মাঝে মাঝে এই সকল আমোদ-প্রমোদের কথা আমদারী করিয়া লেখকেরা কৃষ্ণ-প্রেমের মধ্যে গূঢ় নাট্যরসের অবতারণা করিয়াছেন।
ইহা ছাড়া নানা কাব্য-কথায় অলঙ্কৃত হইয়া এই সাহিত্য চিত্তাকর্ষক হইয়াছে। বিদ্যাপতির “নয়ন যে জনু খির তৃঙ্গ আকার, মধু মাতল কিয়ে উড়ই না পার” (রাধার চক্ষু স্থির ভ্রমরের ন্যায়, যেন মধুভাণ্ডে পড়িয়া ভ্রমরটি আটকাইয়া গিয়াছে–উড়িতে পারিতেছে না)–ভাবাবিষ্ট চক্ষুর কি সুন্দর বর্ণনা। এই কবির “চঞ্চল লোচনে বঙ্ক নেহারণী, অঞ্জন শোভন তায়; জনু ইন্দীবরে পবন ঠেলল অলি-ভরে উলটায়” (কজ্জ্বলযুক্ত চক্ষুর অপাঙ্গ দৃষ্টি–চক্ষের তারা এক কোণে সরিয়া পড়েছে। যেমন ভ্রমর-পদ-পীড়িত নীলোৎপলকে পবনে ঠেলিয়া ফেলিতেছে)। চণ্ডীদাসের—“চলে নীল শাড়ী, নিঙাড়ি নিঙাড়ি–পরাণ সহিত মোর”, রায় শেখরের—“তুঙ্গমণি-মন্দিরে বিজলী ঘন সঞ্চরে, মেঘরুচি বসন পরিধানা” প্রভৃতি শত শত পদে অপূর্ব্ব কবিত্ব ফুটিয়াছে। আবার কোন কোন পদে কবিত্বের সঙ্গে অধ্যাত্ম-মহিমা প্রকাশ পাইয়াছে, যেন বনের ফুল দেবতার নৈবেদ্যে স্থান পাইয়াছে। জ্ঞানদাসের-
“রূপ লাগি আখি ঝুরে, গুণে মন ভোর,
প্রতি অঙ্গ লাগ্নি কাঁদে প্রতি অঙ্গ মোর,
হিয়ার পরশ লাগি হিয়া মোর কাঁদে,
পরাণ পীরিত লাগি স্থির নাহি বাঁধে।”
কে যেন জোড় ভাঙ্গিয়া বেজোড় করিয়া দিয়াছে, গল্পকথিত গ্রীক দেবতার ন্যায় কে যেন অখণ্ডকে দ্বিখণ্ডিত করিয়া ফেলিয়াছে, সেই দুই খণ্ড পরস্পরের সঙ্গে জোড়া লাগিবার জন্য বিরহে হাহাকার করিতেছে। জীব যাঁহার অংশ–তাঁহার বিরহে মন ব্যাথাতুর হইয়া আছে। যেরূপ সারাদিন সূর্য্যের মত রশ্মী পৃথিবীতে আসিয়া ছুটাছুটি করে, কিন্তু সন্ধ্যায় সূর্য্যের সঙ্গে মিলিত না হইয়া পৃথিবীর মাটিতে পড়িয়া থাকে না–সেই রূপজীব তাঁহাকে ছাড়া যতক্ষণ থাকে, ততক্ষণ দশ ইন্দ্রিয় দিয়া হাতড়াইয়া তাহাকে খুঁজিয়া বেড়ায়। শেষে “পরাণ পীরিতি লাগি স্থির নাহি বাঁধে”–তাঁহার প্রেম ছাড়া প্রাণ অস্থির হইয়া উঠে। এইরূপ আর একটি গান আছে, তাহা লোচন দাসের। কঙ্কিমচন্দ্র কমলাকান্তের দপ্তরে তাহার একটা ব্যাখ্যা দিয়াছেন, উহা তাঁহার মত মনস্বী ও সাহিত্য-রস-বোদ্ধার যোগ্য, কিন্তু তাহা ঠিক বৈষ্ণবের মত নহে–
‘‘এস এস বঁধু এস, আখ আঁচরে ব’স,
আজি নয়ন ভরিয়া তোমা দেখি।
আমার অনেক দিবসে, মনের মানসে
তোমা ধেনে মিলাইল বিধি।
মণি নও মাণিক নও যে হার করি গলায় পরি,
ফুল নও যে কেশের করি বেশ।
আমায় নারী না করিত বিধি তোমা হেন গুণনিধি
লইয়া ফিরিতাম দেশ দেশ।
তোমায় যখন পড়ে মনে, আমি চাই বৃন্দাবন পানে,
এলাইলে কেশ নাহি বাঁধি।
রন্ধন-শালাতে যাই, তুয়া বঁধু গুণ গাই,
ধোঁয়ার ছলনা করি কাঁদি।
