আর একবার গোপী কৃষ্ণকে পরিহাস করিয়াছিল, তাহা বড় কষ্টে। ডাক্তার আসিয়া মুমূর্ষ রোগীকে দেখিয়া যেরূপ মনের অবিশ্বাস ঢাকিয়া একটু হাসে, এই পরিহাস-রস সেই হাসির পর্য্যায়ে। চন্দ্রা কৃষ্ণকে আনিতে মথুরায় গিয়াছে। কৃষ্ণ বৃন্দাবনের কথা জিজ্ঞাসা করিতেছেন। দূতী তখন যে-সকল ব্যঙ্গোক্তি করিয়াছিল, তাহা মর্ম্ম-বেদনায় ভরপুর, হাসির ছদ্মবেশে মর্ম্মান্ত দুঃখের অশ্রু। রাধার কথা বলিতে যাইয়া গোপী বলিতেছে–
‘‘যে গেছে–তার সবই গেছে, কুল গেছে–মান গেছে,
রূপ গেছে, লাবণ্য গেছে, প্রাণ যেতে বসেছে।
তার তোমায় কি বয়ে গেছে, আরও বিষয় বেড়েছে।
পাঁচ পদে যে ব্যাপার করে, এক পদে যদি সে হারে,
হানি কি সে জানতে পারে?’’
‘‘দেখে আমার ব্রজের কথা মনে পড়েছে আজ,
সে কথা শুনাই তোমা বল রস রাজ!”
“ছিল ধেনু গোপের পাড়া–
এথা কত হাতী-ঘোড়া;
সেখানে পরিতে ধড়া,
এথা কত জামা জোড়া,
রাই-পদে লুটান-মাথায় পাগড়ী পড়েছে তেড়া।
ছিলে নন্দের ধেনুর রাখাল,
তারপরে রাই রাজার কোটাল,
একা এসে হয়েছে ভুপাল।”
এই সকল তীব্র-মর্ম্মবেদনার শ্লেষ। কিন্তু চন্দ্রা শেষে কৃষ্ণ-পরিত্যক্ত বৃন্দাবনের যে চিত্র উদ্ঘাটিত করিল, তাহা মর্ম্মান্তিক–
‘‘ভূয়া সে রহলি মধুপুর,
ব্রজকুল আকুল–কলরব দুকুল–
কানু কানু করি ঝুর
যশোবতী নন্দ, অন্ধ সম বৈধত,
সখাগন, ধেনুগণ, সহসা উঠই না পার।
বেনুরব বিসরণ–বিসরণ নগর বাজার।
কুসুম ভেজিয়া অলি, ক্ষিতিতলে লুঠই,
তরুগণ মলিন সমান।
সারী-শুক-পিক, ময়ুরী না নাচত,
কোকিলা না করতহি গান।
বিরহিণী-বিরহ কি কহব মাধব,
দশদিশ বিরহ হুতাশ!
শীতল যমুনা জল, অনল সমান ভেল,
কহতহি গোবিন্দ দাস।
রাধা-কৃষ্ণ লীলার অঙ্কে অঙ্কে চৈতন্য জীবনের ঘটনা। বৈষ্ণবদের কাব্য-কথা বুঝিতে হইলে, চৈতন্যের জীবন-চরিত দিয়া বুঝিতে হইবে–তাহা ছাড়া উপায়ান্তর নাই। কৃষ্ণ-পরিত্যক্ত বৃন্দাবন-চিত্রের সঙ্গে আর একটি চিত্র মিলাইয়া দেখুন–তাহা চৈতন্য-পরিত্যক্ত নবদ্বীপ। চৈতন্য তাঁহার প্রিয় পরিকর জগদানন্দকে পুরী হইতে শচী দেবীকে দেখিতে নদীয়ায় পাঠাইয়াছেন–
‘‘নীলাচল হৈতে, শচীরে দেখিতে,
আইসে জগদানন্দ।
রহি কত দূরে, দেখে নদীয়ারে,
গোকুল পুরের ছান্দ।
লতা-তরু যত, দেখে শত শত,
অকালে খসিছে পাতা।
রবির কিরণ না হয় স্ফূরণ,
মেঘঘন দেখে রাতা।
শাখে বসি পাখা, মুদি দুটি আঁখি,
ফল জল তেয়াগিয়া।
ধেনু বুথে বুথে, দাঁড়াইয়া পথে,
কার মুখে নাহি রা।
