সন্ধ্যায় আমরা আসরে আসিয়া বসিলাম। গৌরচন্দ্রিকা গাওয়ার পরে শিবু যে গানটি প্রথম গাহিল, তাহা আমার মনে নাই, কিন্তু তাহার মর্ম্ম এই—“ভগবান পাপী-তাপী কাহাকেও ছাড়িতে পারেন না, তিনি সকল দুয়ারেই প্রেমভিক্ষা করিয়া বেড়ান, পাপী তাঁহাকে কষ্ট দেয়, তাঁহাকে ক্ষত-বিক্ষত করে। প্রেমিক তাঁহার এই আচরণে ব্যথিত হন।” এই গানটি অতি করুণ ও গদগদ কন্ঠে সে গাহিয়া আসরে এমন একটি নির্ম্মল হাওয়ার সৃষ্টি করিল, যাহার পরে চন্দ্রাবতীকৃত অত্যাচারের কথা শ্রোতারা ভাবের সেই উচ্চগ্রাম হইতে শুনিল, কোন অশিষ্টভাব মনে হওয়া তো দূরের কথা–ভক্তির বন্যায় আসর ভাসিয়া গেল। শ্রোতারা নির্ব্বিকারচিত্তে শুনিতে লাগিল—“আহা বঁধু শুকায়েছে মুখ। কে সাজাল হেন সাজে হেরি বাসি দুখ।”
বস্তুতঃ বাঙালার নিম্নশ্রেণীর মধ্যে কত যে জ্ঞান-বিজ্ঞানের শিক্ষা–ভক্তি ও প্রেমের গভীর জ্ঞান লুক্কায়িত আছে, তাহা কেমন করিয়া বুঝাইব? তাহাদের অসাধারণ ভক্তি-গঙ্গা-স্রোতে শ্লীল-অশ্লীল বহুমূল্য পণ্য-বোঝাই ডিঙ্গি ও গলিত শব একটানে ভাসিয়া যায়–প্রেমের সাগর-সঙ্গমে। সেই গঙ্গার পাবনী স্পর্শে পবিত্র ও অপবিত্রের মধ্যে বাবচ্ছেদ রেখা মুছিয়া যায়–সকলই দেবতার আশীর্ব্বাদ বহন করে।
গোপীদের এই উপলক্ষে পরিহাস সূচক অনেক পদ চণ্ডীদাস লিখিয়াছেনঃ-
‘‘নয়নের কাজর, বয়ানে লেগেছে,
কালোর উপরে কালো।
প্রভাতে উঠিয়া, ও মুখ দেখিলু,
দিন যাবে আজি ভালো।
অধরের তাম্বুল, নয়নে লেগেছে,
ঘুমে ঢুলু চুলু আঁখি;
আমা পানে চাও, ফিরিয়া দাঁড়াও,
নয়ন ভরিয়া দেখি।
চাঁচর কেশের চিকুর বেণী
সে কেন বুকের মাঝে।
সিন্দুরের দাগ, আছে সর্ব্ব গায়
মোরা হৈলে মরি লাজে।’’ ইত্যাদি–
মান কীর্ত্তনীয়ারা আসরে গায় না–কারণ ইহার প্রতিটি ছত্রে যে প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত আছে, তাহা শীলতার হানিকর। কিন্তু যাঁহারা ভাগবানের চরণে সমর্পিতপ্রাণ রসিক ভক্ত, তাঁহারা গোপীদের মনোবেদনাপূর্ণ শ্লেষের ভাষার মধ্যে করুণাময়ের প্রতি ব্যথিত চিত্তের অশ্রুভারাক্রান্ত নিবেদনের ভাব উপলব্ধি করিয়া থাকেন।
সেকালের রুচি আর একালের রুচির লক্ষ্য পৃথক। এখনকার লোকেরা জগতের অদ্বৈতরূপ দেখিতে পান না। ভাল-মন্দ, পবিত্র-অপবিত্র, ভষ্ম-চন্দন প্রভৃতি সমস্ত ব্যাপিয়া যাঁহার সত্বা, তাঁহাকে তাঁহারা পোষাকী করিয়া মন্দির মধ্যে–জগৎ হইতে স্বতন্ত্র স্থানে তুলিয়া রাখিতে চান; প্রাচীনেরা তাঁহাদের সমস্ত ক্রিয়া কর্ম্ম, লীলা খেলারও মধ্যে তাঁহাকে