পূর্ব্বোক্ত পদটি নিম্নে দেওয়া যাইতেছে-
“কহিও কানুরে সই, কহিও কানুরে,
পিয়া যেন একবার আইসে ব্রজপুরে।
নিকুঞ্জে রহিল এই হিয়ার হেম-ছায়,
পিয়া নে গলায় পরয়ে একবার।
রোপিনু মল্লিকা, নিজ করে,
গাঁথিয়া ফুলের মালা পরাইও তারে।
তরু-ডালে রইল মোর সাধের শারী-শুকে,
মোর কথা পিয়া যেন শোনে তাদের মুখে।
এই বনে রহিলি তোরা যতেক সজনী,
আমার দুখের দুখী জীবন-সঙ্গিনী।
শ্রীদাম, সুদাম আদি যত তার সখা,
তা সবার সাখে তাঁর হবে পুনঃ দেখা।
দুখিনী আছয়ে তার মাতা যশোমতী
উঠিতে বসিতে তার নাহিক শকতি।
পিয়া যেন তারে আসি দের দরশন,
কহিও কানুর পায় এই নিবেদন।
শুনিয়া ব্যাকুল দুতী চলে মধুপুরে,
কি কহিবে শেখর বচন নাহি স্ফুরে।”
আর একটি পদে আছে–
‘‘যাহা পহ অরুণ চরণে চলি যাত।
তাহা তাহা ধরণী হইয়ে মধু রাত।
যো সরোঘরে পহুঁ নিতি নিতি গাহ,
হাম ভরি সলিল হইয়ে তছু নাহ।
যো দরপণে পহুঁ নিজ মুখ চাহ,
হাম অঙ্গ জ্যোতি হইএ তছু মাহ।
যে বীজনে পহ বীজই গাত,
মঝু অঙ্গ তাহে হইএ মৃদু বাত।
যাঁহা পহুঁ ভরমহি জলধর শ্যাম।
মঝু অঙ্গ গগন হইএ তছু ঠাম।“ (গো)
কানুর সঙ্গে মিলিত হইবার আশা মরণান্তেও তিনি ছাড়েন নাই। মরণের পরেও এই দেহ দিয়াই তাঁহার সেবা করিবেন–ইহাই তাঁহার কামনা। তাঁহার অরুণ পদ যে পথে হাটিয়া যাইবে, আমার অঙ্গ যেন সেই পথের মাটী হইয়া থাকে। সে সরোবরে তিনি নিতি নিতি স্নান করেন, আমি যেন তাহার সলিল হইয়া তদঙ্গ স্পর্শ লাভ করি। যে ব্যজনী তাঁহার অঙ্গে বাতাস দেয়, আমি যেন সেই ব্যজনী-সঞ্চালিত মৃদু বায়ু হইয়া তাহার সেবা করি। যে-মুকুরে তিনি তাঁহার মুখ দেখেন, আমি যেন সেই মুকুরের দীপ্তি হইয়া থাকি। যেখানে যেখানে তাঁহার মূর্ত্তি শ্যামল মেঘের মত উদিত হইবে, আমার অঙ্গ যেন সেখানে সেখানে সেই মেঘাবলম্বী আকাশে পরিণত হয়।
অর্থাৎ আমার দেহের পঞ্চ উপাদান–ক্ষিত্যপতেজমরুদ্ব্যোমে–যেন মৃত্যুর পরেও সেবকের মত তাঁহাকে ভজনা করে।
এই বৈষ্ণব গানটির অনুকরণে পরবর্ত্তী কালে শাক্ত কবি দাশ নতি একটি গান রচনা করিয়াছিলেন, দুই এর কতকটা এক ভাব, এক সুর।
‘‘দূর্গে কর এ দীনের উপায়,
যেন পায়ে স্থান পায়।
আমার এ দেহ পঞ্চত্ব কালে, তব প্রিয় পঞ্চ স্থলে
আমার পঞ্চভূত যেন মিশায়।
শ্রীমন্দিরে অন্তর-আকাশ যেন মিশায়, এ মৃত্তিকা যায় যেন তব মৃত্তিকায়,
না মোর পবন তব চামর ব্যজনে যেন ধায়,
হোমাগ্নিতে মম অগ্নি যেন মিশায়।
আমার জল যেন যায় পদ্মজলে, যেন তবে যায় বিমলে,
দাশরথীর জীবন-মরণ দায়।”
এই গানটিতে বৈষ্ণব আত্ম সমর্পণের ভাব থাকিলেও, অত্যন্ত দুঃখ, নিবৃত্তি বা মুক্তির ভাব কিছু আছে। বৈষ্ণবেরা আনন্দময়ের খেলার খেঁড়ু হইয়া থাকিতে চান, তাঁহারা সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হইতে চান না। কিন্তু দাশরথী জীবন মরণ–এই দুই হইতেই মুক্তি চাহিতেছেন। বৈষ্ণব যে আনন্দময় পুরুষবরের আনন্দের স্বাদ পাইয়াছেন, সেই পুরুষের সঙ্গ তিনি চিরন্তন কালের জন্য কামনা করেন। শাক্ত কিন্তু –‘যথা জলের বিম্ব জলে বিলয়’ সেই ভাবে আপনাকে ফুরাইয়া ফেলিয়া নিষ্কৃতি প্রার্থনা করেন–এই প্রভেদ।