রামানন্দ রায়ের সুবিখ্যাত পদ “সো নহ রমন, হাম নহ রমনী”টির যে লক্ষ্য–এই গানটি তাঁহারই বিবৃতি। নারী ও পুরুষের যৌন-সম্পর্ক ছাপাইয়া উঠিয়াছে, এই গীতিটি তাহার কামগন্ধহীন প্রেম-গৌরবে। এই যৌন-ভাবই আমার সঙ্গে তোমার মিলনের বাধা। তুমি পুরুষ, আমি নারী,–খুব কাছাকাছি-রূপে মিশিতে পারি না। যদি তাহা না হইয়া তুমি ফুল হইতে, তবে তোমায় মাথায় পরিতাম, মণি-মাণিক্য হইলে গলায় হার করিয়া পরিতাম–লোকনিন্দা আমাগিদকে ছুইতে পারিত না। অন্ততঃ আমি রমণী না হইয়া যদি পুরুষ হইতাম, তবে একদণ্ডও তোমাকে সঙ্গছাড়া করিতাম না, “লইয়া ফিরিতাম দেশ দেশ” কেহ নিন্দা করিতে পারিত না।
এই প্রেমে যৌনভাব আদৌ নাই–কেবল সঙ্গ-সুখের কামনা, বরং বাহিরের স্ত্রী-পুরুষ-রূপভেদ মিলনের বিঘ্ন ঘটাইতেছে! ইহারা এই দেশের লোক–যেখানে স্ত্রী নাই, পুরুষ নাই, আছে শুধু বিশুদ্ধ, লালসা-লেশহীন প্রেম এবং চিরমিলনের আক্ঙ্কা; দেহটা একটা বাধা মাত্র।
ইহাই চৈতন্যের অচিন্ত্য ভেদাভেদ। কতকদিন পর্য্যন্ত তিনি পুরুষ আমি নারী–তাঁহার সঙ্গে ভেদ জ্ঞান; কিন্তু পরে সম্পূর্ণ মিলনেচ্ছু প্রাণ নিজের সত্ত্বা লোপ করিয়া তাঁহার সঙ্গে মিশিয়া যাইতে চায়, –তখন “অনুখন মাধব মাধব সোঙরিতে সুন্দরী ভেল মাধাই” (বি-প) কিম্বা মধুরিপুরহং ইতি ভবেন—লীলা (জ)। এই গানটিতে সেই অভেদ অবস্থার প্রাক্-সূচনা। “আমার নারী না করিত বিধি” কথায় বুঝা যাইতেছে, নারী তাহার নারীত্বের সমস্ত দাবী ছাড়িয়া দিয়া পুরুষকে চাহিতেছেন! এই কবিতা ভোগের কবিতা নহে, তবে যদি ইহাকে ভোগই বলিতে হয়–তবে বলিব “দেব-ভোগ”।
বৈষ্ণবেরা প্রেমের জগতে মৃত্যু স্বীকার করেন না। অনেক পদেই দেখা যায়, দশম দশায় রাধা কৃষ্ণের সঙ্গসুখ কামনা করিতেছেন। আসন্ন মৃত্যু তখনও সখীদিগকে বলিতেছেন, মরিলে আমাকে তমাল ডালে বাঁধিয়া রাখিও (তমালের বর্ণ কৃষ্ণের বর্ণের মত), শ্যামলতা দিয়া বাঁধিও (নামের মিল-হেতু), “আমি হরি-লালসে পরাণ তেজব, তায়ে পাওব আন জনমে”–এইরূপ নানা পদেই দেখা যায়, মৃত্যুর পরও তাহার প্রাণ কৃষ্ণসঙ্গের ইচ্ছা ত্যাগ করিতেছে না; “মৃত্যুর পর আমার এ মৃতদেহ তার চরণেতে দিও ডালি”–এই প্রেম পরমানন্দময়, রাধার মৃত্যুও তাঁহাকে আনন্দপথের যাত্রীস্বরূপ চিত্রিত করিতেছে। আর একটি মাথুরের পদে রাধা বলিতেছেন, “আমার গলায় হার নিকুঞ্জে রহিল, তিনি ফিরিয়া আসিলে যেন একবার ইহা নিজের গলায় পরেন। বড় সাধ করিয়া নিজের হাতে মালতী ফুলের চারা পুঁতিয়াছিলাম, কিন্তু যখন ফুল ফুটিবার সময় হইবে–তখন আর আমি থাকিব না; তোমরা আমার হইয়া মালতী ফুলের মালা গাঁথিয়া তাঁহার গলায় পরাইয়া দিও।” কৃষ্ণকে সেবা করিবার ইচ্ছা ও সঙ্গলিপ্সা মৃত্যু-পথযাত্রীর অন্তিম-দশাকেও আনন্দের পুষ্পে পুষ্পাকীর্ণ করিতেছে। এই সকল পদে রাধা মৃতা ও মৃতপ্রায় নহেন,–অমৃতের অধিকারিণী।