‘‘আজি না গৌরাঙ্গচাঁদের কি ভাব হইল,
ধবলী শ্যমলী বলি ডাকিতে লাগিল।
বেণু বিনা বাঁশী করিয়া সিঙ্গাধ্বনি,
হৈ হৈ রবেতে গোরা ঘোরায় পাঁচনি।’’
এইখানে অদ্ভূত ব্যাপার এই, গোরা কেন ধবলী, শ্যামলী, প্রভৃতি নাম ধরিয়া গাভীগুলিকে ডাকিতে যাইবেন? তিনিও ব্রজের রাখাল নহেন। তিনি কেন পাচন বাড়ি ঘুরাইয়তে যাইবেন নন্দের ধেনুপাল চরাইবার জন্য তিনি ত নিযুক্ত নহেন! গায়েন ছোট ছোট গানের মধ্য দিয়া এই প্রশ্নের সমাধান করেন। কলির জীব বহির্ম্মূখ, তাহারা ইন্দ্রিয়াধীন পশু। তিনি আসিয়াছিলেন হরিনাম দিয়া মানুষের পশুপ্রকৃতি ফিরাইতে। তাঁহার মুখের অবিরল হরি হরি ধ্বনি, বেণুবর, এবং তিনি যে হাতখানি উচ্চদিকে হেলাইয়া মানুষের প্রকৃত গম্যস্থান নির্দ্দেশ করিতেন–তাহাই পাচন-বাড়ির সঙ্কেত। একটু কষ্ট কল্পনা করিয়া নদীয়ার তরুণ ব্রাহ্মণটিকে ব্রজের রাখালে পরিণত করিতে হয় বটে, তথাপি অবিরত হরি হরি রবে–গায়েনের ভক্তিগদগদ কণ্ঠের ধ্বনিতে করতাল, মন্দিরা ও মৃদঙ্গের শব্দে এবং গৌরহরির নাম পুনঃ পুনঃ কীর্ত্তন দ্বারা আসরের বিশুদ্ধি সাধিত হয় এবং কৃষ্ণের গোচারণ-পর্ব্বের আধ্যাত্মিকতা উপলব্ধি করিবার জন্য শ্রোতৃবর্গের মনে তৎকালোচিত একটা ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়। কিন্তু মাথুর সম্ভোগমিলন ও রূপাভিসার প্রভৃতি পালায় চৈতন্য ভাবের সঙ্গে রাধা ভাবের এতটা স্বাভাবিক ঐক্য আছে যে, সেই সেই পালা গৌরচন্দ্রিকার সহিত একবারে মিলাইয়া যায়। গৌর-চন্দ্রিকায় “গৌর কেন এমন হৈল? স্বরূপ দে’খে যা রে–গৌর বুঝি প্রাণে মৈল!” এবং মাথুরের “রাই কেন এমন হৈল? ও বিশাখা, তোরা দেখে যা, রাই বুঝি প্রাণে মৈল” উভয়ের একবারে পার্থক্যহীন মিলনের ছন্দ রেখায় রেখায় মিল পড়িয়া যায়। সেখানে আর ওস্তাদ গায়নের উভয়কে মিলাইবার জন্য কোন রিপুকর্ম্ম করিতে হয় না।
১৮. বিদ্যাপতি এবং চণ্ডীদাস
বিদ্যাপতির প্রথম জীবনের প্রেরণা আসিয়াছিল জয়দেবের গীত-গোবিন্দ হইতে। বাক্যের পারিপাট্যে, ছন্দের ঝঙ্কারে এবং অলঙ্কার শাস্ত্রানুগত নায়ক-নায়িকার চিত্রাঙ্কণে রাজকবি বিদ্যাপতি দরবারী সাজেই দেখা দিয়াছেন। শিবসিংহ, লছিমাদেবী ও মিথিলার বড় বড় পণ্ডিতগণ তাঁহার শ্রোতা। কোন স্থানে শব্দের অপপ্রয়োগ ছন্দ ও কাব্যশ্রীর চ্যূতি বিচ্যূতি হইলে তিনি রেহাই পাইতেন