অষ্ট সাত্ত্বিক বিকার সম্বন্ধে চৈতন্যের বহু পূর্ব্ব হইতে এইদেশীয় লোকেরা অবহিত ছিলেন। কাহারও যদি কৃষ্ণ-নাম বলিতে রোমাঞ্চ হয়, কিম্বা কেহ যদি নির্জ্জনে তমাল তরুকে আলিঙ্গন করে। বিজনে আলিঙ্গই তরুণ তমাল। তবে সে সকলই চৈতন্য প্রভাবান্বিত, সুতরাং পূর্ব্ববর্ত্তী কবির পদে ঐরূপ কিছু পাওয়া গেলে তাহা প্রক্ষিপ্ত ইহা বলা সঙ্গত হইবে না।
চণ্ডীদাস প্রেম সম্বন্ধে কয়েকটি সার কথা বলিয়াছেন–তাহা অন্যত্র সুলভ নয়;
‘‘পীরিতি করিয়ে ভাঙ্গরে যে
সাধন সঙ্গ পায়না সে।’’
পরস্পরের প্রতি গভীর অন্যায় প্রমাণিত হইলে দাম্পত্য বর্জ্জননীতি সমর্থিত হয়। হিন্দুদিগের মধ্যে যদিও স্বামী স্ত্রীকে বর্জ্জন করিতে পারেন কিন্তু স্ত্রী স্বামীকে বর্জ্জন করিতে পারেন না। এই তালাকের ব্যবস্থা যে অন্যায় তাহা চণ্ডীদাস বলেন নাই। একজনকে বর্জ্জন করিয়া নূতন একজনকে গ্রহণ করিয়া অনেক স্থলে লোকে সুখী হইয়া থাকে। চণ্ডীদাস তাহাও অস্বীকার করেন নাই। কিন্তু তিনি বলিয়াছেন, প্রেম সাধনার পথে বর্জ্জননীতি একবারেই অচল। বর্জ্জন করিয়া অন্যকে গ্রহণপূর্ব্বক কেহ সুখী হইতে পারেন, কিন্তু তিনি যদি প্রেমের সাধনা করিতে চান–তবে তাঁহার সঙ্কল্প বিফল হইবে। বর্জ্জনের আইন সাংসারিকের পক্ষে, কিন্তু প্রেমের ক্ষেত্রে সিদ্ধিলাভ করিতে হইলে সমস্ত দুঃখ-কষ্ট মাথায় লইয়া সেই পথে দৃঢ় থাকিতে হইবে। চন্দ্রের জ্যোৎস্না কন্টকের পথ দেখিয়া ফিরিয়া যায় না, সেই কন্টকের ’পরেই লুটাইয়া পড়ে; ফুলের গন্ধ বিষাক্ত স্থান দেখিয়া ফিরিয়া যায় না, তাহার প্রবাহ অব্যাহত থাকে। দানেই প্রেমের তৃপ্তি, সে দান একেবারে নির্ব্বিচার! সেখানে প্রেম পণ্যদ্রব্য নহে, দেওয়ার মধ্যে ফিরিয়া পাইবার কোন সত্ত্ব নাই, সে কেবলই দেওয়া। যাহাকে একবার ভালবাসিয়াছ–সে যেমনই হউক, তাহাকে চিরকাল ভালবাসিতে হইবে। হয়ত সংসারে এ রকম নিষ্কাম প্রেমে অনেক সময়ে দুঃখ পাইতে হয়, কিন্তু যিনি প্রেমের সাধন অঙ্গ খোঁজেন, প্রেম তো তাঁহার কাছে তপস্যা। সে তপস্যা ভাঙ্গিলে তাঁহার আর সাধনার পথে যাওয়া চলে না।
‘‘চণ্ডিদাস কহে পীরিতি না কহে কথা
পীরিতি লাগিয়া পরাণ ত্যজিলে পীরিতি মেলয়ে তথা।
প্রেম ঘোষণা বা বক্তৃতা নহে। জগতের সমস্ত কষ্ট নীরবে সহ্য করিয়া প্রেমের জন্য যে প্রাণত্যাগ করিতে পারে- সে ই প্রকৃত প্রেমিক।
‘‘ব্রহ্মাণ্ডব্যাপিয়া আছয়ে যে জন
কেহ না জানয়ে তারে,
প্রেমের আরতি জেনেছে যে জন
সেই সে চিনিতে পারে।’’ (চ)
চণ্ডীদাসের মতে সুখ-দুঃখ, আশা নিরাশার মধ্য দিয়া যে পার্থিব প্রেমের মর্ম্ম বুঝিয়াছে, সেই মাত্র ভগবৎ প্রেম বুঝিবার অধিকারী–অন্য পথে তাঁহাকে পাওয়া যায় না।
‘‘শুষ্ক কাষ্ঠসম দেহকে করিতে হয়।’’ (চ)
