শুধু এই পদটি ও রায়শেখরের পদগুলি নহে, কত বাঙালা পদ যে বিদ্যাপতির উপর আরোপ করা হইয়াছে, তাহা নির্ণয় করা সহজ নহে। “মরিব মরিব সখী নিশ্চয় মরিব, কানু হেন গুণনিধি কারে দিয়া যাব”–গানটি, যাহার অস্থি, পঞ্জর, ত্বক, মাংস সমস্তই বাঙালীর মাটী ও বাতাসের উপাদানে গড়া–তাহা কেন যে বিদ্যাপতির ঘাড়ে চাপানো হইয়াছে, তাহা একটা সমস্যা। এই গানটির ভাব সুপ্রাচীন কাল হইতে বাঙালার হাওয়ায় ঘুরিতেছে। মিথিলার সঙ্গে ইহার কোনই সম্পর্ক নাই। আমি ত্রিপুরার জঙ্গলে গ্রাম্য কৃষকের মুখে ভাটিয়াল সুরে এই গানের মর্ম্ম শুনিয়াছি—“আমি মৈলে এই করিও, না পেড়োয়া না ভাসায়ো”, অন্যান্য বহু বঙ্গীয় বৈষ্ণব কবির কণ্ঠে ভিন্ন ভিন্ন ছন্দে মনোহরসাই রাগিণীতে এই গীতি শোনা গিয়াছে। “আমার নীরে নাহি ডারবি, অনলে নাহি পোড়াবি” কিন্বা “দেহ দাহন কর না দহন দাহে, ভাসায়ো না তাহা যমুনা প্রবাহে” এবং “প্রাণ যদি দেহ ছাড়া, না দ’হ বহ্নিতে মোরে না ভাসায়ো যমুনা সলিলে”, প্রভৃতি বহু পদে, বাঙালার প্রতি কোণে কোণে শত শত নরনারী কণ্ঠে যে কথা বহুকাল হইতে প্রতিনিয়ত ধ্বনিত হইয়া আসিয়াছে, বাঙালা দেশের সেই মর্ম্মোক্তি, বাঙালা ভাষায় রচিত। বাঙালা ছন্দে গ্রথিত সেই গানটি কেন যে বিদ্যাপতির পদাবলীর মধ্যে আসন পাইল এবং সুবিজ্ঞ সম্পদকেরাই বা কেন এই অনধিকার-প্রবেশ সম্বন্ধে চুপ করিয়া রহিলেন, তাহা তাঁহারাই জানেন! এইরূপ আরও অনেক বাহিরের পদ বিদ্যাপতির পদ-সংগ্রহে ঢুকিয়া বইখানি ধাউসের মত বৃহদাকৃতি করিয়া তুলিয়াছে। দৃষ্টান্ত স্থলে আরও কয়েকটি পদের প্রথম দুই এক ছত্র উল্লেখ করিতেছি–সেগুলি নিছক বাঙ্গালা পদ—“আজি কেন তোমায় এমন দেখি, সষনে ঘুরিছে অরুণ আঁখি”—“শুনলো রাজার ঝি তোরে কহিতে আসিয়াছি, কানু হেন ধন, পরাণে বধিলি, এ কাজ করিলি কি?”