না। বিদ্যাপতি স্বয়ং সুপন্ডিত ছিলেন এবং সংস্কৃতে অনেক কাব্য প্রণয়ন করিয়াছিলেন; রাজসভা পূজিত পণ্ডিত বংশে তাঁহার জন্ম। (তিনি স্থান কাল ও পাত্রের উপযোগীভাবে রাধাকৃষ্ণের লীলা গাহিয়া ‘নবজয়দেব’ উপাধি লাভ করিয়াছিলেন। কিন্তু চণ্ডীদাস নিজকে একজন পূজারী ব্রাহ্মণ (বাশুলী-পূজক) বলিয়া পরিচয় দিয়াছেন। কেহ তাঁহাকে কোনও উপাধি দেন নাই। বড়ু, দ্বিজ প্রভৃতি শব্দ ব্যবহার করিয়া তিনি যে ব্রাহ্মণ বংশে জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন–এইটুকু মাত্র জানাইয়াছেন। তাঁহার ভ্রাতা নকুলের কথা অনুসারে তাঁহাকে মহাপণ্ডিত বলিয়া মনিয়া লইলেও তিনি যে একেবারেই পাণ্ডিত্যভিমানী ছিলেন না–ইহা নিশ্চয় বলা যাইতে পারে। প্রথম বয়সের করিতায় কিছুকাল জয়দেবের লেখা মক্স করিলেও, অনতি পরেই সেই অনুকরণের প্রবৃত্তি ছাড়িয়া দিয়াছিলেন। তাঁহার হৃদয়ে স্বয়ং ভারতী দেবী পদ্মাসন পাতিয়া বসিয়াছিলেন এবং মুখে কবিতার ভাষা জোগাইয়াছিলেন। কাব্য-জগতে এই সিদ্ধি লাভ করিবার পর, সমস্ত কাব্যসংস্কার এবং কবি প্রসিদ্ধির এলাকা অতিক্রম করিয়া গিয়াছিলেন।
বিদ্যাপতি-রচিত পূর্ব্বরাগের বর্ণিত রাধা অলঙ্কার-শাস্ত্রের নায়িকা, বাহ্যরূপে ঢলমল। রাধা-নাম ও রাধা-ভাবের সঙ্গে আমাদের মনে যে পবিত্র লীলা মনে পড়ে এবং মানসী-পূজার জন্য যে নৈবেদ্য সাজাইয়া থাকি, বিদ্যাপতির পূর্ব্ব-চিত্রণে তাহার লেশমাত্র নাই। সহচরীরাও তাঁহার কর্ণান্ত-অবলম্বি কেশপাশ আঁচড়াইয়া বেণী বাঁধিয়া দিতেছেন, রাধিকা অতি গোপনে তাঁহাদের কাণে কাণে প্রেমলীলা সম্বন্ধে শিষ্ট-অশিষ্ট নানারূপ প্রশ্ন করিতেছেন; কখনও নবযৌবনাগমে তাঁহার দেহ সৌন্দর্য্য স্ফুরণের আভাস মুকুরে প্রতিবিম্বিত দেখিয়া মৃদু মৃদু হাসিতেছেন। যেখানে কোনও প্রণয়ঘটিত কথাবার্ত্তা হয়, সেইখানে তিনি আনতমুখী হইয়া বাহ্যে উদাসীনতা দেখাইলেও, চৌর্য্যবৃত্তিপূর্ব্বক অতি আগ্রহে সে সকল কথা শুনিতে থাকেন (“আনতমুখে ততহি দেহি কাণে”); এইভাব যদি ধরা পড়ে এবং কোন সখী তাহা প্রচার করিয়া দেয়, তবে একবারে রৌদ্রবৃষ্টি, (‘কান্দন মাখি হাসি দেয় গারি’) রাধা তখন মুখে হাসি এবং চোখে কান্না লইয়া সখীকে গালি দিতে থাকেন। কবি বলিতেছেন—‘মনমত পাঠ পহিল অনুবন্ধ’–কামদেবের শাস্ত্রে নূতন পাঠ লইতেছেন। মোট কথা রাধিকার পূর্ব্বরাগের