তুলনা নাই। পরবর্ত্তী কবিরা এই কথার ব্যাখ্যা করিয়া বলিয়াছেনঃ–
“ঢেউ দিও না জলে বলে কিশোরী।
দরশনে দাগা দিলে হবে পাতকী।।”
চণ্ডীদাস কথা বলিয়ে বলিতে থমকিয়া যায়; বলিবার থাকে অনেক, কিন্তু বলেন অল্প। পাঠকের মনে ইঙ্গিতমাত্রে একটা তোলপাড় জাগাইয়া, তিনি অল্প কথায় শেষ করেন। তিনি কৃষ্ণ-রূপ মনে মনে ধায় করিয়া আবিষ্ট হইয়া পড়েন, তখন অন্য কোন ব্যাখ্যা না দিয়া আপন মনে নিজের শেষ সঙ্কল্পের কথা বলিয়া ফেলেন–
“কুলের ধরম নারিনু রাখিতে, কহিনু তোমার আগে।
চণ্ডীদাস কহে শ্যাম-সুনাগর সদাই হিয়ায় জাগে।।”
রাধিকা বলেন নাই, কিন্তু চণ্ডীদাস তাহা বলিয়া দিয়াছেন।
সমস্ত পদটি এইঃ–
কাহারে কহিব মনেরই মরম, কেবা যাবে পরতীত।
(আমার) হিয়ার মাঝারে মরম-বেদন সদাই শিহরে চিত।।
গুরুজন আগে দাঁড়াইতে নারি, সদা ছল-ছল আঁখি।
পুলকে আকুল, দিক্ নেহারিতে সব শ্যামময় দেখি।।
সখীর সহিতে জলেরে যাইতে সে কথা কহিবার নয়।
যমুনার জল করে ঝল্মল্ তাহে কি পরাণ রয়।।
(আমি) কুলের ধরম নারিনু রাখিতে কহিলাম তোমার আগে।
কহে চণ্ডীদাস শ্যাম সুনাগর সদাই হিয়ায় জাগে।।”
এই গীতটি বাহ্য দৃশ্যে কতকটা অসম্পূর্ণ মনে হইবে, কিন্তু ইহা নিগূঢ় অর্থব্যঞ্জক।
রাধিকা বলিতেছেন, তাঁহার মনের অবস্থা কেহ বিশ্বাস করিবে না; কিন্তু কি বিশ্বাস করিবে না, তাহা বলেন নাই। গুরুজনের কাছে দাঁড়াইতে চোখে জল পড়ে বলিয়াছেন; কিন্তু কেন জল পড়ে, তাহা বলেন নাই। সখীর সঙ্গে জলে যাইবার সময়ে যে অবর্ণনীয় ভাব হয়, তাহা বলেন নাই। সখীর সঙ্গে জলে যাইবার সময়ে যে অবর্ণনীয় ভাব হয়, তাহা “সে কথা কহিবার নয়” বলিয়াচি ছাড়িয়া দিয়াছেন, এবং যমুনার জল ঝল্মল্ করিয়া উঠে, তাহাতে প্রাণ থাকে না কেন, তাহা তো মোটেই বলেন নাই; আভাষ যাহা দিয়াছেন, তাহাও অস্পষ্ট; কূলধর্ম্ম যে কেন রাখিতে পারেন না, তাহাও বলেন নাই। মোট কথা, এই কবিতাটিতে অনেক ফাঁক আছে, যাহা পাঠক নিজের মর্ম্ম দিয়া পূরণ করিবেন। যাঁহার সে মর্ম্মের আবেগ নাই, তিনি বুঝিতে পারিবেন না। সেক্ষপীয়র লিখিয়াছেন, কবি ও পাগল এক সম্প্রদায়-ভুক্ত। পাগলের কথায় কথায় কতকগুলি শব্দ উচ্ছ্বাস আছে, কিন্তু সমস্তটার কোন অর্থ হয় না (“Mere sound and fury, signifying nothing”); বড় কবির কথাও মাঝে মাঝে অসম্বন্ধ বলিয়া ঠেকিবে, কিন্তু ভাবুক তাহার ফাঁকে ফাঁকে গূঢ় অর্থ পাইবেন, কাঠুরিয়া যেরূপ কোন খনির কাছে আসিয়া হঠাৎ মাণিক কুড়াইয়া পায়।