প্রেম এখানে শুধু কবিত্বের উৎস নহে, উহা দিনরাত্রের অপস্যা।
কৃষ্ণের মথুরা যাওয়ার ফলে রাধা ও সখিগণ মূর্চ্ছাপর। রাধার জীবন-সংশয়–এই কথা শুনিয়া চন্দ্রাবলী রাধার কুঞ্জে আসিলেন, আজ আর হিংসা নাই, ঈর্ষা নাই, ‘সম দুখের দুখিনী’ সকলে। আজ প্রতিদ্বন্দ্বিতার দিন ফুরাইয়াছে। চন্দ্রা এতদিন ঈর্ষায় রাধার মুখ দেখেন নাই, আজ রাধার রূপ দেখিয়া আশ্চর্য্যান্বিত হইয়া গেলেন, কিন্তু রাধার এই রূপ বাহিরের রূপ নহে–যে রূপে তিনি কৃষ্ণকে এতটা মুগ্ধ করিয়াছিলেন যে চন্দ্রাবলীর পার্শ্বে থাকিয়াও তিনি ‘রাধা’ বলিয়া কাঁদিয়া উঠিতেন–ইহা সেই রূপ। যেখানে যেখানে রাধা তাঁহার কৃষ্ণপ্রেমের লীলা দেখাইয়াছেন, সেই সেই খানে চন্দ্রা তাঁহার রূপ আবিষ্কার করিয়াছেন, অন্যত্র নহে–
‘‘সে ধনী আছিল শ্যামেব হিয়ার হার–
বঁধূর হিয়ার হার আছ ধূলায় পড়ি গো–
মরি মরি হরি-বিরহে আজ কি দশা তাঁহার’’
এখানে কৃষ্ণ তাঁহাকে নিজের গলার হারের ন্যায় মূল্যবান মনে করিতেন, এইজন্যই চন্দ্রাবলীর কাছে রাধার রূপের মূল্য ও তাঁহার জন্য এত আক্ষেপ।
‘‘হায় গো অতুল রাতুল কিবা চরণ দুখানি,
আলতা পরাত বঁধু, কতই বাখানি।
এ কোমল চরণে যখন চলিত হাটিয়া গো–
বঁধুর অনুরাগে গো,
হেন বাঞ্ছা হ’ত যে পাতিরে দেই হিয়ে।’’
আলতা পরাইবার সময় কৃষ্ণ সেই পদযুগ্মের রূপের কতই না ব্যাখ্যা করিতেন, এইজন্য সেই “অতুল রাতুল চরণ দুখানি” চন্দ্রার কাছে এত সুন্দর এবং যখন এই দুইটি চরণ-কমলে পথে হাটিয়া শ্যাম দর্শনের জন্য রাধা যাইতেন, তখন চন্দ্রা সেই পথে বুক পাতিয়া রাখিবার ইচ্ছা প্রকাশ করিতেন–যেন রাধার পায়ে পথের কাঁকর বা কাঁটা না বাজে।
চন্দ্রাবলী এই রাধার নিরুপম রূপ আবিষ্কার করিয়াছিলেন, তাহা বাহিরের রূপ নহে, সে রূপ কৃষ্ণ প্রেমের মধ্যে। এই রূপের গৌরব করিয়াই রাধা বলিয়াছিলেন—“আমি রূপসী তোমার রূপে” এবং চন্দ্রা বলিয়া ছিলেন—“মরি, যে রাধার রূপ বাঞ্ছে শ্রীপাব্বর্তী, যাঁহার সৌভাগ্যশ্রী বাঞ্ছে অরুদ্ধতী”! চন্দ্রা রাধার রূপ দেখিতেছিলেন না, তিনি কৃষ্ণের প্রেমই দেখিতেছিলেন।
১৬. গৌর-চন্দ্রিকা
এই পদাবলী পড়িয়া পাছে কেহ ইহাতে সাধারণ নায়ক-নায়িকার ভাব আরোপ করিয়া বৈষ্ণবের স্বর্গকে বাস্তবের মাটীতে পরিণত করেন, এই আশঙ্কায় কীর্ত্তনের আসরে গৌর-চন্দ্রিকার সৃষ্টি। গৌরচন্দ্রিকা দিকদর্শনী স্বরূপ, বিশাল পদ-সমুদ্রে নাবিককে ঠিক্-পথ দেখাইয়া লইয়া যায়—দিক্ভ্রান্ত হইতে দেয় না। একঘণ্টা বাল মুলগায়েন ও দোহারগণ খোল পিটিয়া ও মন্দিরা-করতাল বাজাইয়া–শ্রোতারা আসরে কি প্রত্যাশা করেন–তাহারই একটা মুখবন্ধ প্রস্তুত করেন।