ছবিগুলি সংস্কৃত অলঙ্কার শাস্ত্রের এক একখানি পটবিশেষ। অভিসার ও স্নানের পর রাধিকার যে সকল চিত্র বিদ্যাপতি দেখাইয়াছেন, তাহা দেহনুখলোলুপ তরুণ-মনের উপাদেয় খোরাক। সেগুলি খুব সুনিপুণ কবির হাতের যোগ্য–কাব্যজগতে তাহা নিরূপম। কিন্তু তাহার উপমা ও উৎপ্রেক্ষা চোখে ধাঁধাঁ লাগাইলেও, সে চিত্র মেঘদূতের যক্ষীও নহে, কালিদাসের শকুন্তলাও নহে। ঐ দুই কবি কাব্যের উত্তরার্দ্ধে ভোগনিবৃত্তিজনিত প্রেমের নির্দ্দোষ পরিসমাপ্তি দেখাইয়াছেন। বিদ্যাপতির ভোগের চিত্র চিরকালই ভোগীকে লুব্ধ করিবে, কিন্তু চণ্ডীদাস হইতে কৃষ্ণকমল পর্য্যন্ত বৈষ্ণব কবিদের যে-সকল চিত্র আমরা দেখিয়াছি, তাহার অনেক পদই সংকীর্ত্তন-ভূমির রজঃ মাখা, তাহা মানব-হৃদয়ের চিরন্তন কারুণ্য ও সখাসঙ্গচ্যূত ব্যাথায় ভরপুর, তাহাতে সময়ে সময়ে ভোগের একটা বাহু রূপ আছে, কিন্তু তাহার মূল সুর–ভগবৎ প্রেম। কবিরা নারদ ও তুমুবরুর মত আমাদিগকে কৃষ্ণ কথাই শুনাইয়াছেন, এই প্রেমে দেহের তাপ বা উষ্ণত্ব নাই—জ্বর-বিকারগ্রন্থ আত্মার অতৃপ্ত পিপাসা নাই। উহা উর্ব্বশীর নৃত্য নহে–বেহুলার নৃত্য; উগ্র চাঁপা ফুলের গন্ধ নহে, বাহ্য শুভ্রতাভিমানী বিষাক্ত দূন্তর পুষ্প নহে, উহা স্নিগ্ধ সুরভিপূর্ণ সজল নলিনীদল। চণ্ডীদাসের পূর্ব্বরাগের চিত্রে রাধা প্রথম হইতেই নাম-জপের অধিকারিণী, তিনি মন্দিরের পূজারিণী–কুণ্ডলধারিণী, গেরুয়া পরিহিয়া দুশ্চর্য্য তপস্যশীলা আত্মহারা যোগিনী। তাঁহাকে বিশ্বের চতুর্দ্দিক হইতে কৃষ্ণবর্ণের আবেষ্টনী ভগবৎরূপের ধাঁধাঁ দেখাইতেছে। এই কৃষ্ণ-বর্ণের খেলা তিনি যেখানে দেখিতেছেন, সেইখানেই ভগবৎ সত্ত্বা উপলব্ধি করিয়া প্রণাম করিতেছেন। এই ধ্যানশীলা, কেশ-পাশ বেশ-ভূষার প্রতি উদাসীনা, ক্ষণে ক্ষণে প্রিয়ের আগমনের ভ্রান্তিতে চমৎকৃতা রাধিকাকে দেখিয়া সখীরা বলিতেছেন, ইঁহাকে কোথায় কোন দেবতা আশ্রয় করিয়াছে? (“কোথা বা কোন্ দেব পাইল”)। সত্যই তাঁহাকে কোনো দেবতা পাইয়াছেন, মানুষ আর তাঁহার নাগাল পাইবে না। তিনি সখিগণের সঙ্গে ক্ষণকাল দাঁড়াইয়া কথা বলিতে পারেন না–
‘‘দাঁড়াই যদি সখিগণ সঙ্গে,
পুলকে ভরর তনু শ্যাম পর-সঙ্গে (প্রসঙ্গে)
পুলক ঢাকিতে নানা করি পরকার (প্রকার),
নয়নের ধারা মোর বহে অনিবার।”
এই রাধার সুখ-দুঃখ মর্ত্ত্যের সুখ-দুঃখ নহে, তাহা অমর-ধামের সুখ-দুঃখ।