কিন্তু বিদ্যাপতির সব খানিই শুধু কবিত্ব বা অলঙ্কার-শাস্ত্রের পুনরাবৃত্তি নহে। চণ্ডীদাসের সঙ্গে তাঁহার দেখা হইয়াছিল, পদ-কল্পতরুর অনেক পদে তাঁহাদের কথোপকথনের সারাংশ সঙ্কলিত হইয়াছে। এই সাক্ষাৎকারের ফলে প্রেম যে অখণ্ড জিনিষ, সর্ব্ববর্ণের সংমিশ্রনের পরিণতি যেরূপ শ্বেত বর্ণ,–বাৎসল্য, সখ্য, ভগবদ্ভক্তি প্রভৃতি সমস্ত রসই একস্থানে যাইয়া মিশিয়া যায়–তখন ইহাদের মধ্যে কোন ভেদ থাকে না, এই সকল কথা চণ্ডীদাস বিদ্যাপতিকে সম্ভবতঃ বলিয়াছিলেন। পদ-কল্পতরুতে বর্ণিত আছে, চণ্ডীদাস মৈথিল কবিকে জিজ্ঞাসা করিয়া ছিলেন, যৌন-লালসা হইতেই শুদ্ধ প্রেম হয়, কিম্বা প্রেমেরই স্বাভাবিক ক্রমে যৌনভাব শেষে আসিয়া পড়ে। (বিদ্যাপতির প্রথম অধ্যায়গুলি সমস্তই অলঙ্কার শাস্ত্রের অনুযায়ী, কিন্তু মাথুর ও ভাব সম্মেলনে তিনি ভাবরাজ্যে বাঙালী বৈষ্ণব কবিদের মুল সুর ধরিয়াছেন, ইহাতে বোধ হয়, এই পরিবর্ত্তন চণ্ডীদাসের সঙ্গে তাঁহার দেখাশুনার ফলে ঘটিয়াছিল।) বিদ্যাপতি ‘মাথুর’ বর্ণনায় সেই রসের পরিপূর্ণ আস্বাদ আমাদিগকে দিয়াছেন। আমরা দেখাইয়াছি—“সোহি কোকিল অব লাথ ডাকউ”–পদটি তিনি চণ্ডীদাস হইতে গ্রহণ করিয়া পল্লবিত করিয়াছেন। তাঁহার ছিল অপ্রতিদ্বন্দী কবির ভাষা, সেই ভাষায় যখন তিনি মাথুর বর্ণনা করিলেন, তখন তাঁহার পদাবলীতে সমস্ত ভোগের চিহ্ন মুছিয়া গিয়াছে; তখন তিনি পবিত্র তিলক-কন্ঠী-ধারী বৈষ্ণবগুরু—“শ্রবণে হি শ্যাম করু গান, শুনইতে নিকলাউ কঠিন পরান”, তখন “শঙ্খ-করহুঁ দূর, ভূষণ করহুঁ চুড়, তোঁড়হি গজ-মতি হায় রে। শিখাঁক সিন্দুর, মুছিয়া করহ দূর, পিয়া বিনা সকলই আঁধার রে”–ইহাই তাঁহার ভাষা। তখন তাঁহার ভাব-সম্মেলনের “সখি আজি সুখের নাহিক ওর, চিরদিন মাধব মন্দিরে মোর” প্রভৃতি গান বৈষ্ণবদের জপমন্ত্র হইল, চৈতন্যদেব সারারাত্রি গাম্ভীরায় স্বরূপের সঙ্গে এই সকল গান গাইয়া প্রেমের অপূর্ব্ব আস্বাদ পাইতেন।
চণ্ডীদাস একটি পদে বলিয়াছন, কৃষ্ণরূপের ধাঁধায় পড়িয়া আমার দেহ-মন একেবারে আত্ম-বিস্মৃত হয়, তখন চক্ষুর দৃষ্টি বর্ণ-বৈষম্য ভূলিয়া যায়, তিনি কৃষ্ণবর্ণ অথবা গৌর-বর্ণ, তাহা আমি বুঝিতে পারি না। (“দেখিতে দেখিতে না চিনিয়ে কাল কিম্বা গোরা”)। কেহ কেহ এই পদটিতে গৌর আগমনের সূচনা বুঝিয়াছেন, এবং কেহ কেহ আবার ত্যজন্য উহা প্রক্ষিপ্ত মনে করিয়াছেন, কিন্তু কথাটা এরূপভাবে লিখিত হইয়াছে যে, তাহাতে স্পষ্ট ইঙ্গিত কিছুই নাই। কথাগুলি প্রক্ষিপ্ত হইলে, প্রক্ষেপকারী এরূপ অস্পষ্ট ইঙ্গিত দিতেন না, স্পষ্ট করিয়া বলিয়া ফেলিতেন। বহু পুরাণে বৈষ্ণবেরা চৈতন্য-আগমনের ভবিষ্যৎবাণীসূচক শ্লোক