নগরে নাগরী, কাঁদরে গুমরি,
থাকয়ে বিরলে বসি।
না মেলে পসার না করে আহার
কারো মুখে নাহি হাসি।’’
‘‘শুনি শচী আই, সচকিতে চাই,
কহিলেন পণ্ডিতেরে।
কহে তাঁর ঠাঁই আমার নিমাই।
আসিয়াছে কত দূরে।’’
চন্দ্রার কথার উত্তরে কৃষ্ণের প্রত্যুত্তের একবার যাত্রায় শুনিয়াছিলাম। সে গানটি মনে নাই, কিস্তু তাহার ভাব এখনও ভুলিতে পারি নাই। তাহা বঙ্গের পরিত্যক্ত পল্লীর কথা পুনঃ পুনঃ মনে করাইয়া দিয়াছিল। প্রথম ছত্রটি মনে আছে; কৃষ্ণ বলিতেছেন–তুমি আমাকে যেতে বলছ, কিন্তু আমি—“আর কি ব্রজ তেমন পাব?”–আর কি রাখালেরা আমায় তেমনই করিয়া তাহাদের একজন ভাবিতে পারিবে? মথুরা-মধ্যে আসিয়া একটা ব্যবধানের সৃষ্টি করিয়াছে–তাহা উত্তীর্ণ হইয়া আর কি ব্রজবাসীরা আমার সঙ্গে তেমনই ভাবে মেলা-মেশা করিতে পারিবে? আর কি গোচারণের মাঠগুলি তেমনই আছে? সখারা কি উচ্ছিষ্ট ফল হাতে লইয়া ছুটিয়া আসিয়া তেমনই করিয়া আমার মুখে দিতে পারিবে? আর কি মা যশোদা হাতে ননী লইয়া আমার জন্য তেমনই পাগলিনীর মত পথে দাঁড়াইয়া গোঠের দিকে চাহিয়া থাকিবেন? যে-ব্রজের রাখালকে দিয়া তোমরা দাসখৎ লিখাইয়া লইয়াছিলে, তাকে কি তোমরা তেমনই প্রেমের ভিখারী মনে করিয়া কটুক্তি করিতে পারিবে?
‘‘আমি আর কি ব্রজ তেমন পাব?’’
এই গানে ব্রজের সুরটি নাই। নিত্য-বৃন্দাবনের লীলা অফুরন্ত। মথুরা তাহা নষ্ট করিতে পারে নাই, বরং ঐশ্বর্য্য-ধাঁধা ঘুচাইয়া ব্রজের গভীর প্রেমকে আরও বড় করিয়া দেখাইয়াছে। নিত্য বৃন্দাবনের সখ্য, বাৎসল্য ও মধুর রসের উৎস কি কখনও ফুরাইবার ও শুকাইবার? পূর্ব্বোক্ত গানটি একান্ত আধুনিক–উহা আমাদের বর্ত্তমান কালের গৃহছাড়া হতভাগ্যদের জন্ম পল্লীর কথা মনে জাগাইয়া দিয়া মর্ম্ম স্পর্শ করে।
রাধাকৃষ্ণ-লীলার অধ্যায়ে অধ্যায়ে এইভাবে হাস্য-রসের চাটনির পর্য্যন্ত অধিবেশন হইয়াছে। দানলীলা, নৌ-বিলাস ও মানভঞ্জনের পালায় এই রস একান্ত বাস্তব জগতের সামগ্রী হইয়া দাঁড়াইয়াছে। কিন্তু মনে রাখিতে হইবে, অত্যন্ত প্রগাঢ় ভাবের ক্ষেত্রে ইহাদের জন্ম, সুতরাং তরল হাস্য ও চাপল্যের মধ্যে সময়ে সময়ে উচ্চাঙ্গের ভাবধারার সন্ধান ইহাতে দুর্ল্লভ হয় না–যেরূপ রূপার ধনিতে কখনও কখনও সোনা পাওয়া অসম্ভব নহে। রাধার মান ভাঙ্গাইবার জন্য কৃষ্ণ কখনও নাপিত-বধু, কখনও দোয়াসিনী (যোগিনী), কখনও বনিকিনী, কখনও বা গায়িকার ছদ্মবেশে আসিয়াছেন, সেই সেই দৃশ্যে পাঠক অনেক আমোদ-প্রমোদর কথা পাইবেন। গোবিন্দ দাসের একটি পদ এখানে উদ্ধৃত করিতেছিঃ–