পূর্ব্বরাগের পালা আরম্ব করিবার আগে গৌরবিষয়ক এরূপ কোন গান উচ্চকণ্ঠে গাহিতে থাকেন–
‘‘আজ হাম কি পেশিলু নবদ্বীপচন্দ্র,
‘‘আজ হাম কি পেশিলু নবদ্বীপচন্দ্র,
করতলে করই বদন অবলম্ব।
পুনঃ পুনঃ গতায়ত করু ঘরপন্থ,
ক্ষণে ক্ষণে ফুলবনে চলই একান্ত।
ছল ছল নয়নে কমল সুবিলাস,
নব নব ভাব করত বিকাশ।
পুলক মুকুল বর ভরু সব দেহ,
এ রাধামোহন কছু ন পায়ল খেহ।”
চিত্রকর যেরূপ তুলির রং ঘষিয়া ঘষিয়া রূপরেখায় একটী স্থায়ী বর্ণ তৈয়ারী করেন, সেইরূপ পুনঃ পুনঃ এই গানটি গাহিতে গাহিতে শ্রোতার মনে ভাবমুগ্ধ গৌরাঙ্গের মূর্ত্তি স্থায়ীরূপে পরিকল্পিত হয়। গোরা আজ বড়চঞ্চল চিত্ত, একবার ঘরে একবার বাহিরে যাতায়াত করিতেছেন, তারপরে কি ভাবিয়া পুনরায় ফুলবনের দিকে একান্তে চলিয়া যাইতেছেন। তাঁহার সজল চক্ষুদুটিতে পদ্মের মত দুষ্টি নূতন নূতন ভাবে খেলিয়া যাইতেছে। ক্ষণে ক্ষণে মনে আনন্দ উছিলিয়া উঠিতেছে এবং সর্ব্বশরীর রোমাঞ্চিত হইতেছে। এই ভাব কি–তাহা পদকর্ত্তা রাধামোহন ঠিক্ করিতে পারিতেছেন না। এই চিত্র নব অনুরাগের ইহার ভাবে শ্রোতাদিগকে মুগ্ধ করিয়া গায়েন মূলপালা অবতারণা করিবেন।
১৭. অথ শ্রীরাধার পূর্ব্বরাগ (চণ্ডীদাসের পদ)
‘‘ঘরের বাহিরে দণ্ডে শতবার, তিল তিল আসে-যায়,
মন উচাটন নিশাস-সঘন কদম্বকাননে চায়।
রাই এমন কেন বা হ’ল। সদাই চঞ্চল বসন-অঞ্চল সম্বরণ নাহি করে।
বসি থাকি থাকি উঠই চমকি ভূষণ খসিয়া পড়ে।’’
সুতরাং দেখা যাইতেছে চণ্ডীদাসের কবিতায় রাধিকার যে অবস্থা বর্ণিত হইয়াছে, গৌর-চন্দ্রিকায় গৌরাঙ্গের সেই ভাবই সূচিত হইয়াছে। গৌরাঙ্গ করতলে বদন স্থাপনপূর্ব্বক মৌনাবলম্বন করিয়াছেন, রাধিকাও চণ্ডীদাসের পদে ‘বসিয়া বিয়লে থাকয়ে একলে না শোনে কাহারো কথা’। গৌরাঙ্গ ‘পুনঃ পুনঃ যাতায়াত করু ঘরপস্থ’ রাধিকাও ঘরের বাহিরের দণ্ডে শতবার ‘তিল তিল আসে যায়’। গৌরাঙ্গ ক্ষণে ক্ষণে ‘চলই পূলবসন্ত কান্ত’ এবং রাধিকাও ‘মন উচাটন নিশাস-যঘন কদম্বকাননে চায়।’ ইহা একই চিত্রের এপিঠ ওপিঠ। গৌর-চন্দ্রিকার দ্বারা আসরের আবহাওয়া একেবারে নির্ম্মল হইয়া যায়, তারপর রাধকৃষ্ণ লীলার অধ্যাত্মিক অর্থ ও ভাব পরিগ্রহ করিতে শ্রোতার কোনরূপই অসুবিধা হয় না। এই জন্যেই গৌরচন্দ্রিকা না গাহিয়া গায়েন কখনই রাধাকৃষ্ণ লীলা আরম্ব করেন না–পাছে লোকে লালসার কথা দিয়া এই লীলার ভাষ্য প্রস্তুত করে। মান, মাখুর, খণ্ডিতা, গোষ্ঠ প্রভৃতি প্রত্যেক পালা গাহিবার পূর্ব্বে গৌর চন্দ্রিকাটি এইরূপ–