দৈহিক ইন্দ্রিয়ের বিকার যতদিন থাকিবে, ততদিন প্রেমের আস্বাদ দুর্লভ। বহিরিন্দ্রিয়ের তথাকথিত রস শুকাইয়া গেলে, যখন দেহে সুখ-দুঃখ বোধ থাকিবে না, তখন প্রকৃত প্রেমের সন্ধান মিলিবে; তখন নিজের দেহের সুখ-দুঃখ বোধ থাকিবে না;–প্রিয়জনের সুখেই সুখ, তাহার দুঃখেই দুঃখ। কবি অন্যত্র বলিয়াছেন–
‘‘আমি নিজ সুখ দুখ কিছু না জানি’’
সাধারণ প্রেমে করাঙ্গুলি গুণিয়া গুণিয়া যদি বা কিছু দেওয়া হয়–তাহার বিনিময়ে প্রণয়ী কতটা পাইলেন সেই দিকে তাঁহার সতর্ক দৃষ্টি থাকে, এক পাই কম হইলে অমনি প্রেমের পালা শেষ করিয়া ফেলেন। এবম্বিধ প্রণয়ীর পক্ষে দুঃখ সুখ বোধবিবর্জ্জিত ‘শুষ্ক কাষ্ঠসম দেহ’ সাধকের–প্রেমতত্ত্ব বোঝা একেবারে অসম্ভব।
‘‘শুনহ মানুষ ভাই
সবার উপরে মানুষ সত্য
তাহার উপরে নাই।” (চ)
এই পদটি সাধারণ পাঠকেরা অনেক সময়েই উদ্ধৃত করেন, কিন্তু আমার মনে হয়, তাঁহারা অনেক সময়েই সহজিয়া বৈষ্ণবেরা ইহার যে অর্থ বুঝেন তৎসম্বন্ধে অজ্ঞ। মানুষ অর্থ এইখানে যে-সে নয়। সহজিয়ারা মানুষ অর্থে এইখানে গুরুকে বোঝেন। তাঁহারা কোন দেবদেবী মানেন না। গুরুর বাক্যই তাঁহাদের কাছে বেদ। ইহা বৌদ্ধ ধর্ম্মের সহজ-বাদের একটি সুত্র। নেপালে হিন্দুদিগকে দেভাজু ও বৌদ্ধদিগকে গুভাজু বলে। দেভাজু অর্থ দেবতার ভজনকারী এবং গুভাজুর অর্থ গুরুর ভজনকারী।
‘‘চণ্ডিদাস কহে সুখ দুখ দুটি ভাই,
সুখের লাগিয়া যে করিবে আশ
দুঃখ যাবে তার ঠাঁই।’’ (চ)
খাঁটি প্রেম সুখ-দুঃখের উর্দ্ধের আনন্দলোক। সাংসারিক সুখ-দুঃখ দুটি যমজ ভ্রাতা। যেখানে সুখ আছে সেইখানেই দুঃখ। এই পদাবলীর মধ্যে উচ্চাঙ্গের সাধনা আছে, তাহা আমি বলিবার অধিকারী নহি; তাহা শুনিবার অধিকারও সাধারণ শ্রোতার নাই।
সহজিয়া বৈষ্ণবসমাজে অনেক ব্যভিচার হইয়া থাকে, কিছু দু’-একজন এরূপ দুশ্চর তপস্যশীল সাধক আছেন–যাঁহার সংবাদ এদেশ ছাড়া এন্যত্র কোথাও পৌঁছায় নাই। যিনি মন্দ জিনিষটাই দেখিবেন তাঁহার কোনও লাভই হইবে না; ভগবানের শ্রেষ্ঠদান এই দুটি চক্ষু তাহা যেন খনির মধ্যে মণির সন্ধান করে; শুধু লোহা খুঁজিয়া কোনও লাভ নাই।
এই পদাবলী-সাহিত্যের স্ফুরণ হইয়াছে মহাপ্রভুর লীলায়। পৃথিবী এই যুগে রণদুন্দুভিনিনাদে বধির হইয়া আছে। কোন্ যুগে এই দিব্যসঙ্গীত জগতের প্রতি কোণে ধ্বনিত হইয়া স্বর্গরাজ্যের প্রতিষ্ঠা করিবে–তাহা জানি না। পৃথিবীর অন্য কোথাও শুধু এক মানব দেবতার রূপ ও গুণের আস্বাদ করিবার জন্য এরূপ বিশাল রসসাহিত–এরূপ অক্ষয় মধুচক্র রচিত হয় নাই। বৈষ্ণবকবিগনের প্রত্যেকের মধ্যেই ন্যূনাধিক পরিমাণে চৈতন্যের নামের ছাপ আছে। তন্মধে শ্রীখণ্ডবাসী নরহরি সরকারের প্রতিটি পদেই গৌরাঙ্গের শীলমোহরাঙ্কিত বাসুদেব ঘোষও চৈতন্যকথা ছাড়া কোনও কবিতা লেখেন নাই এবং কৃষ্ণকমল গোস্বামীর দিব্যোন্মাদ (রাই উন্মাদিনী) চৈতন্যচরিতামৃতের অঙ্কিত গৌরের ভাবাবিষ্ট মূর্ত্তি একেবারে জীবন্ত করিয়া তুলিয়াছে সহস্র সহস্র লোক সেইসব গান শুনিয়া অশ্রুজলে ভাসিয়া গিয়াছে।