‘‘গোরথ জাগাই শিঙা ধ্বনি শুনইতে
জটিলা ভিক্ আনি দেল।
মৌনী যোগেশ্বর মাথা হিলাইত,
বুঝল ভিক নাহি নেল।
জটিলা কহত তব কাহা তঁহু মাগত,
যোগী কহ ত বুঝই।
তেরি বধু হাত ভিক্ হাম লওব,
তুরিতহি দেহ পঠাই।
পতিবরতা ভিক্ লেই যব যোগী বরত
না হোয় নাশ,
তাকর বচন শুনইতে তনু পুলকিত
ধাই কহে বধূ পাশ।
দ্বারে যোগীবর পরম মনোহর,
জ্ঞানী বুঝিনু অনুমানে।
বহত যতন করি, রতন ধারি ভরি,
ভিক্ দিহ তছু ঠামে।
শুনি ধনী রাই, ‘আই’ করি উঠল,
যোগী নিয়ড়ে নাহি যাব।
জটিলা কহত যোগী নহি আনমত,
দরশনে হয়ব লাভ।
গোধূম চূর্ণ পূর্ণ থারি পর কনক
কোটরি ভরি ঘিউ।
করজোড়ে রাই, লেহ করি ফুকরই
হেরি ঘর্ ঘর্ জীউ।
যোগী কহত হাম, ভিক্ নাহ লওব,
তুয়া বচন এক চাই।
নন্দ-নন্দন ‘পর যো অভিমানসি,
মাপ করহ ঘরে যাই।
শুনি ধনী রাই চীয়ে মুখ কাঁপল,
ভেকধারী নটরাজ।
গোবিন্দ দাস কহ নটবর শেখর
সাধি চলল নিজ কাজ।”
এমন যেমন “জয় চৈতন্য নিত্যনন্দ” বলিয়া ভিক্ষা চাওয়া হয়, পূর্ব্বে “গোরক্ষ জাগ” শিঙ্গায় বাজাইয়া নাথ-যোগীরা তেমনই ভিক্ষা চাহিতেন। প্রাতে এই ‘জাগ’ শব্দ উচ্চারণ করিয়া নিদ্রাভঙ্গ করিবার একটা রীতি প্রচলিত ছিল, পক্ষীগুলিকেও এই বুলি আবৃত্তি করিবার জন্য শিক্ষা দেওয়া হইত (“রাই জাগ রাই জাগ শুক-শারী বোলে”—চন্ডীদাস)। জটিলা ভিক্ষা দিতে গেলে মৌনী যোগীবর মাথা নাড়িয়া বলিলেন, তিনি ভিক্ষা লইবেন না; তাহার কারণ এই, তিনি পতিব্রতার (এখানে অর্থ সধবার) হাতে ভিক্ষা লইবেন, বিধবার হাতে ভিক্ষা লইলে তাঁহার যোগীর ব্রত নাশ হইবে, তোমার বধুকে পাঠাইয়া দেও। এই কথায় জটিলা হৃষ্টা হইল (সাধুকে খুব সদাচারী মনে করিয়া)। পরপুরুষের কাছে ভিক্ষা লইয়া যাইতে হইবে শুনিয়া রাধিকা “আই” করিয়া বলিলেন, ‘ছিঃ আমি ওর কাছে যাব না।’ জটিলা বলিল–আমি বুঝিয়াছি, যোগী জ্ঞানী ব্যক্তি, তুমি অন্য মত করিও না (দ্বিধাযুক্ত হইও না); ‘ঘর্ ঘর্ জীউ’ অর্থে ভিক্ষা দিতে যাইয়া তাহার জীউ (প্রাণ) স্পন্দিত হইতে লাগিল। “শুনি ধনি রাই—নটরাজ” রাধিকা এ-কথা শুনিয়া চোখ মিলিয়া চাহিতেই বুঝিলেন, ইনি ভেকধারী (ছদ্মবেশী) কৃষ্ণ, তখন স্বীয় আঁচলে মুখের হাসি ঢাকিলেন। “সাধি চলল নিজ কাজ”–নিজের কাজ সিদ্ধি হইয়াছে অর্থাৎ মানভঞ্জন হইয়াছে বুঝিয়া চলিয়া গেলেন।