না পাইলে তৃপ্ত হইতেন না। যাঁহাকে তাঁহারা পূজার ঘরে প্রতিষ্ঠিত করিয়াছেন, তাঁহাকে তাঁহারা খেলার ঘরে আনিতেও দ্বিধা বোধ করিতেনে না। সমস্ত দেহ ও সর্ব্বেন্দ্রিয় এবং মন দ্বারা তাঁহাকে সেবা করা–এই ছিল তাঁহাদের ভাবধারা। ভক্তি-ভস্ম গায় মাখিয়া তাঁহারা প্রেম-মধুচক্রে প্রবেশ করিতেন, তখন তাঁহারা ইন্দ্রয় মক্ষিকার দংশনের অতীত হইয়া থাকিতেন। কোন একটি ভাল কীর্ত্তনের আসরে ভক্তের কণ্ঠে কীর্ত্তন শুনিলে, আমি যাহা বুঝাইতে এত কথা বলিলাম, তাহা পাঠক অনায়াসে বুঝিতে পারিবেন। আমি সেই ভক্তির কণা কোথায় পাইব, যাহার বন্যাস্রোতে মহাপ্রভু এদেশের নিম্নশ্রেণীকে মাতাইয়াছিলেন! পণ্ডিতেরা সেই ভক্তির অমৃতভাণ্ড ফেলিয়া দিয়াছেন, নিম্নশ্রেণীর লোকেরা এখনও সেই প্রসাদ কুড়াইয়া রাখিয়া দিয়াছে।
এদেশের কীর্ত্তনের একটা বিশেষ মূল্য আছে। গণিকারাও কীর্ত্তন গাহিয়া থাকে। তাহাদিগকে ব্রহ্মসংগীত, রামপ্রসাদ ও দামরথীর গান, বাউল সংগীত, টপ্পা, খেয়াল, গোপাল উড়ের গান, নিধুবাবুর গান প্রভৃতি যাহা কিছু গাহিতে বলা যায়, তাহাই গাহিবে। কীর্ত্তন গাহিতে হইলে বলিবে, “স্নান করিয়া কাপড় ছাড়িয়া আসি”; শুদ্ধা, স্নাতা না হইয়া তাহারা কীর্ত্তন গায় না। কীর্ত্তন সম্বন্ধে এদেশের জন-সাধারণের কিরূপ উচ্চ ধারণা, তাহা ইহা হইতে বুঝা যায়। কৃষ্ণ গোপীদের শ্লেষের উত্তরে অনেক উপদেশ দিয়াছেন, গোপীরা বলিতেছে–
“ভাল ভাল ভাল, কালিয়া নাগর, শুনালে ধরম কথা,
সরলা-বালিকা ছলিলে যখন, ধরম আছিল কোথা?
চলিবার তরে কর উপদেশ পাথর চাপিয়া পিঠে,
বুকেতে মারিয়া ছুরির ঘা, তাহাতে নুনের ছিটে।”
–সেই ভবঘুরে কৃষ্ণের জগতে কোথায় গতিবিধি নাই? ধর্ম্মযাজকের ভজন-মন্দির ও মাতালের আড্ডা–সর্ব্বত্র তাঁহার অবাধ গতি। এজন্য গোপী বলিতেছে-
‘‘সোনা, রূপা, কাঁসা চোর কি বাছে,
চোরের কখন কি নিবৃত্তি আছে?’’
আধুনিক শিক্ষিত সম্প্রদায় এই সকল গানের মূল্য ধর্ম্মের দিক্ দিয়া স্বীকার করিবেন কিনা সন্দেহ। কিন্তু বঙ্গদেশে প্রেমের পথে সাধকের অভাব নাই। পল্লীর কুটিরে এখনও বৃদ্ধ বৈষ্ণব একতারা লইয়া এই ধরণের গান গাহিয়া কাঁদিয়া বিভোর হন। সোণার পুতুল রাই-এর কষ্টে তাঁহার প্রাণ বিগলিত হয়। গৌরাঙ্গকে কৃষ্ণ একবার দেখা দিয়া পুনরায় অদৃশ্র হইয়া যত কাঁদাইয়াছেন–সেই কথা তাহার মনে পড়ে। সে ইন্দ্রিয়াতীত রাজ্যের বিশুদ্ধ লীলার স্বাদ আমরা কোথায় পাইব? যাহা খড়-কুটোকে সিড়িরূপে ব্যবহার করিয়া ভক্তির রাজ্যে পৌছাইয়া দেয়!