মিলনের দৃশ্য আরও অনেক কবি দেখাইয়াছেন, তাহাদের কোন কোনটিতে অধ্যাত্মরাজ্যের ছায়া পড়িয়াছে। “আজি নিধুবনে শ্যাম-বিনোদিনী ভোর, দোঁহার রূপের নাহিক উপমা, সুথের নাহিক ওর” পদটি দৃষ্টান্ত-স্বরূপ গৃহীত হইতে পারে। এই জগতে একদিকে ঘননীল বনান্ত ও সুনীল নভস্তল, অপরদিকে সোনালী রৌদ্র ঝক্ ঝক্ করিতেছ্ এই বিশ্ব প্রকৃতির রূপ লইয়া যুগলমূর্ত্তি সখিদিগের মন মুগ্ধ করিতেছে–
‘‘আজি হিরণ-কিরণ, আধ-বরণ আধ-নীলমণি জ্যোতি,
আধ-গলে বনমালা বিরাজিত, আধ-গলে গজমতি,
আধ-শিরে শোভে ময়ুর-শিখণ্ড, আধ-শিরে দোলে বেণী,
কনক-কমল করে ঝলমল ফণী উগারয়ে মণি,
আধই শ্রবণে মকর-কুণ্ডল, আধ রতন ছবি,
আধ-কপালে চাঁদের উদয়, আধ-কপালে রবি।
মন্দ পবন মলয় শীতল তাহে শ্রীঅঙ্গের বাস।
রসের সায়রে না জানি সাঁতার ডুবিল অনন্ত দাস।’’
হেম-কান্তি ও নীলকান্তিতে, ময়ূরপুচছ ও বেণীর লহরে আধ সিন্দূর বিন্দুর সঙ্গে আধ-কপালের চন্দনবিন্দুতে গজমতি হার ও বনমালায়–চিরপিপাসিত বহু কৃচ্ছ উত্তীর্ণ প্রকৃতি-পুরুষের আনন্দময় মিলন–এই চিত্র দেখিয়া কবি ভুলিয়া গিয়াছেন, তিনি লিখিয়াছেন, এ রস সৌন্দর্য্য সমুদ্র পার হইবার সাধ্য তাঁহার নাই–কারণ তিনি সাঁতার জানেন না, এই জন্য ডুবিয়া গেলেন। এই চিত্র কি? মন্দিরে মন্দিরে আরতিকালে ধূপধূমচ্ছায়ার মন্দীভূত পঞ্চপ্রদীপের আলোকে রাধাকৃষ্ণের যুগলমূর্ত্তি লক্ষ্য করুন, তারপর বাহিরে চাহিয়া রৌদ্রকরোজ্জ্বল গগনে বনাস্তবীথিকার শিশিরবিন্দুতে ও নীলিম পল্লবে সেই মূর্ত্তির প্রভা দেখিতে পাইবেন। এই জগৎ সেই আনন্দময় প্রকৃতি পুরুষের মিলন দৃশ্য উদঘাটিত করিয়া দেখাইতেছে। ইহা এ-পার ও পরপারের কথা একসঙ্গে মনে জাগাইবে।
আমি পূর্ব্বেই বলিয়াছি, বৈষ্ণব কবিরা সাধারণের নিকট তাঁহাদের কাব্য এক হইতে দেন নাই; কেবলই মিষ্টরসে রসনায় জড়তা আসে–কেবলই সন্দেশ খাওয়া যায় না, মাঝে মাঝে মুখরোচক কিছু দিয়া স্বাদ বদলাইতে হয়। পরিহাস-রসের দৃষ্টান্ত আমরা মান-মিলন উপলক্ষে দেখাইয়াছি। ইহা ছাড়া আরও কোন কোন স্থানে ইহা প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। সেই সেই অংশে আমরা যেন হঠাৎ স্বর্গরাজ্য হইতে বান্তবরাজ্যে পড়িয়া যাই। যাত্রা ও কীর্ত্তনে এই পরিহাস রসিকতা অতি স্পষ্ট হইয়া উঠিয়া শ্রোতার মনোরঞ্জন করে। কিন্তু পাঠকেরা মনে করিবেন না, এই রসের বাহিক তারল্য বৈষ্ণব আদর্শকে কোন স্থানে ক্ষুণ্ণ করিয়াছে, এই রস ইতর লোকের তাড়ি নহে, শিক্ষিত সম্প্রদায়ের টেবিলের বাহ্যিক রুচিসঙ্গত ‘বিয়ার’ নহে–ইহা ঘন খর্জ্জুর রস। ইহার জন্ম মাতালের বাহবা-দেওয়া ঘন করতালির মধ্যে নহে–ইহার জন্ম অসাধারণ তপস্যা ও কৃচ্ছ্রের মধ্যে–বিদীর্ণ ও কর্ত্তিত হৃদয়ের মধ্যে হইতে বাহির হয়, এই হাস্য-রস উপভোগের সময় মাঝে মাঝে চোখে জল আসে, কারণ হাসি হইলেও ইহা বড় কষ্টের হাসি।