গোবিন্দ দাসের আর একটি পদে সেই সুন্দর পুরুষবরের যে রূপ-বর্ণনা আছে, উহার প্রত্যেকটি অক্ষর হইতে কবিত্বের জ্যোতিঃ ফুটিতেছে। যে পদ দিয়া তিনি যান, তাঁহার চরণস্পর্শে সেইস্থলে স্থলপদ্ম ফুটিয়া উঠে। (যাঁহা যাঁহা অরুণ চরণ চলই, তাঁহা তাঁহা খল কমল খলই)। যেখানে তাঁহার ভ্রভঙ্গিতে চঞ্চল কটাক্ষ খেলিয়া যায়,–“তাঁহা তাঁহা উছলই কালিন্দহিল্লোল”। যেখানে তিনি প্রসন্ন দৃষ্টিতে চান–সেখানে যেন নীলোৎপল ফুটিয়া ওঠে। যেখানে তাঁহার মধুর হাস্য বিকশিকত হয় তাঁহা –“তাঁহা কুন্দকুমুদপরকাশ”।
বৈষ্ণব কবির মত ভগবানের অপূর্ব্ব রূপ আর কাহার চক্ষে এরূপ ভাবে ধরা পড়িয়াছে! আমরা রাধার পাদ-পদ্মের কথা একবার উল্লেখ করিয়াছি, এই বিষয়ের কবিতাগুলি ভক্তি ও প্রেমে ভরপুর।
বংশীবদন লিখিয়াছেন—“না যাইও না যাইনা রাই বৈস তরুমূলে, অসিতে পেয়েছ ব্যথা চরণ-কমলে” সেই চরণ-কমলে একটা কুশাঙ্কুর ফুটিলে তাহা কৃষ্ণের প্রাণে শেলের মত বিঁধে।
‘‘সিনান দুপুর সময়ে জানি
তপত পথেতে ঢালে সে পানি’’
দ্বিপ্রহরে যমুনার সিকতাময় পুলিন রোদে তাতিয়া উঠে, রাধা কি করিয়া সেই উত্তপ্ত বালুকার পথে হাটিয়া স্নান করিতে আসিবেন। এজন্য কৃষ্ণ পূর্ব্ব হইতেই কলসী কলসী জল ঢালিয়া সেই পথ শীতল করিয়া রাখেন। রাধার প্রসাদী তাম্বুল পাইবার আশায় তিনি পথে হাত পাতিয়া থাকেন,
‘‘লাজে হাম যদি মন্দিরে যাই,
পদচিহ্ন তলে লুটে কানাই।
প্রতি পদচিহ্ন চুম্বয়ে কান,
তা দেখি আকুল ব্যাকুল পরাণ।’’
এই পথে কৃষ্ণের অশিষ্টতা দেখিয়া যদি রাধা লজ্জা পাইয়া গৃহে প্রবেশ করেন, তবে কৃষ্ণ সেই পদ-চিহ্নের উপর লুটাইয়া পড়েন এবং প্রতিটি পদ চিহ্ন চুম্বন করেন। ইহা দেখিয়া আমার প্রাণ আকুলি ব্যাকুলি করিতে থাকে।
‘‘সো যদি সিনাই আগিলা ঘাটে, পিছলি ঘাটে সে নায়।
মোর অঙ্গের জল পরশ লাগিয়া যাহ পসারিয়া রয়,
বসনে বসন লাগিবে লাগিয়া, একই রজক দেয়,
আমার নামের একটি আখর পাইলে হরিষে লেয়।
ছায়ায় ছায়ায় লাগিবে লাগিয়া ফিরই কতই পাকে,
আমার অঙ্গের বাতাস যে-দিকে সে-দিন সে-মুখে থাকে।
মনের কাকুতি বেকত করিতে কত না সন্ধান জানে,
পায়ের সেবক রায়-শেখর কিছু কহে অনুমানে।’’
সম্মুখের ঘাটে রাধা স্নান করিলে, অপর দিকের ঘাটে কৃষ্ণের স্নান, করিয়া দুই হাত বাড়াইয়া রাধার স্পর্শ করা জলের জন্য প্রতীক্ষা করা, তাঁহার ছায়ার সঙ্গে নিজের ছায়া মিলাইবার জন্য ঘোরা-ফেরা, তাঁহার অঙ্গের স্পর্শে যে-কাপড়খানি পবিত্র হইয়া আছে, সেই বস্ত্রের সঙ্গে নিজের পরিধেয়ের একটু ছোঁয়াছুয়ি হওয়ার অপূর্ব্ব সুখের জন্য অক্ষর পাইলে দুর্ল্লভ সামগ্রীর ন্যায় সেটিকে গ্রহণ করা, যে-দিন রাধার অঙ্গস্পৃষ্ট হাওয়া যে দিকে বহিয়া যায়, সে দিন সেই বাতাসের স্পর্শ সুখের জন্য সারাদিন সেই দিকে থাকা, ইত্যাদি প্রচেষ্টা পূর্ব্বরাগের প্রমত্ত অবস্থা সূচক, রায়শেখর বলিতেছেন–দেখা সাক্ষাৎ নাই, কথা-বার্ত্তার সুযোগ নাই, তথাপি কত প্রকারে যে কৃষ্ণ তাঁহার মনের আগ্রহ ব্যক্ত করেন, কবি তাহার কয়েকটি মাত্র অবস্থার কথা বলিলেন।