প্রক্ষেপ করিয়াছেন, তাহার সকলগুলিই স্পষ্ট সরল কথা, তাহাতে ব্যর্থ কিছু নাই। কিন্তু চণ্ডীদাসের আর একটি পদে ইঙ্গিতটা স্পষ্টতর—“আজু কে গো মুরলী বাজায়–এতো কভু নহে শ্যাম-রায়–ইহার গৌর বরণে করে আলো”–এখানে গৌরাঙ্গের কথা কিছুই নাই; রাধা মুরলী শিক্ষা উপলক্ষে কৃষ্ণের বেশ-ভূষা চাহিয়া নিজে পরিয়াছেন “তুমি লহ মোর নীল শাড়ী তব পীত ধটা দেহ পরি” (বৃন্দা), চণ্ডীদাস এই রূপের কথাই বলিয়াছেন, সুতরাং কথাটা সহজেই বোঝা গেল। কিন্তু এই সুদীর্ঘ পদটির শেষ দুই পংক্তি গূঢ় অর্থ-ব্যঞ্জক—“চণ্ডীদাস মনে মনে হাসে, এরূপ হইবে কোন দেশে?” এই গৌর মূর্ত্তির আর্বিভাব কোন্ দেশে হইবে, তাহা জিজ্ঞাসা করিয়া কবি মুখ টিপিয়া হাসিতেছেন, অর্থাৎ গৌরাঙ্গ যে আসিতেছেন, তাহার আভাস তিনি মনে মনে পাইয়া হৃষ্ট হইয়াছেন। এবার সমালোচকদের কেহ কেহ জোর গলায় বলিতেছেন, এই পদ প্রক্ষিপ্ত না হইয়া যায় না। কিন্তু ইংরাজীতে একটা কথা আছে, “Coming events cast their shadows before”, ভল্টেয়ার ও রসো যে-সকল কথা বলিয়াছিলেন, কিছু পরে নেপোলিয়ান সেইসকল কথার মূর্ত্তরূপে আবির্ভূত হইয়াছিলেন। কবি ও দ্রষ্টাদের মনে ভবিষ্যাৎ ঘটনার এইরূপ প্রতিবিম্ব পড়িয়া থাকে, তাহা ছাড়া সেই দুইটি পংক্তি যে নিশ্চিতরূপে গৌরাঙ্গ-আবির্ভাবের সূচক–তাহাই বা কিরূপে বলা যায়? রাধিকার বেশভূষা দেখিয়া কবি বলিতেছেন, এ আবার কেমন বেশ, এরূপ কোন দেশে পাইলে? তিনি হাসিয়া এই কথা জিজ্ঞাসা করিতেছেন। এই ভাবের ইঙ্গিত পদটির পূর্ব্ব একটি ছত্রেও পাওয়া যাইতেছে–এ না বেশ কোন দেশে ছিল? অতিরিক্ত মাত্রায় বিজ্ঞানবিৎ পণ্ডিতগণের অনুমানগুলিকে আমরা অনুমান বলিয়াই গ্রহণ করিব, সেগুলি সিদ্ধান্ত নহে। রাধাকৃষ্ণ লীলাপ্রসঙ্গে চণ্ডীদাস এত কথা লিখিয়াছেন যে, শুধু এই দুটি পদে নহে, অনেক স্থলে টানিয়া বুনিয়া অর্থ করিলে তাহা চৈতন্য আবির্ভাবের আভাস বলিয়া ধরা যাইতে পারে–তাঁহার সেই সেই পদে চৈতন্যের পাদক্ষেপের নূপুরধ্বনি শোনা যায়, কেবল অনুমান ও খামখেয়ালীর বলে এইসমস্ত পদ প্রক্ষিপ্ত বলিয়া আমরা স্বীকার করিতে প্রস্তুত নহি। চণ্ডীদাসের আর একটি পদ এইঃ–
‘‘অকখন বেরাধি এ কথা নাহি যায়,
যে করে কানুর নাম তার ধরে পায়।
পায়ে ধরি কাঁদে সে চিকুর গড়ি যায়,
সোণার পুতলী যেন ধুলায় লুটায়।”
চৈতন্য দেব যাঁহার মুখে কৃষ্ণ-নাম শুনিয়াছেন, তাঁহারই পায়ে লুটাইয়া পড়িয়াছেন; তাই বলিয়া এই ধ্রুব-প্রহ্লাদ-নারদ-মাধবেন্দ্র পুরীর দেশে যে কৃষ্ণ নামের এই মাহাত্ম্য সমন্তই চৈতন্যে আরোপ করিয়া কবির উক্তি প্রক্ষিপ্ত বলিতে হইবে–বৈজ্ঞানিকের এই বাড়াবাড়ি তো অসহ্য!