মান-মিলনের পূর্ব্বে হাস্যরসের দ্বিতীয় অবকাশ খণ্ডিতা। রাধিকা বুঝিয়াছেন, কৃষ্ণ সমস্ত জগতের–তাঁহার একার নহেন। তিনি তাঁহাকে শুধু রাধা নামের ছাপ দিয়া ধরিয়া রাখিবেন কিরূপে? এই সন্দেহে সারারাত্রি প্রতীক্ষায় কাটাইয়াছেন, তাঁহার বকুলমালার ফুলগুলি বাসি হইয়া গিয়াছে। বেণী শিথিল হইয়াছে, দুরন্ত সূর্য্যের আলো যেরূপ পশ্চিম গগনে মিশিয়া যায়, তাঁহার অধরপ্রান্তে বিলীন হইয়া গিয়াছে। প্রভাতে কৃষ্ণ আসিয়াছেন, বড় কষ্টের মধ্যে সখীরা তাঁহাকে পরিহাস করিতেছঃ–
‘‘ভাল হৈল ওরে বধূঁ আইলে সকালো,
প্রভাতে দেখিলাম মুখ দিন যাবে ভালো।’’
বহু বৎসর পূর্ব্বে একদা শিবু কীর্ত্তনীয়া শ্রীযুক্ত গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাশয়ের বাড়ীতে কীর্ত্তন গাহিয়া শ্রোতৃবৃন্দকে মুগ্ধ করিয়াছিল। পূর্ব্বরাগ, মাথুর, গোষ্ঠ প্রভৃতি নানা পালা গাহিবার পরে, একটি নূতন পালা গাওয়া হইবে। দ্বিজেন্দ্রনাথ, সত্যেন্দ্রনাথ, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ও ঠাকুর-পরিবারের অপরাপর প্রায় সমন্ত ব্যক্তিই প্রত্যহ আসরে উপস্থিত থাকিতেন। অপরদিকে সেই পরিবারের মহিলারাও গান শুনিতে আসিতেন। রবীন্দ্রনাথই শিবুকে আনাইয়াছিলেন। মাথুর গাইয়া শিবু শ্রোতৃবর্গকে অশ্রুর বন্যায় ভাসাইয়া লইয়া গিয়াছিল। বৃদ্ধ দ্বিজেন্দ্রনাথই শ্রোতাদের মধ্যে বেশী কাঁদিতেন। ছেলেদের গৃহ-শিক্ষক জার্ম্মান্ Lawrence সাহেব কথাগুলি না বুঝিয়াও শিবুকৃত এই অপূর্ব্ব উদ্মাদনার প্রভাব দেখিয়া বিস্মিত হইতেন, তিনি চুপ করিয়া আসরের একটি কোণে বসিয়া থাকিতেন। একদিন রবীন্দ্রনাথ প্রাতে শিবুকে বলিলেন, “কীর্ত্তন তো বেশ গাহিতেছ, আজ সন্ধ্যায় কি গাহিবে?” শিবু বলিল, “খণ্ডিতা”। রবীন্দ্রনাথ চক্ষূ বিস্ফারিত করিয়া বলিলেন, “শিবু এইবার দেখ্ছি মজালে! আমাদের বাড়ীর মহিলাদের সম্মূখে তুমি “খণ্ডিতা” গাইবে? এইবার তোমার অর্জ্জিত যশ পণ্ড হবে। ব্রাহ্ম মেয়েদের রুচি তুমি জান না–ইহাদের কাছে তুমি খণ্ডিতার পালা গাইবে কোন্ সাহসে?” শিবু জোড়হাতে করিয়া বলিল, “হুজুর, আমরা যে-জিনিষটা যে ভাবে দেখি, আপনারা সে-ভাবে দেখেন না। আমাদের কাছে রাধাকৃষ্ণের লীলা পবিত্র, ইহাতে পাপ আসবে কিরূপে? আপনি আসরে এসে দেখবেন, কোন অসঙ্গত ভাব বা ভাষা আমার মুখ হতে বাহির হবে না।”